চাঁদপুর

চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হলেন জুড়ীর আলোচিত সেই ইউএনও

চাকরিতে যোগদানের পর থেকে নিজের দক্ষতা ও দূরদর্শিতা দিয়ে একের পর এক ভালো কাজ করেছেন তিনি। যার জন্য বিভিন্ন মহলে আলোচিত হয়ে তিনি ব্যাপক প্রশংসা কুঁড়িয়েছেন। নিজের সেরাটা নিংড়ে দিয়ে প্রশাসনের সকল দাপ্তরিক কাজের পাশাপাশি মানুষের তরে ছুটে চলেছেন বিরামহীনভাবে। প্রাণপণে চেষ্টা করছেন মানুষের কল্যাণের জন্য নাগরিক সেবা দিতে।

সরকারি এই কর্মকর্তা উপজেলার সকল প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন একনিষ্টভাবে। বলছি প্রশাসনের একজন চৌকস মেধাবী কর্মকর্তা অসীম চন্দ্র বনিকের কথা। তিনি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এবার তিনি ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। তাঁর নতুন কর্মস্থল হল চাঁদপুর জেলা।

জুড়ীতে প্রভাবশালীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বালুমহাল লিজ, শতবর্ষী বাজার উদ্ধার, জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসন, পাহাড়-টিলা কাটার বিরুদ্ধে অভিযান, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও নিজের বেতনের টাকায় হাকালুকি হাওরে বোরো ধান কাটায় নিয়োজিত ৫০০ শ্রমিককে খাবার খাওয়ানোসহ বেশ কয়েকটি রিপোর্ট পর পর কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হলে দেশব্যাপী আলোচিত হয়ে যান তিনি।

১ জুন সোমবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (মাঠ প্রশাসন-২ শাখা)-এর সিনিয়র সহকারী সচিব শেখ রাসেল হাসান স্বাক্ষরিত একটি পত্রে দুজন অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক ও ৫ জন উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ ৭ কর্মকর্তাকে পদায়ন/বদলির প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে বদলিকৃত কর্মকর্তাগণকে পদায়িত জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। জনস্বার্থে জারীকৃত এ আদেশ অবিলস্বে কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী, ২৯তম বিসিএস ক্যাডারের এ চৌকস কর্মকর্তা ২০১১ সালের ১ আগস্ট কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখান থেকে ২০১৪ সালে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে যোগ দেন। ২০১৬ সালে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে যোগ দেন।

এরপর ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে জুড়ী উপজেলায় যোগদান করেন। জুড়ীতে দায়িত্ব নেওয়ার পর সাহসিকতার মধ্যে দিয়ে শত বাধা পেরিয়ে সৃষ্টিশীল ও ব্যতিক্রমী কর্মযজ্ঞ করে উপজেলার সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন এবং সর্বমহলে ব্যাপক প্রশংসিত হন।

জুড়ীতে তাঁর কর্মকালীন সময়ে বিশেষ করে জলাবদ্ধতা নিরসনে জুড়ী চৌমুহনী থেকে জুড়ী নদী পর্যন্ত অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে দেড় কিলোমিটার খাল খনন ছিল আলোচিত। এই খালের পানি কন্টিনালা ও সাকিব খাল দিয়ে হাকালুকি হাওরে গিয়ে প্রবেশ করে। রেলপথের অবৈধ জায়গা উচ্ছেদ করে প্রায় ২৫ হাজার লোকের দীর্ঘদিনের সমস্যা দূর করেন।

জুড়ী হাসপাতালের ভেতরে একটি ঘর নিয়ে এক ব্যক্তির করা মামলা উচ্চ আদালতে মোকাবেলা করে হাসপাতালটি চালু করেন এবং ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে উপজেলাকে রাখেন শতভাগ নকলমুক্ত। শহরের দীর্ঘদিনের যানজট নিরসনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

জুড়ী শহরের প্রধান সমস্যা জুড়ী শিশু পার্ক ও পোস্ট অফিস সংলগ্ন অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী কামিনীগঞ্জ বাজারে স্থানান্তর করে শতবর্ষী মৃত বাজারকে জীবিত করে ব্যাপক প্রশংসিত হন। এই বাজার বর্তমানে ৭০ লাখ টাকা সরকারিভাবে ইজারা প্রদান করা হয়।

এছাড়া উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত ছিল। সন্ত্রাস ও মাদক নির্মূলে জিরো ট্রলারেন্স ছিল। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবাধে পাহাড় ও টিলা কাটার বিরুদ্ধে অভিযান করে করেছেন লক্ষ লক্ষ টাকার জরিমানা। সরকারি ধান ক্রয়ে সিন্ডিকেট চক্র ভঙ্গ ও হাট-বাজার সিন্ডিকেট চক্র ভঙ্গ করা হয়। এছাড়া জুড়ী নদীর বালুমহালে রাজস্ব ছাড়া বালু উত্তোলনে শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র ভঙ্গ করেন হাইকোর্টের প্রভাবশালী আইনজীবী মঞ্জিল মোর্শেদের মাধ্যমে। ফিরিয়ে আনেন সরকারের লক্ষ লক্ষ টাকার রাজস্ব।

