সারাদেশ

ঘন কুয়াশার মধ্যে নৌপথে ডুবোচর : বিপাকে লঞ্চচালকরা

‘ভাম মেলে (পানি কম); দুই হাত পানি। ভাম মেলে; এক হাত পানি। সাবধান! ডাইনে চর, আটকাইবে! আরেব্বেডা চরে আটকাইবে! বামে ঘুরা।

আরে বামে ঘোরে না তো, ডাইন দিক দিয়া ঘোরতে সমস্যা আছে। আটকাইছে! চরে আটকাইছে! আটকাই গেছে! পিছকুলে টান! পিছকুলে টান!’

ঘন কুয়াশার মধ্যে নৌপথে ডুবোচর, পানির গভীরতা ও দিক খুঁজে পাওয়া নিয়ে লঞ্চের মাস্টার (চালক), সুকানি আর লস্করের মধ্যে যেন মৌখিক যুদ্ধ চলছে। গত বৃহস্পতিবার সকাল ছয়টায় বরিশাল থেকে ছেড়েছিল এমভি জনতা লঞ্চটি। সাড়ে ১০টায় ভোলায় পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ক্ষণে ক্ষণেই এমন চিত্রনাট্য মেলে।

বরিশাল থেকে ছাড়ার পরপরই লঞ্চটি ঘন কুয়াশার কবলে পড়ে। সামনে ছয়-সাত হাতের বেশি দূরের কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। চারদিক যেন অথই সাগর; অন্ধের হাতড়ে চলার মতো অবস্থা। কুয়াশা ভেদ করে সামনের নৌযান দেখার কৌশল নেই। সার্চলাইট, ফগলাইট কিছুই নেই। নেই দূরবীক্ষণযন্ত্র বা দিকনির্ণয় যন্ত্র (কম্পাস)। সংঘর্ষ এড়াতে বারবার হর্ন বাজিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল লঞ্চটি। লঞ্চকর্মীরা একাধারে বাঁশ ফেলেপানির গভীরতা মাপছিলেন। এর ভিত্তিতে এগোচ্ছিল লঞ্চ। কুয়াশার মধ্যে দিক হারিয়ে বারবার চরে আটকাচ্ছিল লঞ্চটি। যাত্রীরা বারবার আসন ছেড়ে উঠে আসছে; জানতে চাইছে লঞ্চের অবস্থান। বেশির ভাগ যাত্রীর চোখেমুখে আতঙ্ক। ভোলার ভেদুরিয়া লঞ্চঘাটে পৌঁছানোর কথা ছিল সকাল সাড়ে আটটায়। দীর্ঘ এক যুদ্ধ শেষে দুই ঘণ্টা বিলম্বে কাছে যখন এল, তখন সবার চোখেমুখে আনন্দ।

লঞ্চযাত্রী ভোলার সরকারি শেখ ফজিলাতুন্নেছা মহিলা কলেজের শিক্ষক মাসুম বিল্লাহর সাধারণ চোখেও ধরা পড়েছে, লঞ্চটির সবকিছুতেই জোড়াতালি। এমন ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চ কীভাবে চলছে? তাঁর মাথায় আসে না।

এমভি জনতার মাস্টার মহিবুল্যাহ বলেন, বিআইডব্লিউটিএর ফিটনেস সনদ নিয়েই তাঁরা লঞ্চ চালাচ্ছেন। মূল সমস্যা নাব্যসংকট। ৮ থেকে ১০ বছর ধরে ভোলা-বরিশাল নৌপথে শুকনা মৌসুমে ডুবোচরে লঞ্চ আটকে যাচ্ছে। এখন ঘন কুয়াশার কারণে সংকট প্রকট হচ্ছে।

ফিটনেস সনদ পায় যেভাবে

ভোলা-বরিশাল নৌপথে ১৬টি লঞ্চ চলছে। প্রায় প্রতিটির অবস্থাই এমভি জনতার মতো। একটি লঞ্চে ইঞ্জিন-হুইল ছাড়াও ফগলাইট, সার্চলাইট, আইপিএস, পানির গভীরতা পরিমাপ যন্ত্র, কম্পাসসহ অনেক কিছু থাকা জরুরি। এসব যন্ত্রপাতির বালাই নেই এসব লঞ্চে। অথচ সব লঞ্চের ফিটনেস সনদ আছে।

ত্রুটিপূর্ণ এসব লঞ্চ কীভাবে ফিটনেস সনদ পায়? এ প্রশ্নের জবাব আছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নৌ-নিরাপত্তা বিভাগের ভোলার পরিদর্শক নাসিম আহমেদের কাছে। তিনি বলেন, দুর্যোগ-দুঃসময়ে ওই যন্ত্রপাতিগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো দুর্ঘটনা এড়াতে কাজে দেয়। কিন্তু ভোলা-বরিশাল নৌপথের অধিকাংশ লঞ্চে সেগুলো নেই। কিন্তু প্রতিবছর ফিটনেস পরীক্ষার সময় লঞ্চগুলোতে সব যন্ত্রই থাকে। তারা ভাড়ায় এসব যন্ত্রপাতি আনে। পরীক্ষা শেষ হলে যার জিনিস, তাকে দিয়ে আসে।

