ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ২৭ উপজেলা

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ‘অত্যন্ত প্রবল’ ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ভারতের ওড়িষ্যা উপকূলে আছড়ে পড়েছে। বুধবার সকাল ৯টার দিকে প্রথমে এটি রাজ্যটির ধরমা উপকূলে আংশিক আঘাত হানে। পরে উপকূল ধরে আরও উত্তর-পশ্চিমে এগিয়ে যায়।

বিশাল আকারের এই ঘূর্ণিঝড়ের বড় একটি প্রভাব ছিল বাংলাদেশে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানি বেড়ে খুলনা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত উপকূলীয় বিভিন্ন জেলার নিম্নাঞ্চল ভাসিয়ে নিয়েছে। কোথাও বাড়তি পানির তোড়ে বাঁধ টপকে আবার কোথাও বাঁধ ভেঙে বা ফাটল দিয়ে হু হু করে লোকালয়ে প্রবেশ করে ঢুকে পড়ে জোয়ারের পানি। এতে ফসলের ক্ষেত ও ঘরবাড়ি ভেসে গেছে।

মোট কত ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে বিভিন্ন অঞ্চল সেই তথ্য এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে সুন্দরবনে গত বছরের ঘূর্ণিঝড় আম্পানের চেয়েও এক ফুট বেশি উচ্চতার প্লাবন ছিল। আর আবহাওয়া দপ্তর থেকে পূর্বাভাস ছিল, ৩-৬ ফুট উঁচু জোয়ারে ভাসতে পারে উপকূলীয় ১৪ জেলার নিম্নাঞ্চল।

বিভিন্ন স্থানে আম-লিচুসহ মৌসুমী ফল ঝরে পড়েছে। ঝড়ের তাণ্ডবে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের জেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত ২৪টি নদীর পানি বিপদসীমার উপরে চলে গেছে। বিকালে এ রিপোর্ট লেখাকালে দেশের চারটি সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বাংলাদেশে আঘাত করেনি। এটি ভারতের ওড়িষ্যা উপকূল অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশ এখন সম্পূর্ণরূপে এর প্রভাবমুক্ত। তবে পূর্ণিমার কারণে জোয়ারের পানি বেশি ছিল। এ কারণে অতি জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় ৯ জেলার ২৭ উপজেলার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভোলার লালমোহনে গাছচাপায় একজন মারা গেছেন। উপকূলীয় ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) সূত্র জানিয়েছে, ইয়াসের প্রভাবে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুণা, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ফেনী, চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম, জেলা ও এগুলোর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের ওপর দিয়ে ৫১ থেকে ৬১ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। এসব জেলার নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩-৬ ফুট অধিক উচ্চতার জোয়ারে প্লাবিত হয়। ঝড়টি স্থলভাগে উঠে আসার পর বায়ুচাপের তারমত্য পরিলক্ষিত হয় উল্লি­খিত জেলাগুলোতে। ওইসব এলাকায় ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ আজও চলবে।

ডা. এনামুর রহমান বলেন, অতি জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার ২৭টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলাগুলো হলো- শ্যামনগর, আশাশুনি, কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, শরণখোলা, মোংলা, মোড়লগঞ্জ, মঠবাড়িয়া, বরগুনা সদর, পাথরঘাটা, আমতলী, পটুয়াখালী সদর, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, দশমিনা, মির্জাগঞ্জ, কলাপাড়া, চরফ্যাশন, মনপুরা, তজুমদ্দিন, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, ভোলা সদর, হাতিয়া, রামগতি ও কমলনগর।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসকদের অনকূলে পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী ও অর্থ বরাদ্দ দেওয়া আছে। এছাড়াও ‘ইয়াস’র প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ২৭ উপজেলায় মানবিক সহায়তা দিতে ১৬ হাজার ৫০০ শুকনা ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এনামুর রহমান বলেন, উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৭৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ছাড়াও স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, আনসার ভিডিপির স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছে। ঝড় আঘাত হানলে মানুষকে আনার জন্য আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত ছিল। মানবিক সহায়তার যথেষ্ট সংস্থান আগে থেকেই করা ছিল। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবস্থাপনার জন্য যথেষ্ট মাস্ক এবং স্বাস্থ্য উপকরণ নিশ্চিত করা হয়েছিল।

ঘূর্ণিঝড় হলেই বাঁধ ভেঙে যায়। এ বিষয়ে কি কোনো স্থায়ী সমাধান নেই? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, অনেকগুলো জায়গায় বাঁধ ভেঙে গেছে। সেগুলো পুনর্নির্মাণ কাজ চলছে। বাঁধগুলো অনেক পুরোনো। এ জন্য ডেল্টা প্ল্যানের আওতায় টেকসই বাঁধ করার পরিকল্পনা নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেটার জন্য ৩৭ বিলিয়ন ডলার বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০৩১ সালের মধ্যে সব উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. মোহসীন বলেন, প্রাথমিকভাবে কিছু ক্ষয়ক্ষতির হিসাব প্রস্তুত করা হয়েছে। আরেকটা সভা করে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিবেদন করা হবে। মাঠের কাজ শেষ হলে অল্প সময়ের মধ্যে আমরা সেটা করব।

ঢাকা ব্যুরো চীফ,২৬ মে ২০২১

Share