চাঁদপুর

চাঁদপুরের অনেক যুবক বিদেশ যেতে ব্যর্থ হয়ে জড়াচ্ছেন মাদক ব্যবসায়

মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি ও চিরুণি অভিযান এসব যেনো এখন খুব পরিচিত শব্দ। গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত এই শব্দগুলি এতোটা ব্যবহার হচ্ছে এটি এখন সাধারণ জনগণের মাঝে অনেক পরিচিত হয়ে উঠেছে। তবে চাঁদপুরবাসীর নিকট এখনো পরিচিত হয়ে উঠেনি এ শব্দগুলির বাস্তব ব্যবহার ও মাদকমুক্ত চাঁদপুর।

মাদকের ভয়াল ছোবলে নির্জীব হতে চলেছে চাঁদপুরের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ প্রবাসী হওয়ার আশায় বেকার বসে থাকা চাঁদপুরের যুব সমাজ। হাতের নাগালে শহরের পাশাপাশি গ্রামের অলিগলি জুড়েই রয়েছে মাদকের চালান। দেড় শতাধিক মাদক বিক্রেতা চাঁদপুর মডেল থানার পুলিশি তালিকাভুক্ত রয়েছে। পুলিশ নামমাত্র দু-একজন সেবনকারীকে ধরলেও মাদক ব্যবসায়ীদের ধরছে না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।

সম্প্রতি কিছু মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়লেও আইনের ফাক-ফোকর দিয়ে জামিনে বেরিয়ে এসে পুনরায় শুরু করছে মাদক ব্যবসা।

এতে করে দেখা যায় এই ব্যক্তিকে বারবার মাদকের দায়ে গ্রেফতার হতে হচ্ছে। এতে করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও এক ধরনের অসন্তোষ প্রকাশ করছেন।

তাদের দাবি আদালতের মাধ্যমে জামিন পেয়ে মাদক ব্যবাসায়ীরা আবারো মাদক ব্যবসা শুরু করে দেয়। এদের অনেকেই আবার দীর্ঘদিন থেকে পাসপোর্ট করে বসে আছে মধ্যপ্রাচ্য পাড়ি জমানোর আশায়, আবার অনেকে বিদেশ পাড়ি দিয়ে সুবিধা করতে না পারায় দেশে এসে অনেকটা হতাশায় পড়ে জড়িয়ে পড়ছে মাদক নামক ভয়াল কালোগ্রাসের চোলাচালান চক্রের সাথে।

বিদেশ গমনে ইচ্ছুক ও বর্তমানে মাদক চোরাচালানে জড়িত এমন কয়েকজন যুবকের সাথে আলাপকালে জানা যায়, মাদক মামলা আটকা পড়লে মাসখানেক জেলে থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়া যায় তাই ঝুঁকি কম। এছাড়া বিদেশ যাওয়া সুযোগ আসলে মামলা রেখেই বিদেশে চলে যাওয়া যাবে। তখন আর পুলিশ ধরতে পারবে না। তাই তাদের অনেকেই অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত মনে করে মাদকে ঝড়িয়ে পড়ছে। এদের মধ্যে কেউ আবার মাদক ব্যবসায় অনেকটা লাভবান হয়ে যাওয়ায় বিদেশ যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে দিয়েছে।

বিদেশ যাওয়া হবে না কেনো জানতে চাইলে এদের একজন বাগাদী চৌরাস্তা এলাকার পাসপোর্টধারী প্রিন্স (ছদ্মনাম) জানায়, মামা চেয়েছিলো সিংগাপুর নিয়ে যাবে, মামার খরচ হবে ৫-৭ লাখ, মামাকে জানিয়ে দিয়েছি, ৫ থেকে ৭ লাখ লাগবে না, আমাকে ২ লাখ দিন, আমি দেশেই ব্যবসা করে সিংগাপুর থেকে বেশি টাকা আয় করতে পারবো।’

তার বক্তব্য শুনে জানতে চাওয়া হয়, মামাকে এ ব্যবসা সম্পর্কে কি বলা হয়েছে প্রশ্ন করতে প্রিন্স জানায়, মামাকে তো আর ড্রাগস (মাদক) -এর কথা জানানো যাবে না, জানিয়েছি মেডিসিন (ঔষুধ) ব্যবসা। পরিবারকেও একই কথা জানিয়েছি।

তাকে অনেকটা খুঁচিয়ে জানতে চাওয়া হয়, কখনো মাদক মামলায় ধরা পড়লে পরিবার বা মামাকে কি বলা হবে? এ প্রশ্ন করতেই উত্তর দিতে অনেকটা এড়িয়ে যায় প্রিন্স, অনেক চেষ্টার পর জানায়, তখন বলবো, মেডিসিনের মেয়াদ ছিলো না, তাই গ্রেফতার হয়েছি, অথবা বলবো মেডিসিনের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি একটা বুঝতো দেয়া যাবেই। এছাড়া আটক হলে তো আর পরিবার এসে আমাকে ছাড়াতে হবে না, বড় ভাই (মাদক ডিলার) আছেন, তিনিই সব খরচ বহন করবেন এবং জামিনে ছাড়িয়ে আনবেন।’

