গড়ে উঠেছে নারী নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ (ভিডিও)

‎Monday, ‎April ‎20, ‎2015   08:08:26 PM

মিজানুর রহমান রানা :

বাংলাদেশে এখন গড়ে উঠেছে নারী নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।

নারীরা এখন রাস্তায় অনিরাপদ, বখাটে ইভটিজারদের হামলার শিকার হচ্ছে তারা। তাই এসব প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসতে হবে সচেতন যুবকদের। সেটাই  হচ্ছে এখন। নারীদের ইজ্জত রক্ষায় এগিয়ে আসছে সচেতন যুবকরা। গড়ে তুলছে দুর্ভেদ্য দেয়াল। যা দেখে পালিয়ে যায় ওইসব নারী নির্যাতনকারীরা।

সারা দেশে এমন প্রতিরোধ গড়ে তুললে দেশটি থেকে এসব কুলাঙ্গারদের হিংস্র থাকা কমে যাবে।

ভিডিও দেখুন :

ইভটিজিং: প্রতিকার ও প্রতিরোধ

তারিকুল আলম :

ইভটিজিং বলতে সাধারণভাবে আমরা বৃঝি রাস্তাঘাটে মেয়েদেরকে উত্ত্যক্ত বা হয়রানি করা। মেয়েদের উদ্দেশ্যে কটু মন্তব্য করা, অশ্লীল ইঙ্গিত,শিস দেওয়া, কুৎসিত শারীরিক অঙ্গভঙ্গি করা, পথ আটকে দাঁড়ানো বা ওড়না টেনে ধরার মতো অশোভন আচরণ ইত্যাদি ইভটিজিং-এর আওতায় পড়ে। এগুলো আসলে যৌন হয়রানির নামান্তর। উত্ত্যক্ত করা ও হয়রানির ঘটনায় বাংলাদেশে যেভাবে মেয়েদের আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, পৃথিবীর অন্য কোথাও সেরকম নজির নেই। অবশ্য অনেক দেশে এ ধরণের ঘটনা ঘটলে আইনি প্রতিকার পাওয়া যায়। আর আমাদের দেশে আইনি প্রতিকার তো দূরের কথা, এরকম ঘটনায় পরিবার ও সমাজের মানসিক সমর্থন ও অনেক সময় পাওয়া যায় না। আমাদের সমাজে অনেকে এগুলোকে তরুণ বয়সীদের ‘একটু মজা’ বা বয়সজনিত। চপলতা হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু ইভটিজিং আসলে যৌন হয়রানির একটি ধরন। এটি একটি ঘৃণ্য অপরাধ যা নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। ইভটিজিং -এর কারণে অনেক মেয়েশিশু তাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার পরিবেশ পাচ্ছে না এবং তাদের জীবনের গতি অসময়ে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেক সম্ভাবনার বীজ অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সহজ টার্গেট বলে মেয়েশিশুরা টিজিং-এর শিকার হয়ে বেশি। মেয়েদের উত্ত্যক্ত ও হয়রানি করা যা ইভটিজিং বলে পরিচিতি, গুরুতর অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া উচিত। কারণ এর ফলে অসংখ্য মেয়ের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। বখাটেদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের সমাজে হরহামেশাই ঘটছে। ইভটিজিং-এর প্রকোপ বর্তমানে এমন এক জায়গায় পৌছেছে যে, রাজধানীর খিলগাঁওয়ের সিমি, মিরপুরের ফাহিমা, খুলনার রুমি, গাইবান্ধার তৃষা, স্বপ্না, সাভারের তিথির মতো অসংখ্য কিশোরী নিজের জীবনের সমাপ্তি টেনেছে আত্মহননের মধ্য দিয়ে। এসব মৃত্যু শুধু মৃত্যুই নয়; আমাদের অভিশপ্ত সামাজিক জীবনের একেকটি বিষাদময় কাহিনী। গাইবান্ধার শিশু তৃষা কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্রী সিমি আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার পর দেশব্যাপী অনেক হৈচৈ হয়েছে। নারী আন্দোলনের কর্মীরা বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামও পড়ে তুলেছিল। কিন্তু এ পর্যন্তই। ইভটিজিং বা বখাটেদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের ঘটনা থামেনি। হরহামেশাই তা ঘটছে।