খনন জরুরি

বরিশাল থেকে নৌপথে ভোলা ৪৩ কিলোমিটারের পথ। এই পথে কীর্তনখোলা নদী, সাহেবের হাট খাল, এরপর কালাবদর ও তেঁতুলিয়া নদী পড়ে। পুরো পথেই কিছু দূর পরপর ডুবোচর রয়েছে। বিশেষ করে ভাটার সময় নৌযান চলাচল দুষ্কর হয়ে পড়ে। এ পথের সবটুকুই খনন করা জরুরি বলে মনে করে লঞ্চকর্মী ও যাত্রীরা।

অনেকটা একই অবস্থা ঢাকা-ভোলা নৌপথেরও। ভেদুরিয়া লঞ্চঘাটের কাছে আসতেই চোখে পড়ে ভোলা-ঢাকা নৌপথের দুটি লঞ্চ তেঁতুলিয়া নদীর ভেতরে চরে আটকে আছে। আটকে পড়া যাত্রীদের কেউ কেউ স্পিডবোটে, ট্রলারে করে নিজস্ব উদ্যোগে ঘাটে পৌঁছায়। অন্যরা আটকা পড়ে ছিল জোয়ার আসা পর্যন্ত।

ভোলা জজকোর্টের আইনজীবী শাহাদাত হোসেন বলেন, সন্ধ্যায় ভোলা থেকে লঞ্চ ছাড়ে, ভোরে ঢাকা পৌঁছায়। এবারের শীতে তিনি কয়েকবার সারা রাত ডুবোচরে আটকে ছিলেন। ফলে তিনি এখন আর লঞ্চে যান না। ভোলা থেকে ফেরিযোগে লক্ষ্মীপুর হয়ে ঢাকায় যাতায়াত করেন।

ঢাকা-ভোলা নৌপথে ভোলার সাত উপজেলার লঞ্চঘাট থেকে প্রায় ২০টি লঞ্চ চলাচল করে। এ পথের কয়েকজন লঞ্চের চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোলা সদরের খেয়াঘাট লঞ্চঘাট থেকে ভেদুরিয়া পর্যন্ত ভোলা খালে ডুবোচর রয়েছে। এ কারণে আধা ঘণ্টার পথে লঞ্চগুলোর এক থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। এই খালের ১০টি স্থানে খনন করা দরকার। এ ছাড়া তেঁতুলিয়া নদীর ভেদুরিয়া, শ্রীপুর, কাজীর চর, মেহেন্দীগঞ্জের ভাষাণ চর, মেঘনা নদীর হিজলা ও কালীগঞ্জের ডুবোচরগুলো কমপক্ষে ২০ ফুট খনন করা দরকার। তা না হলে ভোলা-ঢাকাপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।

কর্ণফুলী-৯ লঞ্চের মাস্টার মো. বাবলু হাওলাদার বলেন, ‘ভোলা-ঢাকা পথের লঞ্চগুলো চলতে আট-নয় ফুট পানির গভীরতা দরকার। এসব ডুবোচরে ভাটার সময় পানি থাকে পাঁচ-ছয় ফুট। বিআইডব্লিউটিএর প্রকৌশলীদের ডুবোচরগুলো অনেকবার দেখিয়েছি। খনন করছে; কিন্তু কাজ হচ্ছে না।’

বিআইডব্লিউটিএ ঢাকা কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী (ড্রেজিং) সজিব হাসান বলেন, ভোলা খাল শ্রীপুর গঙ্গাপুর নৌপথের ২৮ কিলোমিটারে খননকাজ শুরু হয়েছে। প্রায় ২৮ কোটি টাকার এ কাজ নৌবাহিনী ও বিআইডব্লিউটিএ বাস্তবায়ন করছে। বাস্তবায়নকাল অক্টোবর ২০১৭-জুন ২০১৯। এখন একটি খননযন্ত্র দিয়ে তেঁতুলিয়া নদীতে খননকাজ চলছে। জানুয়ারিতে ভোলা খালে আরও একটি খননযন্ত্র বসানো হবে।

এদিকে লালমোহনের নাজিরপুর ঘাট থেকে লঞ্চ লালমোহন লঞ্চঘাটে আসতে আধা ঘণ্টা লাগার কথা। কিন্তু পলি জমে লালমোহন খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় এই পথে সময় লাগছে ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা। এ কারণে লালমোহন খালটিও খনন করা অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া তেঁতুলিয়া নদীর নাজিরপুর ইউনুস মিয়ার চর, নাজিরপুর লেক, দেউলা ডুবোচর, ধুলিয়া ডুবোচর ও শ্রীপুর সিন্নির চর খনন করা জরুরি।

ভোলা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব এস এম বাহাউদ্দিন বলেন, দ্বীপজেলা ভোলার প্রায় ২১ লাখ বাসিন্দা নৌযানের ওপর নির্ভরশীল। লঞ্চ ছাড়া তারা ভোলার বাইরে যেতে পারে না। কিন্তু শীত মৌসুম এলেই লঞ্চগুলো চরে আটকে যায়। এই অবস্থার অবসান দরকার।

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০১:০৩ এএম, ৬ জানুয়ারি ২০১৮, শনিবার
ডিএইচ

Share