চাঁদপুর

বহু গুণে গুণান্বিত চাঁদপুরের মেয়ে মনিরা

চাঁদপুরের মেয়ে মনিরা আক্তার। বিজ্ঞাপন ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা, নারী উদ্যোক্তা, লেখক বহু গুণে গুণান্বিত তিনি। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠায় তিনি কর্মজীবনের গৎবাঁধা গণ্ডিতে আটকে থাকতে চাননি।

নিজে কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। তার এ কাজে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন বাবা-মা। দুই বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৯১ সালে এমএসএস করেন। এর পরের বছরই ‘কল্পতরু’ নামে একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান খোলেন। একজন বিজ্ঞাপন নির্মাতা হিসেবে বিড়লা টায়ার, বিভিন্ন সংস্থার শাড়ি ইত্যাদির বিজ্ঞাপন তৈরি করেন।

১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞাপন নির্মাতা হিসেবে কাজ করেন। এরপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে আকৃষ্ট হন। আর এ কাজে পুরোপুরি সমর্থন পেয়েছিলেন পরিবার থেকে। বাবা আবুল ফজল ছিলেন পেশায় একজন আইনজীবী। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মা সালেহা বেগম চাঁদপুর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সদস্য ছিলেন।

এ প্রসঙ্গে মনিরা আক্তার বলেন, আদিবাসীদের ভাষা-সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতা ইত্যাদি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এ প্রমাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করি। ময়মনসিংহের গারো, হাজং, কোচ, উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, রাজশাহী, রংপুর, নওগাঁর সাঁওতাল, ওরাও, মালো, পাহান, বুনো, কড়া, সিলেটের খাসিয়া, মনিপুরী, কক্সবাজার, পটুয়াখালীর রাখাইন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ইত্যাদি এলাকার আদিবাসী নারী-পুরুষ-শিশুর জীবন-সংস্কৃতি প্রামাণ্য চিত্রগুলোতে তুলে ধরার প্রয়াস করি। ‘আমাদের আদিবাসী’ নামে চ্যানেল আইতে মাসে দুদিন প্রচারিত হয়।

এসব অঞ্চলের আদিবাসীদের ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ ও কয়েকটি দেশাত্মবোধক গান আদিবাসী আটটি ভাষায় (চাকমা, মারমা, চাক, খিয়াং, ত্রিপুরা, ওরাও, সাঁওতাল, গারো) রূপান্তর করি। আদিবাসীদের আটটি ভাষায় রূপান্তরিত গানগুলো বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়।

আদিবাসীদের জীবন বৈচিত্র্যের ওপর প্রামাণ্যচিত্র করতে গিয়ে মনিরা আক্তার নারীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়েও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে নারীর উন্নয়নমূলক কাজ করতে গিয়ে তার মনে হয় প্রত্যক্ষভাবে নারীদের জন্য কিছু করা দরকার।

এ ভাবনা থেকে অর্থনৈতিকভাবে নারীদের সাবলম্বী করার লক্ষ্যে নারী উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোগ নেন। প্রথমে পাঁচজন নারীকে নারী উন্নয়নবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেন। যাতে তারা নিজের সম্পদকে কাজে লাগিয়ে সাবলম্বী হতে পারেন।

এ উদ্যোগকে স্থায়ী করার জন্য একটি বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংস্থার মাধ্যমে কক্সবাজারের উখিয়ার মনখালি প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বছরে চারটি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রতিটি প্রশিক্ষণ এক সপ্তাহ করে প্রদান করা হয়। এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা নিজের সম্পদকে ব্যবহার করে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হয়েছেন।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে মনিরা আক্তার অনুভব করেন, এসব এলাকার নারীর স্বাস্থ্য খুবই দুর্বল। মাসিককালীন এ নারীরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আরও পড়ুন- বিয়ের পর পাত্রকে কানাডায় নিয়ে যাবে সেই পাত্রী এখন রিমান্ডে

চাঁদপুরের মেয়ে মনিরা আক্তারের মতে, প্রথম পাঁচজন নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়েছিল। প্রশিক্ষিত এ পাঁচ নারীকে দিয়ে দেশীয় পদ্ধতিতে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করি। তাদের তৈরি স্যানিটারি ন্যাপকিন স্বল্পমূল্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের কাছে পৌঁছে দিই। যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা মাসিককালীন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে না থাকেন।

প্রত্যন্ত এলাকার নারীদের পাশাপাশি ১৫ প্রতিবন্ধী মেয়েকে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির মাধ্যমে যাতে তারা নিজের কর্মসংস্থান তৈরি করে। এখন তারা স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করছেন।

২০১৯ সালে বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে চাঁদপুরে আট দিনব্যাপী ‘উদ্যমী নারী এসএমই মেলা’য় ৩০ নারী উদ্যোক্তা অংশ নেয়। এই নারী উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, বিকাশ, এসএমই, পিকেএসএফ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানও মেলায় অংশ নেয়। উদ্দেশ্য তাদের অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করা।

এ প্রসঙ্গে মনিরা আক্তার জানান, এ নারী উদ্যোক্তাসহ আরও নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বাড়াতে উন্নতমানের প্রশিক্ষণ প্রদানের পরিকল্পনা রয়েছে। এই নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত ও তৈরিকৃত পণ্য বাজারজাতকরণের উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে।

মনিরা আক্তার বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন। ‘নন্দিত জীবনের সন্ধানে’ গ্রন্থটি আদিবাসী ও নারীদের নিয়ে লেখা তার একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো এই প্রবন্ধ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।

Share