ইভটিজিং নারী নির্যাতনের নতুন হাতিয়ার:

একজন মানুষ নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে যে নির্যাতনের শিকার হন সাদামাটা ভাবে তাকেই নারী নির্যাতন বলে। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী নারীর যে কোন ধরনের দৈহিক, জৈবিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন করা বা করার চেষ্টা করা নারী নির্যাতনের অন্তর্ভুক্ত। বেইজিং চতুর্থ নারী সম্মেলনে নারীর প্রতি সহিংসতামূলক যে কোন ধরনের তৎপরতা যার ফলে নারীর শারীরিক, মানসিক,যৌন বা মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি বা বিপর্যয় ঘটে ঘটতে পারে তাকে নারী নির্যাতন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়গুলো থেকে স্পষ্ট যে, নারী নির্যাতন কেবল দৈহিক বা শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইভটিজিং বর্তমানে নারী নির্যাতনের একটি নতুন হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এক সময় সমাজের বখে যাওয়া একটি ক্ষুদ্র অংশই ইভটিজিং-এর সঙ্গে জড়িত থাকলেও এখন উঠতি বয়সী তরুণ, কিশোর, যুবকরা তো আছেই; মধ্যবয়সীরাও কম যান না। রাস্তাঘাট, অফিস, ব্যাংক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার-স্টেশন, সর্বত্রই প্রতিনিয়ত ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে উঠতি বয়সী তরুণী ও কিশোরীরা। কখনও কখনও এদের দাপট এতটাই বেশি হয় যে, সমাজপতিরা পর্যন্ত এদের সমীহ করে চলেন বা জোগানদাতা হিসেবে কাজ করে থাকেন।

ইভটিজিং স্পষ্টতই যৌন হয়রানি:

‘ইভটিজিং’ কথাটা আমাদের দেশের পত্রপত্রিকার খুবই ব্যবহর করা হয়। রাস্তায় মেয়েদের দেখে টিটকারি দেওয়াকেই এক কালে ইভটিজিং বলা হত। ‘টিজিং’ কথাটির আভিধানিক অর্থ পরিহাস, জ্বালাতন ইত্যাদি। তাই ইভটিজিং শুনলে মনে হয়, সেটা দুষ্টুমি হতে পারে তবে গুরুতর কোন অন্যায় নয়। পৌরাণিক কাহিনিতে প্রচলিত আছে ইভ-এর প্ররোচনায় অ্যাডাম নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করার কারণেই তারা স্বর্গচ্যুত হয়েছিলেন। তারই আলোকে সে স্মৃতি ধরে রেখে যুগযুগান্তর ধরে অ্যাডাম-সন্তানেরা ইভ (নারী) কে উত্ত্যক্ত করেই চলেছেন। অথচ এ ঘটনার বিবরণ সুরা আল আরাফ সহ কোরাআন শরিফের বিভিন্ন পংক্তিতে রয়েছে। যেখানে খুব স্পষ্ট করে বলা আছে, যখন ইভ বা বিবি হাওয়া ও অ্যাডাম বা আদমকে নিষিদ্ধ ফলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে তা ভক্ষণ করতে বারণ করা হয়েছিল, তখন তাঁরা উভয়েই ফলটি ভক্ষণ করে ফেলেন, শাস্তিস্বরূপ তাদের মর্ত্যে আগমন। কাজেই এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে পৌরাণিক কাহিনির সৃষ্টি তা সত্য সাক্ষ্য দেয়া না। ইভটিজিং বলে অন্যায়টাকে হালকা করে দেখার একটা প্রবণতা থাকে, যাকে যৌন হয়রানি বললে আচরণের গভীরতা প্রকাশ পায়। এজন্য যৌন হয়রানির বদলে আমাদের সমাজে ইভটিজিং কথাটি ব্যবহার করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সভ্য সমাজে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয় না। সেখানে এই আচরণ যৌন হয়রানি (sexual harassment) হিসেবে বিবেচিত হয়।

যৌন হয়রানির বিভিন্ন ধরন বা রূপ:

