গত ১৮ ডিসেম্বর রাত ৭টা ৫০ মিনিটে উত্তর ইচলী মিয়াজী বাড়িতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক আহবায়ক আবদুল মান্নান মিজি দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর হঠাৎ মারা যান।
শনিবার চাঁদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য (সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ডা. দীপু মনি এমপি জানাজার নামাজের পর তার বাড়িতে যান। তিনি শোকাহত পরিবারকে সমবেদনা জানান। এ সময় তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান মিয়াজীর মৃত্যুতে চাঁদপুরবাসী একজন অভিভাবক হারালো। তিনি বেঁচে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের আরো সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে পারতেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস নিয়ে প্রতিবাদ করতেন। এছাড়া যুদ্ধকালীন সময়ের অজানা ইতিহাস নব প্রজন্মকে জানাতে পারতেন।
মুক্তিযোদ্ধা মান্নান মিজির মৃত্যুর পূর্বে বলে যাওয়া শেষ কথা
দেশকে শত্রুমুক্ত করতে ওই নরপশু পাকসেনাদের রুখতে সেদিন নিজের জীবন বাজি রেখে আমরা কয়েকজন রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। সেদিন সংকল্প ও প্রত্যয় একটাই ছিলো দেশ স্বাধীন করবো। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছর অতিবাহিত হলেও নব প্রজন্ম এখনও অনেক ইতিহাস জানা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। ইতিহাস বিকৃতিকারীরা নব প্রজন্মকে ভুল তথ্য প্রদান করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিতর্কিত করে তুলছে।
এ কথাগুলো রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক আহবায়ক আঃ মান্নান মিজি মৃত্যুর ৩ দিন পূর্বে ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে সাংবাদিকদের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, চাঁদপুরে ১৯৭১-এর যুদ্ধকালীন সময়ে আগস্টের শেষের দিকে বালিয়া ইউনিয়নের ইচলী ফেরীঘাট দিয়ে ফেরী যোগে ফরিদগঞ্জে ঢুকতে পাকবাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। মুক্তিযুদ্ধকালীন সংগঠক অ্যাড. সিরাজুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জাবেদ ও আঃ মমিন খান মাখন এ খবর জানতে পেরে বীর মুক্তিযোদ্ধা আঃ মান্নান মিজি ও মুক্তিযোদ্ধা রফিকউল্লাহকে পাকসেনারা যেনো ফরিদগঞ্জে ঢুকতে না পারে সে জন্য ইচলীর ফেরীটিকে ডুবিয়ে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশ পাওয়া মাত্র আঃ মান্নান মিজি ও শহীদ জাবেদের ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা রফিক উল্লাহর নেতৃত্বে সেদিন আরো ৬ জন মিলে রাতেই ফেরীটিকে ডুবিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ফেরী ডুবানোর জন্যে সে সময় কোনো অস্ত্র ছিলো না। তাই রফিকউল্লাহ অস্ত্রের জন্যে অ্যাড. সিরাজুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করে। তিনি রফিককে ২টি গ্রেনেড দেন। এ সামান্য ২টি গ্রেনেড নিয়ে এতো বিশাল ফেরী ডুবানোর জন্য প্রস্তুতি নিলো তারা। রাত ১০ টায় উত্তর ইচলী মিয়াজি বাড়ি সামনে থেকে ২টি নৌকা যোগে রফিকউল্লাহ সহ এলাকার ৬ যুবককে সাথে নিয়ে সতর্ক অবস্থায় ইচলী ঘাটে নোঙ্গর করা ফেরীটিতে উঠে। ফেরীর ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা ২ রাজাকারকে ধরে তাদের বেধে নৌকায় ওঠানো হয়। এসময় তাদের সাথে থাকা ২টি থ্রি-নট রাইফেল ছিনিয়ে নেওয়া হয়। পরে লগী দিয়ে ধাক্কিয়ে ফেরীটি ১ হাজার গজ পশ্চিমে নিয়ে আসা হয়। তার পর হ্যান্ড ড্রিল দিয়ে ছিদ্র করতে ব্যর্থ হয়ে গ্রাম থেকে বালতি জোগাড় করে ফেরীর ভেতরে পানিভর্তি করে দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টার চেষ্টার পর অবশেষে ফেরিটি ডুবাতে সক্ষম হই। ফেরী ডুবানোর খবর পেয়ে পাকসেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে পরদিন বিকেল ৩ টায় প্রায় ১শ’ পাক সেনা ও রাজারাকার মিলে ইচলী গুদারাঘাট হইতে কলমদর গাজীর বাড়ি পর্যন্ত দু’পাশের শতাধিক বাড়ি-ঘর ও বিভিন্ন স্থাপনা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।
তিনি শেষে বলেন, এ ধরনের বহু ইতিহাস রয়েছে যা বর্তমান নব প্রজন্ম আজো জানে না। তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে।
আশিক বিন রহিম, চীফ করেসপন্ডেন্ট
|| আপডেট: ০৫:৪৫ পিএম, ২০ ডিসেম্বর ২০১৫, রোববার
এমআরআর