চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) একদল গবেষক চট্টগ্রাম বিভাগের সব জেলা (১১ জেলা) থেকে করোনাভাইরাসের (SARS-CoV-2) নমুনা সংগ্রহ করে ভাইরাসটির জিনের বিন্যাস উন্মোচন (জিনোম সিকোয়েন্সিং) করেছেন।
শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও বায়োকেমিষ্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রবিউল হাসান ভূইয়া কালের কণ্ঠকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
জানা যায়, পুরো গবেষণাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জীববিজ্ঞান অনুষদ ও বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের ল্যাবে সম্পন্ন হয়। এ গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রবিউল হাসান ভূইয়া, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল এবং মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ইমরানুল হক ও ড. এইচ. এম. আবদুল্লাহ আল মাসুদ। এছাড়া উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র খন্দকার রাজিউর রহমান, ইমাম হোসেন, আরিফ হোসাইন ও সজীব রুদ্র, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ছাত্রী শান্তা পাল এবং বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের ছাত্র ওমর ফারুক যুক্ত ছিলেন।
অধ্যাপক ড. রবিউল হাসান ভূইয়া বলেন, এই গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম বিভাগের কভিড-১৯ (করোনাভাইরাস ডিজিস-১৯) এর ওপর সার্বিক চিত্র তুলে ধরা। সে লক্ষ্যে আমরা ১১টি জেলার প্রত্যেক উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায় থেকে কভিড পজিটিভ রোগীর নমুনা সংগ্রহ করেছি। তারপর, আরএনএ-এর পরিমাণ (কনসেনট্রেশন) ও গুণের (কোয়ালিটি) ওপর ভিওি করে ৪৬টি নমুনা জিনোম সিকোয়েনসিংয়ের জন্য নির্বাচন করি। যার মধ্যে ৩৩টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স ৯৯%-এর ওপরে উন্মোচিত হয়েছে। কিছু প্রশ্নকে সামনে রেখে এই গবেষণা করা হয়েছে। একটি হলো চট্টগ্রামে ভাইরাসটি সম্ভাব্য কোন পথে প্রবেশ করে থাকতে পারে এবং এর মিউটেশন সম্পর্কে জানা। প্রাথমিকভাবে ৩০টি জিনোম বিন্যাস (সিকোয়েন্স) বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে ধারণা পাওয়া যায়।’
গবেষণায় উঠে এসেছে, চট্টগ্রাম বিভাগের ভাইরাসটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, সৌদি আরব, তাইওয়ান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার ভাইরাসের সাদৃশ্য রয়েছে।
প্রতিটি জেলার ডাটা পৃথকভাবে পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে এর মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা আছে। চট্টগ্রাম জেলায় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইটালি, চেক রিপাবলিক, সৌদি আরব ও তাইওয়ান;কুমিল্লা ও চাঁদপুরে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, চেক রিপাবলিক, ভারত ও জাপান; নোয়াখালী, লক্ষীপুর ও ফেনী জেলায় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপান; ব্রাহ্মণবাড়ীয়াতে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সৌদিআরব ও ভারত; কক্সবাজার, রাঙামাটি ও বান্দরবানে যুক্তরাষ্ট্র, সিয়েরা লিওন, জার্মানি, ইটালি, তাইওয়ান ও চেক রিপাবলিক; এবং খাগড়াছড়িতে অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব ও তাইওয়ান এর নমুনার সাথে সাদৃশ্য বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে, সব সিকোয়েন্সের (বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনাকৃত ৩০টির) বিভিন্ন লোকেশনে সর্বমোট ১২৬টি ভিন্ন ভিন্ন মিউটেশন হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জিনের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় মোট ৮৬টি নিউক্লিওটাইড পরিবর্তন হলেও অ্যামিনো এসিডে কোন পরিবর্তন হয়নি। সবগুলো মিউটেশন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ৫টি মিউটেশন চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। যা সম্প্রতি মানব দেহের প্রাইমারি কোষ/প্রাণীদেহে সংক্রমণ ও ট্রান্সমিশনকে বাড়িয়ে দিতে সক্ষম বলে বিশ্ববিখ্যাত “সাইন্স” সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। মিউটেশনটি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত (সিভাসু/বিজেআরআই) ৭টি সিকোয়েন্সের মধ্যে ২টি (২৮.৫৭%) তে উপস্থিত থাকলেও আমাদের সমপ্রতি করা ৩০টি’তেই (১০০%) উপস্থিত আছে।
গবেষকরা জানান, আমাদের দেশের ভাইরাসের সিকোয়েন্সগুলোর (বিশ্লেষণকৃত ৩০টির) স্পাইক প্রোটিনের বিন্যাসে অন্য মিউটেশনের সাথে ৫টি এমন মিউটেশন পাওয়া গেছে, যেগুলো GISAID ডাটাবেইস অনুসারে অন্যান্য দেশে পাওয়া গেলেও বাংলাদেশ থেকে এই প্রথম শনাক্ত করা হয়।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্পাইক প্রোটিনে উপযুক্ত পরিবর্তনগুলো একত্রে পাওয়া না গেলেও কয়েকটি পরিবর্তন আলাদা আলাদাভাবে ভিন্ন ভিন্ন দেশে লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু ভাইরাসটি কি একত্রে কিংবা আলাদা আলাদা পরিবর্তনগুলোর জন্য অধিক শক্তিশালী হচ্ছে কিংবা শক্তি হারাচ্ছে তা বলার জন্য আরও উচ্চতর গবেষণা প্রয়োজন।
গবেষকরা আশা করছেন, তাদের উন্মোচনকৃত জিনের বিন্যাস চট্টগ্রাম বিভাগের সব জেলায় ভাইরাসের প্রকৃতি, বিস্তার, উৎপত্তিস্থল, বৈচিত্রতা ও মিউটেশন-এর মাধ্যমে জিনগত পরিবর্তন সম্পর্কে ধারনা দেবে। যা ভবিষ্যতে কভিড-১৯ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে।
বার্তা কক্ষ,২৬ ডিসেম্বর ২০২০