আগে কেবল কথা বা শিস দিয়ে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ব্যাপারটি সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে ইভটিজিংয়ের ধরন বদলাচ্ছে। এখন গ্রামেগঞ্জের মেয়েরা নিরাপদে চলাচল করতে, স্কুলকলেজে যেতে পারে না। অভিভাবকরা মেয়েদের নিয়ে সারাক্ষণ আতাঙ্কে থাকেন। স্কুল বা কলেজের যাত্রাপথে বখাটেরা রাস্তার ধারে দল বেঁধে থাকে এবং মেয়েদের যাত্রাপথে অশ্লীল মন্তব্য, বাজে অঙ্গভঙ্গি করে এবং উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখায়। অঝ্হাত পরিচয়ে মোবাইল ফোনে উত্ত্যক্ত করে। এ ছাড়া এরা মোবাইল ফোনের নম্বর সংগ্রহ করে হুমকির পাশাপাশি অশ্লীল মেসেজ পাঠায়। অনেক সময় গাড়ি বা মোটরসাইকেলে পিছু ধাওয়া করতে করতে মেয়ের বাড়ি পর্যন্ত চড়াও হয়। বখাটেরা মেয়েদের পেছন পেছন হাঁটে, রিকশায় জোর করে পাশে উঠে যায়, পাশাপাশি চলন্ত রিকশায় কটু মন্তব্য করে, এমনকি বাড়ি এসে মেয়ে ও তার পরিবারের সদস্যদের অপমান করে। প্রতিবাদ করলে উলটো হুমকিধামকি দেয়। এগুলো মেয়েদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে গেছে। অনেকে এই আচরণেকে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ বলে সাফাই গায়। তারা বয়সের উপর দায় চাপিয়ে বলেন, আসলে এ বয়সটাই নিয়ন্ত্রণহীন, এ বয়সে ছেলেরা এরকমই হয়। তারুণ্যভরা যৌবনদীপ্ত বয়সে এটা খুবই স্বাভাবিক। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে ছেলেদের এসব আচরণকে এভাবেই সমর্থন করা হয়। মেয়েদের প্রতি এমন আচরণ যারা করে তাদের সামগ্রিক গতিবিধিই স্পষ্ট করে দেয়, যে তারা কোন সৎ উদ্দেশ্য থেকে এটা করছে না। অনেকে আবার গায়ে পড়ে এসে মেয়েদের উপর অভিভাবকত্ব ফলান। এই অভিভাবকত্ব ফলানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তারা মোটেও মাথা ঘামান না। কোন জনবহুল জায়গাতে (হাসপাতার, বাসাষ্ট্যান্ড, রেলস্টেশন) কিছু বয়স্ক লোক মেয়েদের দেখলে এসে বলবে, ‘মা,আমি তোমার বাবার মতো’ অথবা, ‘বোন, আমি তোমার বড় ভাইয়ের মতো।’ এই মুখোশধারীরা উপযাচক হয়ে অভিভাবকত্ব ফলিয়ে মেয়েদের হয়রানি করে। পথেঘাটে এরূপ আচরণ অনধিকার চর্চার নামান্তর।

যৌন হয়রানি ঃ দায়ী আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও নিস্ত্রিয় আচরণ:

ইভটিজিংয়ের শিকড় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা মূল্যবোধের মধ্যেই মিশে রয়েছে। নারীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ও সহিংস সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটিয়ে নারী-পুরুষের অংশীদারিত্বমূলক, সহমর্মিতাপূর্ণ, দায়িত্বশীল, সুস্থ সম্পর্কের বিকাশের প্রতি মনোযোগ দেওয়া দরকার। এ ব্যাপারে পরিবার থেকেই উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে, পরিবর্তন করতে হবে নেতিবাচক মানসিকতা। শিশুর বেড়ে ওঠা ও সামাজিকীকরণের মধ্যেই নারীর প্রতি এই বিদ্বেষ ও সহিংস মনোভাব আত্মস্থ হয়ে পড়ে এবং তা ছেলেশিশুর ব্যক্তিত্বের অংশে পরিণত হয়। পরিণত জীবনে এটা মুছে ফেলা কঠিন হয়। ঘরের অভ্যন্তরে বাবা বা অন্যান্য পুরুষচরিত্রের রুঢ় আচরণ মেয়ে বা নারীদের অপমান করার সহজাত প্রবণতা থেকে ছেলেরা আত্মম্ভরী, বিদ্রুপাত্মক ও আশে-পাশের কম শক্তিধর মানুষকে হেয় করার মানসিকতা নিয়ে বড় হতে থাকে এবং মেয়েরা শত অত্যাচার-অনাচারেও রা না করে মেনে নেওয়ার প্রবণতাকে ধারণ করে নেয়। এধরণের সামাজিকীকরণের মাধ্যমেই ছেলেরা রাগী, উদ্ধত ও সিদ্ধান্ত প্রদানে আগ্রহী হয় এবং মেয়েরা মেনে নেওয়া, কথা না বলা ও সিদ্ধান্তহীনতার চরিত্রকে ধারণ করে। প্রকারান্তেরে উভয়েই অসম্পূর্ণ মানুষ হয়ে বড় হয়। এই চক্র থেকে উত্তরণ পেতে হলে শিশুর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার দিকে সর্বপ্রথম নজর দিতে হবে যাতে তারা উভয়ের প্রতি সম্মান ও মর্যাদার মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠতে শেখে।

