Home / জাতীয় / ঘুষ ছাড়া মিলছে না ক্ষতিপূরণ
ঘুষ ছাড়া মিলছে না ক্ষতিপূরণ

ঘুষ ছাড়া মিলছে না ক্ষতিপূরণ

মুন্সীগঞ্জ :

ঘুষ ছাড়া ক্ষতিপূরণের চেক তুলতে পারছেন না পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল ক্ষতিগ্রস্তরা। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা অনেকটা জিম্মি করে কমিশনের ভিত্তিতে এ ঘুষ নিচ্ছেন। কেউ ঘুষ দিতে অপারগতা জানালে তাকে শিকার হতে হচ্ছে নানা ধরনের হয়রানির। পদ্মাসেতু প্রকল্প এলাকায় গিয়ে এমনই অভিযোগ পাওয়া গেছে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে।

ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকরা জানিয়েছেন, তাদেরকে জমির প্রকৃত দাম থেকে তো বঞ্চিত করা হয়েছেই, তার উপর ক্ষতিপূরণের চেক তুলতে শতকরা ১.৫ থেকে ২৫ ভাগ পর্যন্ত ঘুষ দিতে হচ্ছে। আবার অনেকে ঘুষ বাড়িয়ে দিয়ে জমির ধরন পরিবর্তন করে চড়া দাম হাতিয়ে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন বঞ্চিত ভূমি মালিকরা।

এদিকে, ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে কমিশন ও ঘুষ নিয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসনের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রাতারাতি টাকার পাহাড় গড়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে মাওয়া ও জাজিরার ৭৬ হাজারেরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ।

সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর- এই তিন জেলার প্রকল্প এলাকায় এক হাজার ৮৬৫ একর ভূমি অধিগ্রহণের কারণে চার হাজার ৯৭৫টি পরিবার তাদের বাসস্থান হারাবে। কৃষিজমি হারাবে আট হাজার ৫২৬টি পরিবার।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৭৬ হাজার ১২০ জন। নদী শাসন, পুনর্বাসন প্রকল্প ও সেতুর অ্যাপ্রোচ রোডের জন্য নদীর উভয় পাড়ে এক হাজার ৮৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ ও ১৬৩ একর জমি হুকুমদখল করা হয়েছে। এই তিন ক্যাটাগরির ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৭ ধারার নোটিশ জারি করা হয়েছে। ৭ ধারার নোটিশে প্রেক্ষিতে এক থেকে দেড় বছর ধরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ক্ষতিপূরণের চেকের জন্য দিনের পর দিন ধর্ণা দিয়েও টাকা না পেয়ে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে প্রাপ্য অর্থ তুলতে হয়েছে তাদের।

মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্টের দক্ষিণ মেদিনীমণ্ডল, উত্তর মেদিনীমণ্ডল, কান্দিপাড়া, যশলদিয়া ও অনন্তসার মৌজার ক্ষতিগ্রস্তদের মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা তুলতে গিয়ে এখনো নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, জেলা প্রশাসনের ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকটা জিম্মি করে এসব উৎকোচ নিচ্ছেন।

ক্ষতিগ্রস্থরা জানায়,ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণের অর্থ দেয়া হচ্ছে দুই প্রক্রিয়ায়। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ভূমি অফিসে নিবন্ধনমূল্যে জমির দাম দেয়া হচ্ছে। আর বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ প্রচলিত বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় করতে অনুদান হিসেবে সেই মূল্যের ওপরে কয়েক গুণ বাড়িয়ে বিশেষ ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। সেতু কর্তৃপক্ষের পক্ষে পুনর্বাসন কর্মপরিকল্পনার আওতায় এই কার্যক্রমে সহায়তা করছে বেসরকারি সংস্থা খ্রিষ্টিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ ( সিসিডিবি)।

শরীয়তপুরের জাজিরা, মাদারীপুরের শিবচর এবং মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও শ্রীনগর উপজেলা অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অভিযোগ, নিয়ম অনুযায়ী জমির মূল্য পরিমাণ অর্থ ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে প্রদানের কথা থাকলেও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এ কার্যক্রম যাচ্ছেতাই ভাবে চলছে। জমির প্রকৃত মালিক হওয়ার পরও নিয়মমাফিক ক্ষতিপূরণ না পেয়ে বাধ্য হয়ে শতকরা ১.৫ থেকে ২৫ শতাংশ কমিশন প্রদানের মাধ্যমে চেক তুলেছেন তারা।

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে মুন্সীগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক আজিজুল আলমের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের ১৪টি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে জেলা প্রশাসক বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছিলেন।

জানা গেছে, সেই বৈঠকে উল্লেখযোগ্য আলোচনার মধ্যে ছিল নদী শাসন এলাকার ক্ষতিগ্রস্তদের চেক মাওয়া পয়েন্ট থেকে হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু তা না করে এখন মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে গিয়ে আনতে হচ্ছে। আর চেক আনতে গিয়েই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের। ক্ষতিগ্রস্ত কেউ প্রশাসনের খুব কাছের হলে তাকে কম করে হলেও শতকরা ২ থেকে ৩ ভাগ কমিশন দিতে হচ্ছে।

দক্ষিণ মেদেনীমন্ডল এলাকার বাসিন্দা মো. হিরু মিয়া বলেন, ‘এলএ শাখার সার্ভেয়ার, পিয়ন ও কানন কমিশনের টাকা উঠায়। অনেক সময় চুক্তিতে চেক দেয়া হয়।’ তিনি বলেন, ‘ঘুষ ছাড়া চেকেও সই করে না তারা।’

মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ গ্রামের বাসিন্দা আরিফ ঢালি জানান, ‘সেতু প্রকল্পে আমি প্রায় ৭০ শতাংশ জমি হারিয়েছি। কিন্তু জমির সম্পূর্ণ দামি পাইনি। যা পেয়েছি তার জন্য গুনতে হয়েছে শতকরা ১০ ভাগ কমিশন।’

তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অসাধু কিছু কর্মকর্তা ও ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের এ কমিশন দিতে হয়েছে।’

ভুক্তভোগীদের আরেকজন জাজিরা উপজেলার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের বাসিন্দা হারুন-অর-রশীদ পদ্মা সেতুর জন্য ৩২ শতাংশ কৃষি জমি হারিয়ে আজও কোনো টাকা পাননি। তারও অভিযোগ, জমির মালিক না হয়েও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় মদদপুষ্টরা রাতিরাতি ভূয়া মালিক বনে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

সূত্র- বাংলামেইল