চাঁদপুর

বিশাল এক বাড়ি নিয়ে গঠিত চাঁদপুরের এক গ্রামের অজানা রহস্য

পুরো একটি গ্রাম নিয়ে একটি বাড়ি, একটি ওয়ার্ড একই ধর্মের প্রায় ৬ হাজার লোকের বসবাস। বাড়িতে ভোটার সংখ্যা ২ হাজার ২’শ। সবাই সনাতন ধর্মের অনুসারী। বাসিন্দারা পেশায় জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ী। বিয়ে-শাদি বেশির ভাগই হয় নিজেদের মধ্যে।

আয়তনে ওই গ্রামের দৈর্ঘ্য প্রায় ২ কিলোমিটার। প্রস্থ আধা কিলোমিটার। এ বাড়ীতে রয়েছে ১’শ ১টি নলকূপ, ৮টি মন্দির, কাপড়ের দোকান, স্বর্ণের দোকান, দু’টি সেলুন, ফার্নিচারের দোকান, কয়েকটি মোবাইল ক্রয়-বিক্রয়ের দোকান। এসব দোকানগুলো তাদের ঘরেরই একটি অংশ।

বিরল এ বাড়িটি চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার নায়েরগাঁও দক্ষিণ ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মেহরন দালাল বাড়ি নামে সবার কাছে পরিচিত।

এ বাড়িতে প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে।

বাড়িটি নারায়নপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরে এ অবহেলিত গ্রামটি অবস্থিত। ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্য পূর্বে নৌকা ছিলো একমাত্র বাহন।

তবে এখন নায়েরগাঁও বাজার থেকে পায়ে হেঁটে, রিকশা কিংবা অটো বাইকেও যাওয়া যায়। বাড়িতে প্রবেশের জন্য পূর্ব ও উত্তর দিক দিয়ে দু’টি মাটির রাস্তা রয়েছে।

বাড়িটিতে গিয়ে কথা হয় বাসিন্দাদের সাথে, অবহেলিত হওয়ার বর্ণনা দেন প্রতিবেদকের কাছে।

সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নরেন্দ্র দাসের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাড়ির ঘরগুলো গিজ গিজ করে। উঠান বারান্দা কিংবা বাগানবাড়ি বলতে কিছু নেই। কোথাও এক ঘরের মূল দরজার সামনেই আরেক ঘরের েেবড়া। সব মিলিয়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে, সূর্যের দিকে না তাকালে দিক নির্ণয় করা বড় মুশকিল। অধিকাংশ ঘর টিনের। রাস্তগুলো সরু। বৃষ্টি হলে দূর্ভোগে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।

তবে বাড়ির সরু রাস্তাগুলো সরাকারি অনুদানে পাকাকরণ হয়েছে। বাড়ির ভেতরে নতুন কেউ ঢুকে আরেকজন পথ দেখিয়ে দেয়া ছাড়া তিনি বের হতে পারবেন না।

এজন্য সেখানে প্রবাদ প্রচলন আছে দালাল বাড়ীতে চোর ঢুকেনা। কারণ, চোর ঢুকলে বেরুতে পারেনা। বাড়ির দু’দিকে বোয়ালজুড়ি খাল। বর্ষাকালে চারিদিকে পানি। মাত্র একটি আধা পাকা ও মাটির রাস্তা।

ওই বাড়ির বাসিন্দা জয় গোপাল দাস চাঁদপুর টাইমসকে জানান, অধিবাসীদের অধিকাংশরই পেশা মাছ ধরা। বাড়িতে একটি পরিবার শুধু শীল বংশের। বাকিরা দাস বংশের। বিয়ে-শাদি বেশির ভাগই হয় নিজেদের মধ্যে। এ বাড়ীতে রয়েছে ১’শ ১টি নলকূপ, ৮টি মন্দির, কাপড়ের দোকান, স্বর্ণের দোকান, দু’টি সেলুন, ফার্নিচারের দোকান, কয়েকটি মোবাইল ক্রয়-বিক্রয়ের দোকান। এসব দোকানগুলো তাদের ঘরেরই একটি অংশ। বিনোদনের জন্য রয়েছে টেলিভিশন ও ডিস সংযোগ।

