তাঁর পুরো নাম মো.শহীদুল্লা জাবেদ। শিল্পপতি পিতা হয়তো চেয়েছিলেন, তাঁর মেধাবী সন্তানটি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বড় কোনো আইনজীবী অথবা অফিসার হবেন। তাই ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করতে ভর্তি করিয়েছেন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে অধ্যয়নকালে ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে মো শহীদুল্লা জাবেদ ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পান। ছিলেন, একজন তুখোর ফুটবল খেলোয়াড়। হয়তো নিজেকে নিয়ে তাঁর আরো অনেক স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম লেখা হলো একজন মৃত্যুঞ্জয়ী বীরসেনানী হিসেবে।
বলছিলাম, মহান মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুর শহরের প্রথম শহীদ যোদ্ধা শহীদুল্লাহ জাবেদ এর কথা। স্বাধীনতার রণাঙ্গনে চাঁদপুরের প্রথম শহীদ হিসেবে যাঁর নাম লেখা থাকবে মহান মুক্তিযুদ্ধ তথা এই জেলার ইতিহাসের পাতায়।
শহীদ জাবেদ ১৯৪৬ সালের ৩ জানুয়ারি চাঁদপুর জেলা শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা চাঁদপুরের বিশিষ্ট শিল্পপতি আলহাজ হেদায়েত উল্যা এবং মাতা আলহাজ জুলেখা খাতুন। সাত ভাই পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ও এলএলবি সম্পন্ন করেন তিনি।
তখন সময়টা ১৯৭১ সাল। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক পূর্ব বাংলার নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালি জাতির হৃদয়ে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ উঁকি দিচ্ছে। যার স্বপ্নদ্রষ্টা হাজার মহান স্বাধীনতার রূপকার, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ডাক দেন। যে ডাকে সাড়া দিতে ভুল করে নি, এদেশের মুক্তিকামী আপমর জনতা। সেদিনের পর থেকেই নিজেদের একটি স্বাধীন মানচিত্র, পতাকা আর স্বতন্ত্র জাতিসত্তা বিনির্মাণে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের চুড়ান্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা।
বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুনে লাখো যুবকের মতো মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখান-সেদিনের ফুটবলার, আইনজীন অথবা রাজনীতিক হবার স্বপ্ন দেখা সাহসী তাগড়া যুবক মো.শহীদুল্লাহ জাবেদ। ভারতের দেরাদুন থেকে সর্বোচ্চ সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যোগদেন নিজের মাতৃভূমি চাঁদপুর জেলা বিএলএফ কমান্ডার হিসেবে।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের তথ্য বাতায়নসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে চাঁদপুর ২নং সেক্টরের অধীনে ছিল। ২৮ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত চাঁদপুর শত্রুমুক্ত থাকে। ৭ এপ্রিল সকাল ৯টায় হানাদার বাহিনী চাঁদপুর পুরানবাজারে দুটি বিমান থেকে সেলিংয়ের মাধ্যমে প্রথম হামলা করে।
৮ এপ্রিল বিকালে প্রায় পাঁচশত হানাদার বাহিনী বোঝাই ৯৬টি যানের একটি বহর চাঁদপুরে প্রবেশ করে এবং ইসমাইল হোসেন ভলান্টিয়ার নামের একজন বহরের সামনে পড়ে গেলে তাকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর সারা দেশের ন্যায় চাঁদপুরেও ব্যপক অত্যাচার, হত্যা, নির্যাতন চালায় হায়নার দল। প্রাপ্ত তথ্যমতে চাঁদপুরে ৫৮টি স্থানে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর বুধবার ফরিদগঞ্জের টুবগী ব্রিজের নিচে বাংকার পরিদর্শনকালে ঘাতকের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন। পরের দিন ১৪ অক্টোবর চান্দ্রা ইমাম আলী হাই স্কুল মাঠে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন হানাদার বাহিনীর ভীতিকে উপেক্ষা করে লাখো জনতা শহীদ এই বীর সেনার জানাজায় অংশ নেয়। জানাজায় তাঁর পরিবারের মাঝে ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকউল্লা উপস্থিত ছিলেন। জানাজা শেষে সহযোদ্ধারা প্রথমে ফরিদগঞ্জ দক্ষিণ বালিথুবা গ্রামের সর্দার বাড়িতে সাময়িকভাবে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর মুক্ত হলে ২৭ ডিসেম্বর বালিথুবার কবর থেকে মৃতদেহ উত্তোলন করে লঞ্চযোগে চাঁদপুরে নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীতে চাঁদপুর সরকারি কলেজ মাঠে জানাজা শেষে শহরের (বর্তমান শহীদ জাবেদ সড়ক) পারিবারিক কবরস্থানে শহীদ জাবেদকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
এই সূর্যসন্তানকে সম্মান জানিয়ে সহযাদ্ধা আবুল হোসেন ঢালীর উদ্যোগে চাঁদপুর পৌরসভার অর্থায়নে শহরের রহমতপুর কলোনীতে প্রতিষ্ঠা করা হয় শহীদ জাবেদ পৌর উচ্চ বিদ্যালয়। এছাড়াও শহীদ জাবেদকে ভালোবেসে এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে সহযোদ্ধারা ফরিদগঞ্জ থানার বিরামপুরে শহীদ জাবেদ উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
সন্তানের কৃতিত্বে তাঁর রত্নগর্ভা মা জুলেখা খাতুনকে দিয়ে চাঁদপুরে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার প্রথম উদ্বোধন করানো হয়। এছাড়াও চাঁদপুরের বিভিন্ন সংগঠন থেকে শহীদ জাবেদকে মরণোত্তর সম্মাননা দেয়া হয়।
লেখক : আশিক বিন রহিম,সাহিত্য ও সংবাদকর্মী,সাধারণ সম্পাদক:সাহিত্য মঞ্চ,চাঁদপুর। ১২ অক্টোবর ২০২০