জাতীয়

চাঁদপুরের ‘জেদী ডাক্তার’ মীমের বরখাস্তের কাহিনী ও অজানা কথা

চাঁদপুর টাইমস  নিউজ ডেস্ক | আপডেট: ০৮:২৯ অপরাহ্ণ, ০৪ আগস্ট ২০১৫, মঙ্গলবার

ডা. মীমে ক্ষুব্ধ সবাই : ঢামেকের আলোচিত চিকিৎসক নূনযীরুল মোহসেনীন মীমের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। বাবা ডা. নাজির হোসেন চৌধুরী ও মা সাজেদা চৌধুরীর ১১ সন্তানের মধ্যে মীম সবার ছোট। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর হলেও অনেক দিন ধরেই তারা ঢাকার আশুলিয়ায় থাকেন। মীমের বাবা ও ভাইয়েরা সবাই ফরিদপুরের আটরশি পীরের মুরিদ। তাদের অধিকাংশ সময় কাটে বনানীতে আটরশি হুজুরের খানকায়। শ্বশুর পরিবার জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। স্বামী ডা. সামিউর রহমান শিবুও কুষ্টিয়ায় জামায়াতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত।

২০০৭ সালে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর বিসিএস (স্বাস্থ্য) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ডা. মীম। চাকরিজীবনের প্রথম পোস্টিং হয় শ্বশুরবাড়ি কুষ্টিয়ায়। শ্বশুরের বাসা কুষ্টিয়া শহরের ১৮/১, মীর মশাররফ হোসেন সড়কে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেশীরা জানান, মীম অত্যন্ত বদ মেজাজী। কথায় কথায় শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন। পুত্রবধূ মীমের দুর্ব্যবহারের কারণে অল্প দিনের মধ্যেই শ্বশুর-শাশুড়ি বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন।

২৫০ শয্যা কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে মীমের ডিউটি পড়ত। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের মতোই হাসপাতালেও রোগী ও স্টাফদের সঙ্গেও চরম অসদাচরণ করতেন ডা. মীম। মীমের দুর্ব্যবহারে অল্প দিনের মধ্যেই রোগী এবং হাসপাতালের স্টাফরা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ওঠেন। অভিযোগ আসতে থাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছেও। ডা. মীমের কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও প্রায়ই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো।

সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের ৯ ও ১০নং (পুরুষ ও মহিলা) ওয়ার্ডে ডিউটি থাকলেও ডা. মীম বেশির ভাগ সময় ১০নং পুরুষ ওয়ার্ডে সময় কাটাতেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সিনিয়র নার্স ও পুরুষ ওয়ার্ডের এক আয়া জানান, কথায় কথায় রেগে যাওয়া ছিল ডা. মীমের স্বভাব। সেবা পেতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়তেন তিনি। পরে রোগী ও তাদের স্বজনদের শান্ত করতেন হাসপাতালের অন্য ডাক্তার ও স্টাফরা।

প্রায়ই ডা. মীম হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকতেন। বেশিরভাগ সময়ই কুষ্টিয়া শহরের কলেজ মোড়ে ন্যাশনাল ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল সার্ভিসেসে প্রাইভেট রোগী দেখতেন। এ প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার সজল জানান, ম্যাডাম এখানেও রোগীদের সঙ্গে কথায় কথায় খারাপ আচরণ করতেন। এক কথা একবারের বেশি দুবার জানতে চাইলেই রেগে যেতেন।

কুষ্টিয়াতে চাকারকালীন ডা. মীম বেশ কয়েকটি ভুল অপারেশনও করেছেন। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি কুষ্টিয়া এবং শ্বশুরের পরিবার প্রভাবশালী হওয়ার সুবাদে বারবার পার পেয়ে গেছেন। হাসপাতালসংলগ্ন টালিপাড়া এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী রুবেল জানান, পা ভেঙ্গে যাওয়ায় তিনি কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে ভর্তি হন। ডা. মীম তার সঙ্গেও চরম দুর্ব্যবহার করেন।

কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আজিজুন নাহার জানান, ডা. মীমের মধ্যে সব সময় ইগো প্রবলেম কাজ করত। চিকিৎসা সেবা যে নবেল প্রফেশন তা তিনি ভুলে গেছেন। ডা. আজিজুন নাহার আরও জানান, আমাদের দেশে মেডিকেলে পড়াশোনার সময় রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে একজন চিকিৎসকের কি ধরনের আচরণ করা উচিত তা সেখানো হয় না। মেডিকেল থেকে পাস করে সরকারি ডাক্তার হিসেবে চাকরি পেয়ে তার ভেতর সব সময় হাম বড়া ভাব কাজ করে। তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেন।