স্বাস্থ্য সম্মত টয়লেটের রয়েছে চরম অভাব। সেখানে রয়েছে ১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রায় ৬’শ শিশু চারভাগের একভাগও স্কুলে যায় না।

ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য রয়েছে একটি মাত্র নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার জন্য কয়েক মাইল হেঁটে যেতে হয় নারায়নপুর পপুলার উচ্চ বিদ্যালয়ে।

মেহেরন দালাল বাড়ীর নামকরণ কিভাবে হয়েছে তা জানে না সেখানকার ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দারা।

তবে জগন্নাথ মন্দিরের পূজারী বয়োঃবৃদ্ধ সচিন্দ্র চক্রবর্তী চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ‘মেহেরন মূলতঃ মহারণ ছিল। মহা অর্থ বড় আর রণ অর্থ যুদ্ধ। অর্থাৎ বড় যুদ্ধ। কোন এক সময়ে এখানে জাগতিক বড়যুদ্ধ হয়। তখন এর নাম হয় মহারণ। পরে আস্তে আস্তে লোকজন মহারণকে মেহেরন নামে ডাকতে শুরু করে। এখানে জমিদাররা বসবাস করতো। এ এলাকায় কেউ জুতা পায়ে দিয়ে হাটতো না।

নামকরণ সম্পর্কে জমিদারদের বংশধর সমীর দাস চাঁদপুর টাইমসকে বলেন দেড়’শ বছর আগে কালাচান দাস, গিরিশ চন্দ্র দাস ও তার আত্মীয়-স্বজন পশ্চিম বঙ্গ থেকে এখানে আসেন। এখানে তারা দীর্ঘদিন ব্যবসা বাণিজ্য করেন। এখন তাদের কেউ নেই। কেউ ভারতে চলে গেছেন, আবার কেউ অন্যত্র চলে গেছেন। এ বাড়িতে জেলেরা স্থায়ীভাবে বসবাস করছে জমিদারদের বৃটিশরা উপাধি দেয় দালাল বলে। এ জন্য এ বাড়ির নাম মেহরন দালাল বাড়ি। জমিদারদের দো’তলা দুটি ভবন এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে।

ইউপি মেম্বার উত্তম দাস চাঁদপুর টাইমসকে জানান, এ বাড়ীর অধিবাসীদের স্বচ্ছলতা ও শিক্ষাদিক্ষা না থাকলেও নির্বাচনে তাদের বাড়িতে কদর থাকে। তাদের ভোট ছাড়া কারও পক্ষে চেয়ারম্যান হওয়া সম্ভব হয় না। নিজেদের ভোটে বাড়ি থেকে মেম্বার পাস করিয়ে নেয় তারা। ভোটের সময় সবাই তাদের কাছে ধর্না দেয়। ভোট চলে গেলে কেউ তাদের খোঁজ নেয় না।

তিনি আরো জানান, এখানে অবস্থিত ৮টি মন্দিরের মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে জগন্নাথ মন্দির। মন্দিরে রয়েছে নিজস্ব ৭ একর জায়গা। মন্দিরের জায়গা দাতাদের বংশধরগণ এখন পূজারী ও পুরোহীত। এদের কাছ থেকে পরিচালনা ক্ষমতা নিয়ে ৭টি মামলাও হয়েছে।

এ ইউপি মেম্বার আরো জানান, এ বাড়ির লোকদের বেশির ভাগ সমস্যায় পড়তে হয় গর্ভবীত মা রোগীদের চিকিৎসার জন্য। কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা কোন ধরনের স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র নেই এ বাড়িতে।

ওই বাড়ীর বিরেন্দ্র মাস্টার, অতিন্দ্র সাদু ও স্বর্ণ কুমার দাস তাদের বাড়ির বসবাসকারী ছেলে- মেয়েদের জন্য একটি উচ্চ বিদ্যালয়, স্বাস্থ্য সেবার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক ও একমাত্র সড়কটি পাকা করণের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

তাহলেই অবহেলিত ও বিরল এ বাড়ির মানুষ নাগরিক সুবিধার আওতায় আসবে।

: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৭:০০ এএম, ২৮ নভেম্বর ২০১৬, মঙ্গলবার
ডিএইচ

About The Author

প্রতিবেদক- মাজহারুল ইসলাম অনিক
Share