আইনের ব্যাখ্যা নেই:

আমাদের দেশে ইভটিজিংয়ের ঘটনা থেকে আত্মহত্যার ঘটনা আশংকাজনক হারে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে প্রচলিত আইনের কোন ধারায় ইভটিজিং বা হয়রানি সম্পর্কে কিছু বলার নেই। তবে হয়রানিমূলক কাজকে বিভিন্ন আইনে অপরাধ বলে ধরে শাস্তির বিধান করা হয়েছে। দেশের প্রচলিত যেসব আইনে ইভটিজিং জাতীয় কর্মকান্ডের বিচার সম্ভব সেগুলো হল দন্ডবিধি, ১৮৬০ (ধারা-২৯৪ এবং ধারা-৫০৯), ঢাকা মহানগরী পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ (ধারা ৭৬)। এগুলোতে নারীদের উত্ত্যক্ত করার জন্য শাস্তির বিধান আছে সর্বোচ্চ মাত্র তিন মাস বা এক বছর কারাদন্ড কিংবা দু হাজার টাকা জরিমানা। জরিমানা আদায় না হলে কী করা হবে তার উল্লেখ নেই কোথাও। এই ন্যূনতম শাস্তির বিধান দিয়ে এ ধরণের অপরাধের প্রতিকার কতটা সম্ভব তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তা ছাড়া এই আইনগুলোর কথা সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক, খোদ আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বা আইনজীবীরাও অনেকে জানেন না। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এ ইভটিজিং-কে যৌন হয়রানির একটি ধরণ হিসেবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল, যদিও ইভটিজিং শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু ২০০৩ সালে আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে যৌন হযরানির শর্তগুলোকে শিথিল করা হয়েছে। ফলে এর আওতায় ইভটিজিং-এর ঘটনার আইনি প্রতিকার পাওয়ার আশা ক্ষীণ হয়ে গেছে। ২০০৩ সালের সংশোধনীতে একটি নতুন উপধারা সংযুক্ত করা হয়, যাতে কোন নারী সম্ভমহানির কারণে আত্মহত্যা করলে আত্মহত্যঅর প্ররোচনার দায়ে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। তবে এখানে সম্ভমহানির কোন সংজ্ঞা বা আওতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। প্রচলিত ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি আইনের ৫০৯ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোন নারীর শালীনতার অমর্যাদার করার জন্য কোন মন্তব্য বা অঙ্গভঙ্গি বা কোন বস্তু প্রদর্শন করে তাহলে ঐ ব্যক্তি এক বছর কারাদন্ড বা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে। কিন্তু এসব অপরাধের সাক্ষ্যপ্রমাণের যে জটিলতা, তার প্রমাণ দিতে হয় অভিযোগকারীকেই। ২০০৩ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০৯ (২) ধারায় যৌন নিপীড়ন হিসেবে বিবেচনা করে হয়রানি বা ইভটিজিংয়ের বিষযটি উল্লেখ করা হলেও আইনের অপব্যবহারের কথা বলে পরে ২০০৩ সালে কিছু সংশোধনীর মাধ্যমে তা বাতিল হয়। যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে কোন নারী বা শিশুর শরীর স্পর্শ করলে বা শ্লীলতাহানি করলে শাস্তির বিধান হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন ৩ বছরের কারাদন্ড এবং অর্থদন্ড। তবে স্পর্শের প্রসঙ্গে থাকায় তা হয়রানি বা আত্মহত্যায় প্ররোচনার ভেতরে পড়ে না আইনের ব্যাখ্যামতেই। তবে ১৪ মে ২০০৯ যৌন হয়রানি বন্ধে হাইকোর্টের এক যুগান্তকারী রায় ঘোষণার পর এ সংক্রান্ত অস্পষ্টতা অনেকটাই দূর হয়েছে। এখন প্রয়োজন এই রায়ের যথাযথ বাস্তবায়ন।