প্রতিবেদকের পরিচয় গোপন রেখে একাধিক মাদক ব্যবসায়ীর সাথে আলাপকালে চাঁদপুর সদরের বেশ কিছু মাদক পয়েন্টের তথ্য পাওয়া যায়। চাঁদপুর সদরের মাদক বেচাকেনার স্থানগুলো হচ্ছে পুরানবাজার এলাকার মধুসূদন স্কুল মাঠ, ভাওয়ালবাড়ি, মেম্বারবাড়ি, বৌবাজার, কোহিনূর সিনেমা হলের সামনে, মোম ফ্যাক্টরি, রিফিউজি ক্যাম্প, ৫নং খেয়াঘাট, বৌবাজার বাবুল গাজীর দোকান, দুধপট্টি, হরিসভা নদীরপাড়, রওনা গোয়াল, ওসমানিয়া মাদরাসার পেছনে, মধ্যশ্রীরামদী, ম্যারকাটিজ রোড, নতুন রাস্তা, লোহারপুল, পুরানবাজার কলেজ রোড, পুরানবাজার-নতুনবাজার ব্রিজ এলাকা, জুট মিল, রঘুনাথপুর, নতুনবাজার এলাকার বড় স্টেশন টিলাবাড়ি, ক্লাব রোড, কাঁচা কলোনি, জামতলা, বকুলতলা, কোড়ালিয়া, গুয়াখোলা, প্রফেসরপাড়া, মাঝিবাড়ি, তালতলা, মাদরাসা রোড, ব্যাংক কলোনি, নাজিরপাড়া, চক্ষু হাসপাতাল, রহমতপুর কলোনি, ট্রাক রোড, ওয়্যারলেস, মঠখোলা, বাবুরহাট ও ঢালীঘাট। ইউনিয়নে মাদক বেচাকেনার স্পট হিসেবে পরিচিত বাগাদী ইউনিয়নের চৌরাস্তা, নানুপুর, বালিয়া ইউনিয়ন, চান্দ্রা, হানারচর, রামপুর ইউনিয়নের মহামায়া, বিষ্ণুপুর, কল্যাণপুর, তরপুরচন্ডী।

এসব এলাকায় গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, প্যাথেড্রিন, মদসহ নানা ধরনের নেশাদ্রব্য বিক্রি করা হয়। এসব এলাকায় মাদক বেচাকেনা চলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। রাতে বিভিন্ন স্থান থেকে মোটরসাইকেলযোগে এসে মাদক ক্রেতারা বিভিন্ন এলাকায় যায়। তবে ইউনিয়ন ভিত্তিক এলাকাগুলোতে ইয়াবার ছড়াছড়ি অনেক বেশি।

অভিযোগ রয়েছে বাগাদী চৌরাস্তা বাজারের একাধিক দোকানে মাদক বিক্রি হয়। ওইসব এলাকার একাধিক মাদকসেবীর কাছে তারা সরাসরি এ তথ্য জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করে।

ইঙ্গিত হিসেবে তারা জানিয়েছে বাগাদী চৌরাস্তা বাজারের যেসব দোকানগুলো অনেক রাত কিংবা সারারাত খোলা থাকে ওইসব দোকনগুলোতে ইয়াবা পাওয়া সম্ভাবনা অনেকটা নিশ্চিত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, বর্তমানে মাদক বিক্রেতার একটি চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আমাদের সন্তানদের রাস্তা ঘাটে ছাড়া যাচ্ছে না।

তারা বলেন, পুরাণবাজার ফাঁড়িসহ বিভিন্ন থানার পুলিশের পক্ষে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটাই সম্ভব। কারণ কোথায় কারা মাদক বিক্রি করে তারা জানে। পুলিশের হাতে বেশিরভাগ সময়েই সেবনকারী ধরা পড়ে। আর এদেরকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেয়া হচ্ছে।

কিন্তু মাদক বিক্রেতা ও আমাদানিকারকরা অনেকটা ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এলাকার যুব সমাজকে মাদক ধরিয়ে দিয়ে একটি চক্র ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে আর উঠতি বয়সের তরুণদের বিপথগামী করে তুলছে। এসব যুবকদের অনেকেই প্রবাসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, কিন্তু অধিকাংশ দেশে ভিসা বন্ধ থাকায় যেতে পারছে না। নিরুপায় হয়ে অনেকেই এ পেশায় জড়িয়ে পড়ছে।

চাঁদপুর প্রশাসনের দাবি, মাদককে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়া হচ্ছে না, মাদকের দায় আটকৃতদের ব্যাপারে কোনো সুপারিশও গ্রহণ করা হচ্ছে না।, ডিবি (গোয়েন্দা পুলিশ) প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিটি সভাতেই ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।

মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে অভিভাবক ও সচেতনহলে দাবি, মাদক পরিবেশ সর্ব পর্যায়ে সৃষ্টি করতে ধর্মীয় সংস্কৃতিতে যুবসমাজকে পরিচালিত করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয়া শিক্ষার গুরুত্ব আরো বেশি বৃদ্ধি করতে হবে। এসবের পাশাপাশি দেশ ও জাতিকে মাদক মুক্ত করার দায়িত্ব সরকারের।

মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে সমাজের প্রতিটি মানুষ এগিয়ে না এলে উচ্চবিত্তরা মাদক ব্যবসা করে ধনকুবের হবে, আর মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণীর মাদকসেবী ও মাদক ক্রেতা হয়ে আঁধারে হারিয়ে যাবে। মেধাশূন্য হবে জাতি সংকটে পড়বে সুশীল ও সুষ্ঠধারার রাজনৈতিক নেতৃত্ব।

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।আপডেট : :১৪ পিএম, ১৭ জানুয়ারি ২০১৫, রোববার
ডিএইচ

Share