বিশেষ সংবাদ

যে নারীকে ‘জীবন্ত বোমা’ আখ্যা দিয়েছেন চিকিৎসকরা

ইমান আহমেদ। মিশরের এক নারীর নাম। তাকে চিকিৎসকরা আখ্যায়িত করেছেন জীবন্ত বোমা হিসেবে। তারা বলেছেন, যেকোনো সময় বোমার মতো বিস্ফোরিত হয়ে শেষ হয়ে যেতে পারে তার জীবন।

এর কারণ ইমান আহমেদের ওজন ১১০২ পাউন্ড বা ৫০০ কেজি। কৈশোর থেকে যৌবন কোনো কালেই তিনি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন নি। ৩৬ বছর ধরে মুটিয়ে যাওয়ার কারণে ঘরের ভিতর বন্দি।

গত দু’দশকের বেশি সময় ধরে তিনি নিজের বেডরুম থেকে বের হয়েছেন এমনটা মনেই করতে পারছেন না তার পরিবারের সদস্যরা। ইমান আহমেদ চলাচলে অক্ষম। কথা পর্যন্ত বলতে পারেন না এখন। তাই দিনরাত তাকে বেডরুমেই বন্দি হয়ে কাটাতে হয়।

তাকিয়ে থাকেন উপরে সিলিংয়ের দিকে। এর বাইরে তার দুনিয়া বলতে কিছু নেই। তাকে নিয়ে ছোটবোন শায়মা আহমেদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছিলেন।

সেদিকে চোখ পড়ে মুম্বই ভিত্তিক চিকিৎসক, সার্জন মুফাজ্জল লাখদাওয়ালার। তিনি এখন ইমানকে ভারতে এনে অপারেশন করে তার ওপর দুই অংকে নামিয়ে আনতে চান। এ জন্য তিনি তহবিল সংগ্রহ করছেন।

এ খবর দিয়েছে অনলাইন সিএনএন।

এতে বলা হয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে মিশরের এই ইমান আহমেদই সম্ভবত বিশ্বে বর্তমান সবচেয়ে বেশি ওজনওয়ালা নারী। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বর্তমানে জীবন্ত সবচেয়ে বেশি ওজনের নারীর নাম যুক্তরাষ্ট্রের পলিন পটার। তার ওজন ২৯১.৬ কেজি।

ইমান আহমেদের ছোট বোট শায়মা আহমেদ এখন বোন ইমানের দেখাশোনা করেন। তিনি বলেন, অন্য মানুষ যেভাবে জীবনযাপন করে ইমান তা পারে না। সে তার কৈশোর ও যৌবন বলতে কিছু ভোগ করতে পারিনি।

দু’বছর আগে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন ইমান। এরপর থেকে তিনি বাকশক্তি ও চলাচলের শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। তাই শেষ কয়েকটি বছর ভীষণ জটিল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন ইমান।

এখন ডা. মুফাজ্জল বলছেন, ইমান তার জীবনের সঙ্গে প্রতিটি দিন লড়াই করছেন। এভাবে তিনি কতদিন বেঁচে থাকতে পারবেন তা কেউ জানে না। বর্তমানে তিনি একটি জীবন্ত বোমার মতো। যেকোনো সময় তা বিস্ফোরিত হয়ে শেষ হয়ে যেতে পারে।

ইমানের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তিনি যখন শিশু তখন তার থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দেয়। সেই থেকে তিনি ভুগছেন। জন্মের সময় তার ওজন ছিল ৫ কেজি। ১১ বছর বয়সের সময় তার ওজন বাড়া শুরু করে।

৫ম গ্রেডে পড়ার সময় থাইরয়েড সমস্যায় তা চলাচল আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে পড়ে। তিনি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন। তার ওজন এতটাই বেড়ে যায় যে তা তার পা বহন করতে পারছিল না। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে সরে যেতে তাকে হাঁটুর ওপর ভর করে চলতে হতো।

তার মাপে কোনো হুইল চেয়ারও পাওয়া যাচ্ছিল না। এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ইমান ধৈর্য্যহারা হন নি। তিনি সব সময় থাকতেন হাসিখুশি।

একদিন তার ওজন কমবে, তিনি হাঁটতে পারবেন। সব সময় এমন আশা করতেন। কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। হঠাৎ তার ওজন প্রায় ৩০০ কেজিতে পৌঁছায়। ফলে খাবার নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন। কিন্তু বেড়ে যায় কোলেস্টেরল।

