দেশের পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলের জেলা লক্ষ্মীপুর। এখানকার মাটি ও আবহাওয়া সুপারি চাষের জন্য উপযোগী। প্রতিবছর এখান থেকে কোটি কোটি টাকার সুপারি দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। এবারো লক্ষ্মীপুরে প্রায় সাড়ে ৩শ কোটি টাকার সুপারি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আর এ অর্থকরী ফসলের সঙ্গে মিল রেখে কবি যথার্থই বলেছেন, ‘আঁচলে মেঘনার মায়া, ডাকাতিয়া বুকে, রহমতখালী বয়ে চলে মৃদু এঁকেবেঁকে; নারিকেল, সুপারি আর ধানে ভরপুর, আমাদের আবাসভূমি প্রিয় লক্ষ্মীপুর।’
জানা গেছে, এখানে উৎপাদিত সুপারি জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাজার দর ভালো থাকায় স্থানীয়দের আগ্রহ বাড়ছে সুপারি আবাদে। তবে পরিকল্পিত আবাদ, সঠিক পরিচর্যা ও চাষিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ জেলায় কাঁচা, পাকা সুপারি বিক্রি ছাড়াও পানিতে ভিজিয়ে এবং শুকিয়ে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। উৎপাদিত সুপারির ৭০ ভাগ পানিতে ভিজিয়ে জেলার বাইরে সরবরাহ করে ব্যবসায়ীরা।
আশ্বিন-কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে বিভিন্ন নদীনালা, খালডোবা, পুকুর ও জলাশয়ের পানিতে এসব সুপারি ভেজানো হয়। এরপর এসব সুপারি ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও শ্রীমঙ্গলসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হয়ে থাকে।
জেলার সবচেয়ে বড় সুপারির হাট বসে দালাল বাজারে। সপ্তাহে দুইদিন (শুক্র ও সোমবার) এখানে সুপারির হাট বসে। এ বাজারে কোটি কোটি টাকার সুপারি বেচাকেনা হয়ে থাকে। এছাড়া জেলার রায়পুর উপজেলার মোল্লারহাট, রাখালিয়া, হায়দরগঞ্জ, সদর উপজেলার জকসিন, চন্দ্রগঞ্জ, ভবানীগঞ্জসহ রামগঞ্জ, কমলনগর ও রামগতি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সুপারির হাট বসে।
জেলার কয়েকটি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বাজারে এখন প্রতি পোন (৮০টি) সুপারি বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকায়। মান ভালো হলে তা ১৪০-১৬০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কাহন (১৬ পোন) সুপারি এখানে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২৪০ থেকে ২ হাজার ৫৬০ টাকায়। অন্যদিকে শুকনো সুপারি বিক্রি হয় প্রতি টন দুই থেকে আড়াই লাখ টাকায়।
স্থানীয়রা জানায়, জেলার বাসিন্দারা নিজ উদ্যোগে বাড়ি, রাস্তার পাশে, পুকুর পাড়ে ও ফসলি জমিতে বাগান করে সুপারি উৎপাদন করে আসছে। সঠিক পরিচর্যার অভাবে ফসলটি আবাদ করে যথাযথ ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ, উন্নত বীজ সরবরাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হলে সুপারির উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হতো। উন্নত জাতের সুপারি চাষ করে চাষিরা নিয়মিত আয়ের সুফলভোগী হতেন। এতে চাষিদের ভাগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠত।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে জেলার ৫টি উপজেলায় ৬ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে সুপারি উৎপাদন হয়েছে। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ১ হাজার ৯০০ হেক্টর, রায়পুরে ৩ হাজার ৭০০ হেক্টর, রামগঞ্জে ৮৯০ হেক্টর, কমলনগরে ২৬৫ হেক্টর ও রামগতিতে ৪০ হেক্টর জমিতে সুপারি চাষ হচ্ছে। জেলায় এবার ১১ হাজার ৪৫২ মেট্রিক টন সুপারি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যার বাজার মূল্য নির্ধারণ করা হয় সাড়ে ৩শ কোটি টাকা।
সুপারি গাছের চারা রোপণের পর সঠিক পরিচর্যা করলে ৬-৭ বছরে ফলন পাওয়া যায়। সুপারি গাছ ২০-২৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। আগস্ট থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরের মার্চ পর্যন্ত সুপারি সংগ্রহ চলে। একেকটি গাছে বছরে তিন থেকে পাঁচটি ছড়া আসে। গাছে ফুল আসার পর ৯-১০ মাস লেগে যায় ফল পাকতে। প্রতি ছড়ায় ৫০-১৫০টি পর্যন্ত সুপারি থাকে।
সুপারি ব্যবসায়ী রাকিব হোসেন ও মেহেদি হাসান জানান, এ বছর সুপারির দাম একটু বেশি। গত বছর এক পোন (৮০ টি) সুপারি কিনেছি ১০০ টাকায়। এবার তা ১৫০-১৬০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ফলন কিছুটা কম হওয়ার কারণে দাম চড়া। তবে আরও কয়েকদিন পরে বাজারে সুপারির দাম কমতে পারে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. বেলাল হোসেন খান জানান, এখানকার মাটি ও আবহাওয়া সুপারি চাষে উপযোগী হওয়ায় সামান্য পরিচর্যায় ভালো ফলন আসে। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার পেছনে সুপারির অবদান অনস্বীকার্য। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার কাঁচা-পাকা সুপারির দাম কিছুটা বেশি।
তিনি আরও জানান, জেলা ও উপজেলা কৃষি অফিসে জনবল সংকট রয়েছে। এরপরও সুপারি চাষ, পরিচর্যা, ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণের বিষয়ে চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
বার্তা কক্ষ
৪ ডিসেম্বর, ২০১৮