নদীবিদৌত জেলা ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর। এখানকার পদ্মা-মেঘনা আর ডাকাতিয়া এ তিনটি নদীর সংঘমস্থলকে বলা হয় ‘ত্রিনদীর মোহনা’। যাকে কেন্দ্র করে এর তীরে গড়ে উঠেছে জেলার একমাত্র পর্যটন এলাকা। এখানকার নির্মল বাতাস আর নদীতীরে আছড়ে পড়া ডেউয়ের গর্জন যে কোনো ভ্রমণপিপাসু মানুষের মনে অন্যকরম দোলা দেয়। ফলে দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসুদের কাছে খুবই পরিচিত এই স্থানটি। তবে প্রতিটি সুন্দরের আড়ালে কোনো না কোনো ক্ষত লুকিয়ে থাকার মতোই চাঁদপুরের এই ‘ত্রিনদীর মোহনার’ আড়ালে লুকিয়ে আছে রহস্যময় এক ভয়ঙ্কর মৃত্যুকুপ।
যা কখনো কখনো সুন্দরপ্রিয় দর্শনাথীদের চোখে ধরা দেয় না। অথচ শত বছর ধরে এখানে পড়েই যাত্রীবাহি লঞ্চ, কার্গো, ট্রলারসহ নিখোঁজ হয়েছে হাজারো মানুষ। ভয়ঙ্কর ওই ঘূর্ণিপাকের এই মৃত্যুকুপে তলিয়ে কোন কিছুরই আর হদিস মেলে না। তবে বছরের বারো মাস এখানে ঘূর্ণিস্রোতের ঘূণিপাক থাকলেও বর্ষমৌসুমে এটি আরো বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তিন দিক থেকে তিনটি নদীর প্রবাহিত পানি একত্রিত হওয়ায় এই স্থানে ঘূর্ণিপাক এবং বিশাল এক ঘূর্ণিগর্তের সৃষ্টি হয়। এই ঘূর্নিগর্তটিই রহস্যময় মৃত্যুকুপ বা ট্রায়াঙ্গেল নামে পরিচিত। এখানে তলিয়ে যাওয়া নৌ-যান কিংবা যে কোনো কিছুরই আর হদিস পাওয়া যায় না। ফলে সরকারি ভাবেও চাঁদপুর নৌ-পথের এই স্থানটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবুও অনেক বাধ্য হয়েই এ স্থানটি পাড়ি দিয়েই প্রতিদিন পাশ্ববর্তি ৪০টি চরাঞ্চলের শত শত ট্রলার মালামাল ও যাত্রী নিয়ে পদ্মা-মেঘনা পাড়ি দিয়ে থাকে। ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা ট্রলারই এসব এলাকার যোগাযোগের একমাত্র বাহন হওয়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই মানুষজন জেলা সদরের সাথে যোগাযোগ রাখেন। আর এভাবে আসতে গিয়েই অনেকে ট্রলার ডুবিতে মৃত্যু বরণ করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বহুকাল থেকেই এই মৃত্যুকুপে নৌ-যান ডুবে ঘটনা ঘটতে শুরু হয়। এখান পর্যন্ত এই মৃত্যুকুপে এমভি শাহজালাল, মদিনা, দিনার ও নাসরিন-১ লঞ্চসহ অসংখ্য যাত্রীবাহি ট্রলার, মালবাহী নৌকা, কার্গো, জাহাজ তলিয়ে গেছে। বিগত সময়ের এইসব দূর্ঘটনায় হাজারো যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। তবে এরমধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে এমভি নাসরিন লঞ্চ। ২০০৩ সালের ৮ জুলাই ডুবে যাওয়া লঞ্চটির প্রায় ৯০ ভাগ যাত্রীই মারা যান। ১১০ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেলেও নিখোঁজ হয় ১৯৯ জন। আজো পর্যন্ত এখানে ডুবে যাওয়া কোনো লঞ্চের সন্ধান পায়নি বিআইডব্লিউটিএ।
স্থানীয়রা জানায়, ত্রিনদীর এই স্রোতের কারনে মোলহেডের প্রায় আধা কিলোমিটার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এখানে মাছের আড়ত,পাইলট হাইজ ও ২টি স্টিমারঘাট ছিলো, যা নদীর স্রোতে বিলীন হয়েছে। নদীতে তলিয়ে গেছে চাঁদপুরের সাবেক পুরাতন লঞ্চ ঘটটিও। দিন দিনে এখানে ঘূর্ণিস্রোত বেড়েই চলেছে। যার মূল কারণ, বিপরীত পাশে পদ্ম-মেঘনায় জেগে উঠা অসংখ্য ডুবো চর। ডুবচরগুলো খনন না করা করা পর্যন্ত এই স্থানে ঘূর্ণিস্রোতও কমবে না। এই স্রোতের ফলে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধও রয়েছে মারত্মক ঝুঁকির মধ্যে।
সনাক (টিআইবি) চাঁদপুর জেলা শাখার সভাপতি মোশারেফ হোসেন বলেন, চাঁদপুর তিন নদীর মোহনার এই স্থানটি প্রচ-রকম
ঝুঁকিপূর্ন হওয়ায় এখন থেকে বিকল্পস্থারে লঞ্চ ঘাট সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখানে ঘূর্ণিস্রোত ছোট নৌযানগুলো বেশি ঝুঁকিতে থাকে। যা বিপদজনক ভাবেই চলছে। এজন্যে যুতটুকু সম্ভব এই স্থানটি এড়িয়ে চলাই ভালো। তবে ঝূকিপূর্ন এরিয়াতে বয়া স্থাপন করে লাল সিগনাল দিয়ে রাখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
চাঁদপুর নদীবন্দর কর্মকর্তা বলেন, চাঁদপুর মোলহেডের এই সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। ছোট নৌ-যানগুলোকে এই স্থানটি এড়িয়ে চলার কথা বলা আছে। আর মালবাহী জাহাজ কর্তৃপক্ষকে পাইলট নিয়ে জাহাজ চালানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও এ স্থানের পাশ দিয়ে ফিটনেসহীন লঞ্চ ও জাহাজ চলাচল সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রতিবেদক:আশিক বিন রহিম,২৫ জুন ২০২০