ডা. মীম ও তার স্বামী ডিউটি ফাঁকি দিয়ে কুষ্টিয়ায় গিয়ে রোগী দেখেন। তারা কুষ্টিয়ায় জামায়াতে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ও জামায়াতের অর্থদাতা। তারা ঢাকায় স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের নাম ভাঙিয়ে ঢামেক হাসপাতালে পোস্টিং নিয়েছে। এখন ধরাকে সরা জ্ঞান করে সাধারণ রোগী ও মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ডা. মীমের সনদ বাতিল ও তাকে বরখাস্তের দাবি জানান তারা।

অবশেষে মুখ খুলে তেজোদীপ্ত ভাষায় যা বললেন সেই ডাক্তার মীম

ড. মীমের বিরুদ্ধে প্রকাশিত সংবাদের জন্য দৈনিক যুগান্তর আর যমুনা টেলিভিশনকে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ক্ষমা প্রার্থনায় ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়ার পর সোমবার সংবাদমাধ্যমের জন্য একটি ব্যকিক্তগত জবানবন্দী পাঠিয়েছেন ডাক্তার নুনযীরুল মুহসেনীন মীম নিজেই। ব্যাখ্যা করেছেন নিজের অবস্থান। ডা. মীমের সেই জবানবন্দী পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।

ডা. নুনযীরুল মুহসেনীন মীম

আমি আক্রান্ত হয়েছি। একজন বীর মু্ক্তিযোদ্ধার সন্তান আক্রান্ত হয়েছে। একজন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছে; কার দ্বারা; একজন জনপ্রতিনিধি দ্বারা। তিনি অতীতে কী ছিলেন, এমনকি রাষ্ট্র চালিয়েছেন, প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, ফলে তিনি অনেক ক্ষমতা অর্জন করেছেন। এমন একজন সাংসদ বা জনপ্রতিনিধির দ্বারা আমি আক্রান্ত হয়েছি।

এর কারণ হচ্ছে আমি আমার হাসপাতালে অফিস কক্ষে অসংখ্য অসহায় আর্তনাদকারী রোগীদের সেবা দিচ্ছিলাম। তাদেরকে নিয়ে যখন আমি দৈনন্দিন রুটিন ওয়ার্ক করছিলাম তাদের নিয়ে তখন তিনি আসলেন। সেখানে তাকে বসতে দেয়ার মত জায়গাও ছিল না, তিনি আসলেন তাঁর গুণ্ডাপাণ্ডার মত চেহারার একদল লোক নিয়ে; হয়তো বা তার দেহরক্ষী তারা এবং আরও তার এলাকার লোকজনের একটা মিছিল নিয়ে তিনি আসলেন এবং আমি হতবাক হয়ে গেলাম যে, এই লোকগুলি কারা; কে? আমি এই জনপ্রতিনিধিকে কখনও দেখিনি। বাস্তবে তার চেহারাও আমি জানি না, আমি তখন তার দেহরক্ষীদের বললাম যে আপনারা এখানে কেন এসেছেন? কি করছেন? আপনারা প্লিজ দয়া করে হাসপাতালের ডিরেক্টর স্যার এর রুমে বসেন, ওই সময় ডিরেক্টর স্যার হাসপাতালে অবস্থান করছিলেন।

আমার অপরাধ যে, আমি সেই জনপ্রতিনিধিকে কেন চিনলাম না! কেন তাকে কুর্নিশ করলাম না! তার পদপ্রান্তে ডাক্তার হিসেবে নিজের Dignity নিজের অস্তিত্ব এবং নিজের কর্তব্যবোধকে তার ইচ্ছার কাছে সমপর্ণ করলাম না।

এই হল আমার অপরাধ, সুতরাং আমি এই অপরাধের জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তিত নই, বা আমি এই অপরাধ করেই যাব। আমি এই অপরাধ করতেই থাকব। আর্ত মানবতা আমার কাছে প্রথম। আমি উদাহরণ দিতে পারি যে, ব্রিটেন এক হাসপাতালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন ঢুকে পড়েছিলেন বিনা অনুমতিতে, ডাক্তার তাকে তৎক্ষনাত বের করে দিয়ে বলেছিলেন যে, “আমি রোগীদের সেবা দিচ্ছি, আপনি বিনা অনুমতিতে এখানে ঢুকেছেন কেন? আপনি বেরিয়ে যান”, তাতে উনি অনুতপ্ত হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আন্দোলিত হয়নি। ব্রিটিশ জনগণ মোটেই তাতে- যেরকম এখানে কুৎসিত মন্তব্য করা হচ্ছে- সে রকম কোনো মন্তব্য করেননি। বরঞ্চ সেটাই ব্রিটিশ সভ্য সমাজের জন্য একটি স্বাভাবিক ঘটনা। বরঞ্চ সেটাই একজন কর্তব্যরত ডাক্তারের কাছে ব্রিটিশ সভ্য সমাজের দাবী। এটাই rules. This is rules of business.

