চাঁদপুরসহ সারাদেশের স্কুলগুলোতে অতিরিক্ত ভর্তি ফি ও বই-খাতা বাণিজ্য চলছে। সেই সাথে স্কুলের কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে পাঠ্যক্রম কারিকুলাম বহির্ভুত অতিরিক্ত বইয়ের তালিকা। দেখা গেছে কিন্ডারগার্টেনের ‘কেজি’ ক্লাসের একটি শিশুরই রয়েছে দশটি বইয়ের তালিকা, যা দেখে ছাত্র-ছাত্রী তো দূরের কথা অভিভাবকদেরই ভিমড়ি খাবার যোগাড়।
চাঁদপুরের উদয়ন শিশু বিদ্যালয়,ক্রিস্টিয়ান স্কুলসহ আরো কয়েকটি কিন্ডারগার্টেনে গত এক সপ্তাহ যাবত পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে অধিকাংশ স্কুলেই সীমাতিরিক্ত সেশন ফি, মাসিক বেতন নেওয়া হচ্ছে।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন অভিভাবক জানান, এসব সেশন ফি ও মাসিক বেতনসহ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে স্কুল কর্তৃক অতিরিক্ত রেটে বিক্রিত খাতাপত্র ক্রয় করতে অভিভাবকরা রীতিমতো শংকিত।
অনেক অভিভাবকই জানিয়েছেন বর্তমানে বাজারে তাদের আয় যেমন বাড়ছে না তেমনি বাজারের সাথে সঙ্গতি রেখে তাদের বেতন ও রোজগারও বাড়ছে না। ফলে শিশুদের জন্যে তাদের এ বাড়তি খরচ মেটাতে অভিভাবকদের রীতিমতো নাভিশ্বাস ও গলদঘর্ম হতে হয়।
অন্যদিকে বাড়তি জ্ঞানার্জনের অজুহাতে চাঁদপুরসহ রাজধানীর প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর কারিকুলাম বহির্ভূত বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ বই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত চাপে একদিকে যেমন শিশুদের মেধার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে এর মাধ্যমে বই বাণিজ্যে মেতে উঠেছে এক শ্রেণীর অসাধু মুনাফালোভীরা।
অথচ সরকার নিয়ম করে দিয়েছে প্রাথমিক স্তরে দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত আলাদা কোনো ব্যাকরণ বই থাকবে না। কিন্তু মুনাফালোভীদের কাছ থেকে নামমাত্র কমিশন গ্রহণের মাধ্যমে সরকারের এ আইন লঙ্ঘন করছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।
প্রাথমিক স্তরে অতিরিক্ত বই না দেওয়ার বিষয়ে শিক্ষাক্রম ২০১২-তে বলা হয়েছে, ‘দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত আলাদা কোনো ব্যাকরণ বই থাকবে না। শিক্ষার্থীকে কোনো রকম ব্যাকরণগত সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ মুখস্থ করতে দেওয়া কাম্য নয়। পাঠ্যনির্ভর ভাষিক কাজের মাধ্যমে তার ভাষা শিক্ষার সহায়তা করতে হবে।’
জানতে চাইলে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বিতরণ বিভাগের নিয়ন্ত্রক মোস্তাক আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘এনসিটিবির অনুমোদন ছাড়া শিশুদের জন্য বাড়তি বই সম্পূর্ণ অবৈধ।’
তবে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, অন্যদের তুলনায় নিজের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এগিয়ে রাখতে ব্যাকরণের সাধারণ জ্ঞানটা দেওয়া হচ্ছে। তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, এক ধরনের বই-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতেই বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের বাধ্য করছে বাড়তি বই কিনতে।
এনসিটিবির সদ্য-বিদায়ী চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র পাল বলেন, ‘শিশুদের ওপর বাড়তি বই আমি ভালো চোখে দেখি না। যে প্রকাশনা বইগুলো ছাপে তাদের সঙ্গে স্কুলগুলোর লেনদেনের ব্যাপার থাকে।’
‘এটা রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, এনসিটিবি সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত’—যোগ করেন তিনি।
শিক্ষাবিদ ও সরকারি বাঙলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক এস এম মকফুর হোসেন বলেন, ‘বাচ্চাদের ওপর জ্ঞানার্জনের নামে বাড়তি চাপ কখনই সঠিক না। যারা এসব বইয়ের ব্যবসা করে তারাই একটা বড় অঙ্কের কমিশনের মাধ্যমে স্কুলগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষও এই সুযোগটা নিচ্ছে। এর ফলে একটা বাচ্চার কোনো বেনিফিট তো হয়-ই না, প্রকারান্তরে ক্ষতি হয়।’
‘এটা শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের একটা চিত্র’ মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘সকল ক্ষেত্রে একমুখী শিক্ষা চালু করাই এর প্রথম সমাধান। নয়ত আমরা এই বাণিজ্যিকীকরণ রোধ করতে পারব না।’
অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে গেছে বিনামূল্যের নতুন বই। কিন্তু ক্লাস শুরু হতেই শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে বাড়তি বইয়ের তালিকা বুঝিয়ে দিচ্ছেন শিক্ষকরা। বিদ্যালয়ের নিয়ম মেনেই বাড়তি চাপ মনে করলেও এই অনিয়মকেই নিয়ম মনে করছেন অভিভাবকরা। এক প্রকার বাধ্য হয়েই তারা সংগ্রহ করছেন এসব বই।
রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এন্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল এন্ড কলেজ, ধানমণ্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইস্কুলসহ বেশ কয়েকটি স্কুল ঘুরে দেখা গেছে, প্রাথমিকের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রদত্ত বিনামূল্যে বইয়ের বাইরেও অভিভাবকরা বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ বই সংগ্রহ করছেন। এ বই সংগ্রহ করতে হচ্ছে বিদ্যালয়ের নির্দেশিত নির্ধারিত লাইব্রেরি থেকেই।
উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এন্ড কলেজে গিয়ে দেখা যায়, চতুর্থ শ্রেণীর এক ছাত্রীর অভিভাবক সাদিয়া আফরিন বিদ্যালয়ের ভেতরের লাইব্রেরি থেকে বই কিনছেন। ‘সরকার নতুন বই দিয়েছে, তারপরেও কী বই কিনছেন?’— জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদকের সামনে স্কুল কর্তৃক নির্ধারিত দু’টি ব্যাকরণ বইসহ তিনটি অতিরিক্ত বইয়ের তালিকা তুলে ধরেন। বইয়ের ওই নির্দেশিত তালিকায় প্রতিটি বিষয়ের জন্য নির্দিষ্ট রঙের মলাটসহ কমপক্ষে ৪ থেকে ৬টি খাতা কেনার নির্দেশনাও দেখা গেছে।
সাদিয়া আফরিন বলেন, ‘স্কুল থেকে প্রতিবছরই বাড়তি বইয়ের তালিকা দেওয়া হয়। আর স্কুলের নির্দেশনা থাকায় আমরা বাড়তি বই কিনতে বাধ্য হই।’
ভিকারুননিসা স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীর অভিভাবক শায়লা আহমেদ বলেন, ‘বাচ্চার জন্য সরকারি বইয়ের বাইরেও ইংরেজি ব্যাকরণসহ দু’টি ইংরেজি বই কিনতে হয়েছে। স্কুল থেকেই এগুলো কিনতে বলেছেন শিক্ষকরা।’
ধানমণ্ডির গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইস্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক রাজু আহমেদ বলেন, ‘স্কুলের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথম শ্রেণী থেকেই ভাতিজার জন্য বাড়তি বই কিনতে হচ্ছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে অনেকটা বাধ্য হয়ে বইগুলো পড়াতে হয়। এটা তার ওপর চাপ হলেও কিছুই করার নেই।’
বই বাণিজ্যের জন্য শিক্ষার্থীদের বাড়তি বই এমন অভিযোগ আমলে নিতে চাইলেন না উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সহকারী অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন।
আবুল হোসেন বলেন, ‘বাড়তি ব্যাকরণ বই কিনতে বলা হচ্ছে, এটা আমরা অস্বীকার করছি না। এগুলো সকল ভালো স্কুলেই পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই দুই একটা বাড়তি বই পড়ানো হয়। এর পেছনে অন্যকোনো কারণ নেই।’
‘ছোটবেলা থেকেই ভাষাগত ফাউন্ডেশন ভালো করতেই বইগুলো পড়ানো হয়’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এগুলো পড়লে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হবে না। অনেক কিছু শিখতে পারবে।’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোছা. সুফিয়া খাতুন এ বিষয়ে বলেন, ‘ব্যাকরণ ছাড়া ভাষা শিক্ষা পরিপূর্ণ হয় না। তাই ব্যাকরণ বইগুলো সহায়ক গ্রন্থ হিসেবেই পড়ানো হয়। এখানে বাড়তি চাপ নেই বা অন্যকোনো উদ্দেশ্যও নেই।’
এদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর এ বিষয়ে বলেন, ‘এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়গুলো মনিটরিংয়ের মধ্যে আনা হচ্ছে।’ অবশ্য তিনি এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
তবে এসব বিষয় নিয়ে চাঁদপুরের বিভিন্ন স্কুলের দায়িত্বশীলদের আশানুরূপ বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাদের ভাষ্য, বর্তমান অবস্থায় স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন ও সেশন ফি বাড়ানো ছাড়া তারা কোনো উপায় দেখছেন না।
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট || আপডেট: ০২:১৩ পিএম, ২০ জানুয়ারি ২০১৬, বুধবার
এমআরআর