এখন প্রতিবছর সরকার এই বালু মহাল থেকে ৭০- ৮০ লক্ষ টাকা ইজারা পাচ্ছে। ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে দেড় কোটি টাকার প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুমোদন করিয়েছেন। উপজেলার ভেতরে ও উপজেলা সদরের স্টেশন রোডে জরাজীর্ণ রাস্তাঘাট, ড্রেনসহ বিভিন্ন কাজে ৫ কোটি টাকার বরাদ্দ এনেছেন। যা উপজেলা পরিষদের বহির্ভুত বরাদ্দ। জেলা পরিষদের অর্থায়নে উপজেলার পুকুরপাড়ের সৌন্দর্য্য বর্ধনে ঘাটলা তৈরিসহ আধুনিক রেস্টহাউস নির্মাণ করা হয়।

উপজেলার জরাজীর্ণ অফিস দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিকায়ন করা হয়। সরকারের প্রতিটি নির্দেশনা বাস্তবায়নে সকল জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করেছেন। উপজেলার তিনটি চা-বাগান থেকে ভূমি উন্নয়ন কর হিসেবে সরকারের ৩ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছেন। বর্তমান বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে উপজেলার মানুষকে নিরাপদ রাখতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত মাঠে থেকে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে নিয়মিত করেছেন ভ্রাম্যমান আদালতের জরিমানা।

করোনাকালীন সময়ে সময়পযোগী সাহসী পদক্ষেপের কারণে জেলার মধ্যে একজন সুদক্ষ ইউএনও হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হাকালুকি হাওরে বোরো ধান কাটতে ৫০০ শ্রমিককে নিজের বেতনের টাকায় দুপুরের খাবার খাওয়ালেন। ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছ তালিকা প্রণয়ন করে রাত কিংবা রাতে গিয়েছেন মানুষের ঘরে ঘরে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত মানবিক সহায়তা তালিকা বাস্তবায়নে সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে শতভাগ নির্ভূল তালিকা প্রস্তুত করেছেন যা সিলেট বিভাগের মধ্যে প্রথম ছিল।

ইউএনও অসীম চন্দ্র বনিকের পদোন্নতির সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়। তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বিভিন্ন মহলের কয়েক শতাধিক ব্যক্তি তাদের ব্যক্তিগত ফেসুবক টাইমলাইনে পোস্ট করছেন। অনেকেই ইউএনও অসীম চন্দ্র বনিককে গরিব-দুঃখী মানুষের বন্ধু, জনদরদী ইউএনও ও মানবিক ইউএনও বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁরা বলছেন, ইউএনও অসীম জুড়ী বাসীর মন জয় করেছেন ভালোবাসা দিয়ে, শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন কর্তব্যপরায়ন দিয়ে। সাহসী ভূমিকা নিয়েছেন অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে। উপজেলার প্রতিটি মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, সংকট-সম্ভাবনা সবকিছুই যেন তাঁর নিজের করে নিয়ে প্রতিটি নাগরিককে সেবা দিয়ে গেছেন আপন মহিমায়।

ইউএনও জুড়ী থেকে চলে গেলেও তাঁর কর্মযজ্ঞ সর্বস্তরের লোকজন আজীবন মনে রাখবে কারণ জুড়ী বাসীর উন্নয়নে ইউএনও অসীমের ভূমিকা ছিল অনন্য। ২০০৪ সালে জুড়ী উপজেলা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ইউএনও অসীম চন্দ্র বনিকই একমাত্র ইউএনও হিসেবে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য। ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ রাজস্ব ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখায় জেলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইউএনও ও প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখায় জেলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইউএনও হওয়ারও খেতাব অর্জন করেন।

মাঠ প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় মাঠ প্রশাসনের মূল্যায়ন হিসেবে দক্ষতা অর্জনে সরকারিভাবে অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ হয় ইউএনও অসীম চন্দ্র বনিকের।

এক প্রতিক্রিয়ায় ইউএনও অসীম চন্দ্র বনিক বলেন, পদোন্নতি কাজ করার বড় সুযোগ। বড় বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কার্যকর ভূমিকা রাখার দারুন একটা প্লাটফর্ম অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদটি। সরকার এই পদে কাজ করার সুযোগ দানের জন্য চিরকৃতজ্ঞ।

তিনি আরো বলেন, আমার দায়িত্বকালীন সময়ে জুড়ীবাসীর আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি। দায়িত্ববোধ থেকে সার্বিক বিষয়ে নিজের সেরাটা নিংড়ে দিয়ে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছি। চাকরির সুবাধে যেখানেই দায়িত্ব পালন করি না কেন জুড়ীবাসীর কথা মনে থাকবে আমার চিরকাল।

করেসপন্ডেট,৪ জুন ২০২০

Share