সুতরাং এ আমার অপরাধ, আমি কেন তার পদলেহন করলাম না। আমি কোন দিন এই রকম কোন জনপ্রতিনিধি চাই না এবং তাদের পদলেহনের কোন আশাও আমার দ্বারা পূর্ণ হবে না। সুতরাং এই অপরাধ চলতেই থাকবে।

যেভাবে ঘটনার শুরু
রোজ মঙ্গলবার, ২৮শে জুলাই, দুপুর আনুমানিক ৩.৩০ ঘটিকায়
স্থান: ইমার্জেন্সি কক্ষ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটাল।

আমি আমার ইমার্জেন্সি রুমে ১০-১৫ জন অসহায় আর্তনাদকারী রোগীর সেবা প্রদান করছিলাম। এমতাবস্থায় হঠাৎ করেই ৮-১০ জন ব্যক্তি ইমার্জেন্সি রুমে প্রবেশ করেন এবং ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসারদের চেয়ারে বসে পড়েন। উনারা রুমে ঢুকে নিজেদের কোন পরিচয়ই প্রকাশ করেননি। ক্রমাগত অসুস্থ রোগীদের ভীড় বাড়তেই থাকে, ফলে রোগীদের সেবাদান ব্যহত হওয়ায় আমি তার একজন দেহরক্ষীকে বললাম “ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক স্যার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মিজানুর রহমান হাসপাতালে আছেন। স্যারের রুমে বসার সুব্যবস্থা আছে। উনি একজন সম্মানীয় ব্যক্তি, উনাকে স্যারের রুমে নিয়ে বসান।”

এতেই, উনার দেহরক্ষীরা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। জনাবা জনপ্রতিনিধির সাথে আমার সরাসরি কোনো বাক্যালাপ হয়নি। তৎক্ষণাৎ প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে আমার উপর তেড়ে আসেন ও আমার নাম জিজ্ঞেস করেন। আমাকে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করা শুরু করেন। শুধু তাই নয় তারা আমাকে তুলে নেয়ার হুমকি দেয়। ঠিক এমনি এক সময় ডিরেক্টর স্যার ঘটনাস্থলে আসেন এবং আমার কাছ থেকে পুরো ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হন, এরপর তিনি ওই জনপ্রতিনিধির সাথে কথা বলেন।

হলুদ সাংবাদিকতা অসভ্য ছোবল
এরপর থেকেই শুরু হয়ে যায় আমার প্রতি লাগামহীন হলুদ সাংবাদিকতার ছোবল। যমুনা গ্রুপ তার অধীনস্থ যুগান্তর পত্রিকায় ও যমুনা টিভির মাধ্যমে আমার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবন তছনছ করার চেষ্টা করে চলেছে। তারা আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে পুরোপুরি ভুয়া, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কাব্য রচনা করে আমার চরিত্র হনন ও পেশাগত জীবনের সাফল্যকে ম্লান করার কুপ্রচেষ্টায় তাদের নিজস্ব সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করছেন।

আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশে এখনও সৎ সাংবাদিকতা এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠান আছে। আমার সাংবাদিক ভাইদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি- আপনারা সত্য উদঘাটন করুন, প্রচার করুন। এতে করে আমার যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে সেজন্য ক্ষমা চাইতেও আমার কোনো দ্বিধা নেই।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত রোগীদের অভিযোগ
ঢাকা মেডিকেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও সরকারী হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসারের রুমে উনাদের উপস্থিতিতে একদিকে যেমন চিকিৎসকের সেবাদান ব্যাহত হচ্ছিল, অন্যদিকে রোগী ও তার স্বজনেরা অভিযোগ করছিল। “ডাক্তার আপা ওদের দিকে নজর দিয়েন না ওরা ক্ষমতা ও টাকার জোরে এমনি করে থাকে। আপনি আমাদের দিকে নজর দেন, আমাদের সমস্যা সমাধান করেন”।

কি আমার অপরাধ
আমি তাদেরকে বলেছি আমি আপনাদের কী সহযোগিতা করতে পারি? কিন্তু তারা আমার প্রশ্নের জবাব তো দেয়ইনি উল্টো আমার প্রতি অশ্রাব্য গালি গালাজ শুরু করেছিল। সরকারি হাসপাতালে ইমার্জেন্সি কক্ষে একজন কর্তব্যরত ডাক্তার হিসেবে আমি যা বলেছি, যা করেছি এর চেয়ে আর কি করতে পারতাম?

ডা. নুনযীরুল মুহসেনীন মীম: ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

 

চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/এমআরআর/২০১৫

Share