চাঁদপুরে শান্তি ও স্বপ্নকে চোখ রাঙাচ্ছে কিশোর গ্যাং

ভাষা আন্দোলন থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, সমাজকর্ম, পেশাজীবি কিংবা শিল্প-সাংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে এ দেশের অন্যতম আলোকিত জেলার নাম নদীবিধৌত ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর। কারণ উল্লেখিত প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ আবদান রেখেছেন চাঁদপুরের অসংখ্য সুর্যসন্তান। পূর্বপুরুষদের সোনালী পথ ধরে বর্তমানেও চাঁদপুরের অসংখ্য কৃতিসন্তানের জীবন ও কর্মের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশ তথা বিশ্বভুখণ্ডে। এছাড়া শান্তি ও সম্প্রীতির জেলা হিসেবেও চাঁদপুরের সুনাম রয়েছে সমগ্র দেশে। অথচ এমন আলোকিত জেলায় গত দুই দশক ধরে আঁধার ঢেলে দিচ্ছে মাদকের নগ্ন ছায়া।

মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের হিসেবে আগের বছরের তুলনায় গতবছর চাঁদপুরে মাদক উদ্ধার এবং আটক কয়েকগুণ বেড়েছে। এতে প্রমানিত হয়, এখানে মাদক ব্যবহার আগের চেয়ে বেড়েছে। এবার চাঁদপুরের শান্তি ও ভবিষৎ স্বপ্নকে চোখ রাঙানী দিচ্ছে অপ্রত্যাশিত কিশোর গ্যাং। যাদের কাঁধে ভর করে আগামী চাঁদপুরের সুখ্যাতিকে এগিয়ে নেবার স্বপ্ন দেখছে এ জেলার অভিভাবক-শিক্ষক ও সুধিমহল, সেই কিশোর তুর্কিদের বড় একটি অংশ ধাবিত হচ্ছে ‘কিশোর গ্যাং’ নামের নষ্ট পথে। প্রশাসনের কঠোর অবস্থানও কিশোর গ্যাংদের আধিপত্য রোধ করতে পারছে না। উল্টো যতই দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা এবং তাদের তৎপরতা। বর্তমানে চাঁদপুর শহর এবং উপজেলা শহরের প্রতিটি এলাকাতেই একাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতায় উদ্বিগ্ন আর আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে স্কুল-কলেজ পড়ৃয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবক মহলে।

সর্বশেষ গত ২৯ মার্চ বুধবার চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের নিহতের মৃতদেহ ছিনিয়ে নিতে তাণ্ডব চালায় একদল কিশোর গ্যাং। তারা বিদ্যুৎস্পৃষ্টে নিহত দুই বন্ধুর লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই ছিনিয়ে নিতে হাসপাতালের ৫ স্টাফকে পিটিয়ে আহত করে। তাদের এমন তাণ্ডবে আবক হন, হাসপাতালের টিকিৎসক এবং নিহতের পরিবারের শোকাহত স্বজনরাও। পরে চাঁদপুর মডেল থানা পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এর আগে ২৬ মার্চ রাতে তারাবি নামাজের সময়ে চাঁদপুর শহরের মিশনরোড রেলক্রসিং এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় পুলিশ প্রথম দিনই ২জনকে আটক করে। এরপর ২৭ মার্চ বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে পৃথক অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের ১৫ সদস্যকে আটক করেছে মডেল থানা পুলিশ। তবে ২৮ মার্চ দুপুরে আটককৃতদের মুচলেকা রেখে অভিভাবকদের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। গত ২১ মার্চ একদল কিশোর গ্যাং চাঁদুপর শহরের প্রাণকেন্দ্র রেলওয়ে হকার্স মার্কেটের মডার্ন সুজ নামের দোকানে প্রবেশ করে দোকানির গলায় ছুরিকাঘাত করে। তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে পারভেজ নামের ওই দোকানীর গলার বিশাল অংশ কেটে ফেলে। আহত পারভেজ বর্তমানে চিকিৎসাধিন অবস্থায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। এছাড়া গত ২৫ জানুয়ারি কিশোর গ্যাংয়ের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে রক্তাক্ত জখম হয় কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান (১৮)। মেহেদি চাঁদপুর শহরের টেকনিক্যাল মাদ্রাসা রোড় এলাকার খান বাড়ি শাহাদাত খানের পুত্র। সে হাজীগঞ্জ মডেল পাইলট স্কুল এন্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। ২৩ জানুয়ারি চাঁদপুর প্রেসক্লাবের পিছনের মাঠে খেলাধুলা করে বাড়ি ফেরার পথে নায়েব (১৯) নামে এক ছাত্রকে কুপিয়ো রক্তাক্ত করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ ঘটনায় চাঁদপুর মডেল থানার পুলিশ অভিযুক্তদের আটক করতে সক্ষম হয়। তবে আহতর পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা বা লিখিত অভিযোগ না করায় মুচলেখার মাধ্যমে তারা ছাড়া পেয়ে যায়।

এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁদপুর শহরের প্রতিটি পড়া-মহল্লায়, অলিগলিতে কিশোর গ্যাং আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা এক গ্রুপ অপর গ্রুপের সঙ্গে প্রকাশ্যে মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে। এছাড়া নিরীহ শিক্ষার্থীদের জিম্মি এবং গায়ে পড়ে হয়রানি ও মারধর করার ঘটনাও ঘটছে। এ কারণে স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিভাবকরা শঙ্কায় রয়েছেন। শহরের প্রেসক্লাবের পেছনে ডাকাতিয়া নদীর তীর, বড়স্টেশন মোহনা, হাসান আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের লেক ও আশপাশ, সিএনজি স্টেশন সংলগ্ন রেললাইন, মিশন রোড, স্টেড়িয়াম এলাকা, টেকনিক্যাল এলাকা, ওয়ারল্যাছ, চাঁদপুর-রায়পুর সেতু, পুরাণবাজারের রয়েজ রোড, লোহারপোল, রামদাসদী রোড, রগুনাথপুরসহ বেশ কিছু এলাকায় তাদের বিচরণ সবচেয়ে বেশি।

ভদ্রসমাজের হাঁটাচলা কিংবা অবসর যাপনের উন্মুক্ত স্থানগুলোতে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ফলে এসব স্থানে ভদ্রসমাজের সমাগম অনেকটাই কমে আসছে। এদিকে পুলিশী অভিযানে এসব কিশোর গ্যাং সদস্য আটক হলেও রাজনীতিক ততবির আর দরবার পার্টির মাধ্যমে তারা সহযেই ছাড়া পেয়ে যায়। পরে ওই দরবার পার্টির মধ্যস্থতায় অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে ঘটনাগুলো মামলাপর্যন্ত গড়ানোর আগেই সমাধান বা ধামাচাপা দেয়া হয়। তাছাড়া প্রতিটি এলাকায় কিশোর গ্যাংদের রাজনীতিক ‘বড় ভাইদের’ শেল্টার তো রয়েছেই। এসব কারণে পুলিশের তৎপরতা থাকলেও কিশোর গ্যাং দৌরাত্ম্য বন্ধ হচ্ছে না।

এ বিষয়ে চাঁদপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুর রশিদ চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ‘মাদক, ইভটিজিং, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মত কিশোর গ্যাংদের বিষয়েও পুলিশ জিরো ট্রলারেন্স নীতিতে রয়েছে। এসব অপরাধগুলো আমরা কঠোর অবস্থানে থেকে প্রতিরোধ করছি।’

তিনি আরো বলেন, কিশোর গ্যাং সদস্যদের মারামারির ঘটনার কয়েকজনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হলেও ভুক্তভোগীরা আইনগত ব্যবস্থা নিতে চায় না। ভুক্তভোগীরা আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ায় কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশকে নীরব ভূমিকা পালন করতে হয়। সচেতন মহলের দাবী কিশোর গ্যাংয়ের এই অপ্রত্যাশিত বিস্তার রোধে প্রশাসনের পাশাপাশি সমাজের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে অভিভাবক, রাজনীতিক নেতা এবং জনপ্রতিনিধিদের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। তা না হলে মাদকের মত কিশোর গ্যাংও আগামীতে চাঁদপুরের ভাগ্যাকাশে অন্ধকার ছড়াবে।

প্রতিবেদক: আশিক বিন রহিম, ৮ এপ্রিল ২০২৩

Share