চাঁদপুর

চাঁদপুরে কচুয়ার সন্তান পুকুরে ৭২ ঘণ্টা ডুবে থেকে রের্কড!

তিনি মাছ কিংবা পানকৌড়ি নন যে দিবানিশি পানির সঙ্গে মিতালি করে জীবনটা কাটিয়ে দেবেন পানিতে। অন্য দশটা রক্ত মাংসের মানুষের মতই তিনিও একজন মানুষ। তবে অন্য সাধারণ মানুষের চেয়ে তিনি আলাদা অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এজন্য যে, তিনি একাধারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিনের পর দিন পানির নিচে অনায়াসেই কাটিয়ে দিতে পারেন। স্বপ্নও দেখেন তিনি এক ডুবে ব্রিটেনের ইংলিশ চ্যানেল পার হতে। এই অসাধ্য কাজটি করতে বরাবরই প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন তিনি।

এরইমধ্যে একটানা ৭২ ঘণ্টা পানির নিচে থেকে রেকর্ড সৃষ্টিকারী এই বিরল ব্যক্তিত্বকে উপাধি দেয়া হয়েছে মৎস্যমানব হিসেবে। নাম তার মিজানুর রহমান চৌধুরী।

কে এই মিজান চৌধুরী: বর্তমানে কুমিল্লা নগরীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান চৌধুরী মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামমুখর শেষ পর্যায়ের সময়ে ১৯৭১ সালের ১২ নভেম্বর চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার আতিশ্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মো. আলী আর্শাদ চৌধুরী ও মাতা ফজিলত চৌধুরীর ৫ ছেলের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দীর্ঘ ২৩ বছর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত থেকে অবসর গ্রহণ করেন ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। বর্তমানে কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার মোহাম্মদপুর এ.আর উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তার স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন আঁখি লালমাই ডিগ্রি কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

যেভাবে মৎস্যমানব: হাই স্কুলে পা দেয়ার পরপরই সাঁতার এবং পানি এই দু’টির প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন মিজান চৌধুরী। এক পর্যায়ে শখ হয় পানির নিচে ডুব দিয়ে থাকা। এই শখ এক সময় তার নেশা হয়ে উঠে। যে নেশা তাকে আজ খ্যাতির চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসছে। ১৯৮৩ সালে যখন তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখন থেকে তিনি পানির নিচে ডুব দিয়ে থাকার প্র্যাকটিস করতে থাকেন নিয়মিত। দীর্ঘ ১২ বছর এক টানা অনুশীলনের পর ১৯৯৪ সালে জীবনে প্রথম বারের মত তার সুযোগ আসে মৎস্যমানব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত বা স্বীকৃতি পাওয়ার।

এ বছর কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার পুকুরে একটানা ৩০ ঘণ্টা পানির নিচে ডুবে থাকার প্রথম প্রদর্শনীতে অংশ নেন। এই প্রদর্শনীটির আয়োজক ছিলেন, তৎকালীন কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক রূপসী বাংলার সম্পাদক প্রয়াত অধ্যাপক আবদুল ওহাবসহ স্থানীয় নেতারা। এই প্রদর্শনীর খবর ছড়িয়ে পড়লে তৎকালীন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার প্রয়াত হুমায়ুন খান পন্নী এবং কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কাতেবুর রহমান তাকে সংবর্ধিত করেন। এর এক বছর পরেই ১৯৯৫ সালে নিজ গ্রাম চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার আতিশ্বর গ্রামের পুকুরে ১৮ ঘণ্টার প্রদর্শনী করেন।

১৯৯৬ সালে নারায়নগঞ্জ জেলা সদরের নাগ বাড়ির পুকুরে নূর সমাজকল্যাণ সংস্থার উদ্যোগে ২৪ ঘণ্টার ডুবন্ত প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল টাঙ্গাইলে জেলার এবং একই বছর ১ মে চাঁদপুরের মতলব ২৪ ঘণ্টা ডুবন্ত প্রদর্শনী করেন। একই বছর কচুয়া সরকারি হাই স্কুল মাঠ সংলগ্ন পুকুরে ৭২ ঘণ্টার পানিতে ডুবে থাকার প্রদর্শনী করা হয়। এই প্রদর্শনীর পর জনগণ তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৎস্যমানব উপাধি দেয়।

এর পর ২০১৭ সালের ২৬ মার্চ দেবিদ্বার দুয়ারিয়া এজি মডেল একাডেমির অধ্যক্ষ আবু মো. সেলিম ভূইয়ার উদ্যোগে এক ডুবন্ত প্রদর্শনী করা হয়। আর সর্বশেষ প্রদর্শনী করেন চলতি বছরের পহেলা বৈশাখ গত ১৪ এপ্রিল কুমিল্লার দেবিদ্বারে। এখানে নববর্ষের দিন তিনি ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট পানিতে ডুব দিয়ে থাকেন। এ ছাড়াও মিজানুর রহমান চৌধুরী সেনাবাহিনীতে চাকরি করাকালীন(১৯৯১-২০১৪) একাধিক ডুবন্ত প্রদর্শনীতে অংশ নেয়াসহ এ পর্যন্ত প্রায় ২৫-৩০টি প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন তিনি।

পানিতে ডুবে থাকা ও খাওয়া দাওয়া: মৎস্যমানব মিজান চৌধুরী দীর্ঘক্ষণ পানির নিচে ডুবে থাকলেও তার কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তিনি এ পর্যন্ত টানা ৭২ ঘণ্টা পানির নিচে ডুবে থেকেছেন এবং আরো অনেক সময় নিয়ে তিনি থাকতে পারবেন বলে জানান। তিনি পানির নিচে চা, দুধ, ফল, চকলেট ও অন্যান্য খাবার গ্রহণ করেন। হাতের ইশারায় দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর ও দিয়ে থাকেন। তিনি ৩-৪ ফুট পানির নিচে বাঁশের খুটি গেড়ে চেয়ারে বসে থাকেন।

মৎস্যমানব মিজানের লক্ষ্য: মৎস্যমানব মো. মিজানুর রহমান চৌধুরীর আজীবনের লালিত স্বপ্ন এক ডুবে ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়া। তার স্পষ্ট বক্তব্য, ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার মত সমস্ত যোগ্যতাই আমার আছে। কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষ পাচ্ছি না যোগাযোগ করার জন্য। তিনি এজন্য বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী একটু চেষ্টা করলেই আমি এক ডুবে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকাকে তুলে ধরতে পারব ইনশাল্লাহ।

মৎস্যমানবের দুঃখ: মৎস্যমানব মো. মিজানুর রহমান চৌধুরীর দুঃখ হলো, ২০০৫ সালে মাত্র ১৩.৩৭ সেকেন্ড ডুবে থেকে এক ব্রিটিশ নাগরিক গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে স্থান করে নিয়েছে। অথচ আমি ৭২ ঘণ্টা ডুবে থেকেও গিনেস বুক তো দূরের কথা আজ পর্যন্ত ভালভাবে আমাদের দেশের মিডিয়ার দৃষ্টিও আকর্ষণ করতে পারলাম না।

Share