যৌন হয়রানির ফলে সৃষ্ট সামাজিক সমস্যা:

সমাজে নারীর অসম অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে যৌন হয়রানির প্রভাব সর্বগ্রাসী। প্রতিমূহূর্তে তা নারীর কাজ-কর্ম চলাফেরাকে বাধাগ্রস্থ করে শুধু তাই নয়, মনোবল ধ্বংস করে সামাজিকভাবে নারীকে অযোগ্য ও নিস্তেজ করে রাখে। সক্ষমতা অর্জনে প্রাথমিক পর্যায়েই বাধা দেয। টিজিংয়ের বদঅভ্যাস পুরুষদের জীবকে চটুল রসে পূর্ণ করে ও লেঅভী মানসিকতা প্রকাশে সহায়তা করে। অন্যদিকে শিশু ও নারীদের জন্য অনবরত দুর্বিসহ পরিস্থিতি তৈরী করে যা ভেদ করে জীবনের স্বাভাবিক সুবাতাস গ্রহণ প্রায়শ সম্ভব হয় না। ইভটিজিং এর মতো মেয়েদের প্রাণসংহারক একটি গুরুতর অপরাধকে হাল্কাভাবে দেখার এবং এর দোষ মেয়েদের ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতাই এর ব্যাপ্তি বাড়াতে সহায়তা করছে। আমাদের রক্ষণশীল সমাজের ধারণা মেয়েদের জায়গা ঘরে আর ছেলেদের জায়গা বাইরে। এমনও বলা হয়ে থাকে যে, মেয়েরা অশালীন পোশাক পরে রাস্তাঘাটে চলাচল করে বলেই হয়রানির ঘটনা ঘটে। অথচ বৃদ্ধা বা অবগুণ্ঠিত নারীদের ক্ষেত্রেও যৌন হয়রানির অহরহ ঘটার প্রমাণ পাওয়া যায়। আমাদের সমাজ হয়রানিরকারীদের না দুষে উল্টো মেয়েদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে তাদেরকে মানসিক ভাবে আরও বিপর্যস্ত করে তোলে। অন্যদিকে অপরাধীদের দ্বিগুণ উৎসাহ এ কাজ চালিয়ে যায়। সমাজের চাপ এবং অনীহার কারণে এ নিয়ে আইনের দ্বারস্থ হতেও সমস্যা হয়। যৌন হয়রানি বা টিজিংয়ের কারণ ব্যক্তির বিবেচনা বোধের অভাব, শ্লালীনতাহীনতা, ক্ষমতার দম্ভ ও অপব্যবহার, সীমাহীন যৌন লিন্সা, বিকৃতি ইত্যাদি। নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই মূলত উত্ত্যক্ত করা ও হয়রানির সূত্রপাত ঘটে। পুুরুষতান্ত্রিক মন-মানসিকতায় পুষ্ট সমাজ ভাবে নারীরা সব সময় পুরুষের অর্ধস্ত, তাই ইচ্ছামতো তাদের সঙ্গে ব্যবহার করা যায়। সমাজে তাদেরকে শুধু ভোগ্য পণ্য হিসেবে দেখার প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষ করে গণমাধ্যমে তথা বিজ্ঞানপন, মিউজিক ভিডিও সিমেনা ইত্যাদিতে নারীর উপস্থিতি এখন অনেকটাই যৌন বস্তু হিসেবে। নাটক-সিমেনা উপন্যাসে ইভটিজিং এর মাধ্যমে নায়ক নায়িকার প্রেমের সুত্রপাত দেখতে দেখতে উঠতি তরুণরা নিজেরাই হিরো সেজে মেয়েদের পিছু নেওয়া শুরু করে। বিবিধ কারণে আজ যুব সমাজের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ও ঘটছে। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে যৌন হযরানি, নারী নির্যাতন বা লাঞ্জনার মধ্য দিয়ে। ক্রমবর্ধমান বেকরাত্ব রাজনৈতিক প্রভাব, সামজিক অস্থিরতা প্রভৃতিও এই ফরাধের পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। উত্ত্যক্ত করা হয়রানির পথ ধরে অপহরণ, ধর্ষণ , এসিড নিক্ষেপ, জোরপূর্বক বিয়ে, আত্মহত্যা পরিবাবের এলাকা ত্যাগ, মা-বাবা ভাইয়ের হতাহত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে থাকে এবং এর নেতিবাচক প্রভাবও তাই ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজসহ বিভিন্ন পর্যায়েই পড়ে। কিন্তু আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কখনও কখনও একে একটি রোমান্টিক ইমেজ দিতে চায় এবং টিজিংকারী পুরুষদের রোমিও বলে অভিহিত করা হয়। রোমান্টিকতার পর্দার আড়ালে যৌন হয়রানির কুফল বা নৈতিবাচক তপরিণতিগুলো তাই আমাদের চোখে পড়ে না। বিকৃত মানসিক সম্পন্ন বখাটেরা নিজেদের বিকৃত বিনোদন পাওয়ার জন্য মেয়েদের নানাভাবে উত্তৗক্ত করে। এর ফলে যে ধরণের সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয় সেটিও অনভিপ্রেত। ভয়-ভীতি ডিঙিয়ে যখন নির্যাতিতা মেয়েটি পরিবারে সদস্যদের কাছে ঘটনাটি খুলে বলে তখন তাকে কঠিন পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয় সেটি আরও দুর্বিষহ। পরিবারের মূল্যরোধের কথা চিন্তা করে মেয়েটির জীবনের সকল আশা আকাঙ্খাকে বিসর্জন দিয়ে বিষয়ের মাধ্যমে তাকে ঠেলে দেওয় হয় ভিন্ন এক জগতে। বিয়ের পরিণত বয়সের আগেই মেয়েটির নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে পিতামাতা বা অভিভাকরা এ রকম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেও ধরণের বাল্য বিয়ে গ্রামে হয়ে থাকে। আমাদের দেশে বিপুলসংখ্যক মেয়েশিশু ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলেও এসএসসি পরীক্ষায় আগেই ঝরে পড়ে। স্কুল থেকে মেয়েশিশু শিক্ষাথীদের ঝরে পড়ার অন্যতম একটি কারণ হল বাল্যবিয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে দেখা গেছে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি। ইভটিজিংয়ের ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে শিক্ষার আলে থেকে। সচ্ছল পরিবারের অীভভাবকরা সন্তানদের পড়াশোনার বিষযটির কথা চিন্তা করে শহরে পাঠিয়ে দেয়। প্রথম আলোর ২০০৬ সালের ২১ এপ্রিলের এক প্রতিবেদনের দেখা গেছে বাজিতপুরে এসএসসি পাস করার পর ৪০-৫০ জন শিক্ষাথীর উদ্বিগ্ন অভিভাবক তাদের মেয়েদের বৈরবের ছাত্রীনিবাসে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে দরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জীবনের আশা আকাঙ্খার যবনিকা টানতে হয়। অথচ এই জঘন্য অপরাধ ও দেশীয় অর্থনীতি ধ্বংস সাধনকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাড়াতে হয় না। আসুন আমরা সবাই মিলে ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াই , তবেই আমাদের দেশকে সোনার বাংলা গড়তে আর বেশী দিন লাগবে না ।

লেখক: তারিকুল আলম, সহকারী কমিশনার (ভূমি), মিরপুর সার্কেল, ঢাকা

চাঁদপুর টাইমস : এমআরআর/ডিএইচ/2015

নিয়মিত আপনার ফেসবুকে নিউজ পেতে লাইক দিনhttps://www.facebook.com/chandpurtimesonline/likes

Share