আস্তে আস্তে অচল হয়ে পড়তে থাকেন ইমান আহমেদ। তার এমআরআই করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কিন্তু তার সাইজের কোনো এমআরআই ল্যাব পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত যখন বহু কষ্টে তার এমআরআই করানো হলো দেখা গেলো তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন আগেই।

এ সময় থেকেই তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। স্ট্রোকের কারণে তার চলাচল ও কথা বলার শক্তি একেবারে হারিয়ে যায়। এ সময় কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়ে তার পরিবার। তারা তার সেবা দিতে থাকে ধৈর্য্যরে সঙ্গে।

কিন্তু তার ওজন কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসে না। এক পর্যায়ে ওজন ১০০০ পাউন্ড অতিক্রম করে। পারিবারিক চিকিৎসকরা এর কারণ নির্ণয়ে ব্যর্থ হলেন। কিন্তু ভারতে তার অপারেশনের যে উদ্যোগ ডা. মুফাজ্জল নিয়েছেন তাতে পরিবারের সদস্যরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন।

কিন্তু এক্ষেত্রেও বাধা। ভারতে ভিসার জন্য আবেদন করা হলো। ইমান আহমেদ সশরীরে ভারতীয় দূতাবাসে হাজির হতে না পারায় ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলো।

এ পর্যায়ে ডা. মুফাজ্জল দূতাবাসে একটি চিঠি লিখলেন। তাতে তিনি বললেন, ইমান আহমেদ চলাচলে অসমর্থ। তিনি দু’দশকের বেশি রুমের বাইরে যেতে পারেন নি। তাই এ বিষয়টি যেন পুনরায় বিবেচনা করা হয়। দূতাবাস থেকে তারপরও বলা হলো এভাবে ভিসা দেয়া অসম্ভব।

কিন্তু হাল ছাড়লেন না ডা. মুফাজ্জল। তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে টুইট করলেন।

তাতে তিনি বললেন, আমার সামনে আর কোনো অপশন নেই। সাড়া দিলেন সুষমা স্বরাজ। এতে বিস্মিত হলেন ডা. মুফাজ্জল। দু’ঘন্টার মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মানবিকতার কারণে ভিসা দিতে সদয় সম্মতি দিলেন।

এতে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন ডা. মুফাজ্জল। এখন কিভাবে ইমান আহমেদকে ভারতে আনা হবে তা নিয়ে তিনি পড়লেন আরেক ঝামেলায়।

কারণ, ইমানের সাইজের একজন মানুষকে বহন করার মতো বিমান পাওয়া দুষ্কর। ডা. মুফাজ্জল বলেন, এয়ার এম্বুলেন্সে সাধারণত বড় প্রবেশ পথ থাকে।

কারণ, তাতে স্ট্রেচার ঢুকাতে হয়। কিন্তু ইমান আহমেদকে ঢোকানোর জন্য সেই প্রবেশ পথ বা দরজা পর্যাপ্ত নয়। এ জন্য তিনি বিভিন্ন বিমান সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেন।

যেহেতু ইমান আহমেদ বিমানের কোনো সিটে বসতে পারবেন না, তাই তাকে ভারতে আনতে হলে বিমানের ভিতরে শোয়ায়ে আনতে হবে। এ নিয়ে আলোচনা চলছে।

কিন্তু ইমান আহমেদ মিশরের মুসলিম রক্ষণশীল সমাজের। তাকে বিমানে উঠানো নামানো নিয়ে আরেক ঝামেলা।

কারণ, তাকে উঠানো নামানো করাবেন পুরুষরা। এতে তিনি বা তার পরিবার অস্বস্তি বোধ করতে পারেন। তাই এখন চেষ্টা করা হচ্ছে, এ কাজে সব সদস্য যেন নারী হন এমন একটি টিম।

ডা. মুফাজ্জল বলেছেন, ইমান আহমেদ যখন ভারতে পৌঁছবেন তখন তার অপারেশন থিয়েটারে শুধু একজন পুরুষ হিসেবে তিনি থাকবেন। যেহেতু ইমানের অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ তাই তারা এ বিষয়ে সব ধরনের পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন করবেন।

যদি অপারেশন সফল হয় তাহলে ইমান আহমেদকে কয়েক মাস থাকতে হবে মুম্বইতে। ওদিকে গত বুধবার প্রয়োজনীয় ভিসা সংগ্রহ করেছেন ইমান আহমেদের বোন শায়মা আহমেদ।

তিনি বলেছেন, বোনের জীবন সুন্দর হবে এমন আশাই এখন করছেন তারা।

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০২ : ০০ এএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬, শুক্রবার
ডিএইচ

Share