২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে নৃশংস গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আর আহত হন কয়েকশ নেতাকর্মী। সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও বিস্ফোরণের শব্দে শেখ হাসিনার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অনেক নাটকের জন্ম দেয়া এ মামলাটি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রাণ ফিরে পায়। তদন্তে বেশ কয়েকবার বাঁক বদলের পর বেরিয়ে আসতে থাকে আসল রহস্য।
দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন আলোচিত গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন।
এ মামলায় মোট ৫২ জন আসামির মধ্যে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। একই সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন দেয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে মোট ১১ আসামিকে। বাকি তিন জনের অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় তাদের এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
এদের মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ৩৩ জন বর্তমানে কারাগারে আছেন। রায় ঘোষণার সময় তারেক রহমান এবং হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জনকে মামলার নথিতে পলাতক দেখানো হয়েছিল। পলাতক এই ১৮ জনের মধ্যে চার জনের নাম ইন্টারপোলের রেড নোটিসের তালিকায় রয়েছে। এরা হচ্ছে, বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, কুমিল্লার মুরাদনগরের বিএনপির সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ নেতা মাওলানা তাইজউদ্দিন মিয়া ও রাতুল বাবু। পলাতক ১৮ জনের মধ্যে পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাইদ হাসান এবং ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার ওবায়দুর রহমান খান আদালতে আত্মসমর্পণ করায় এখন পলাতক রয়েছেন ১৬ জন।
বর্তমানে এ রায়ের বিষয়ে হাইকোর্টে আপিল মামলা শুনানির অপেক্ষায় আছে। সম্প্রতি এ মামলার পেপারবুক আদালতে জমা হয়েছে।
দণ্ডিতরা কে কোথায়?
মুফতি হান্নান
উগ্র ইসলামপন্থী দল হরকাতুল জিহাদের নেতা ছিলেন তিনি। গ্রেনেড হামলা মামলার মূল আসামি তিনি। তার স্বীকারোক্তির মাধ্যমেই গ্রেনেড হামলা মামলায় মোড় ঘুরে যায়। মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তির পর তারেক রহমান এবং লুৎফুজ্জামান বাবরসহ অনেককেই এ মামলার আসামি করা হয়। সিলেটে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তিন জনকে হত্যার দায়ে ২০১৭ সালে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সে গ্রেনেড হামলায় ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী আহত হয়েছিলেন।
তাজুল ইসলাম
মাওলানা তাজউদ্দীন হিসেবে পরিচিত তাজুল ইসলাম আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই। গ্রেনেড হামলার পর তাকে ভুয়া পাসপোর্টের মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। বর্তমানে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন বলে জানা গেছে। গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে তাকে। অভিযোগপত্রে তাকে পলাতক দেখানো হয়েছে।
হারিছ চৌধুরী
বিএনপি সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন তিনি। তৎকালীন সরকারে যাদের প্রভাব অনেক বেশি ছিল হারিছ চৌধুরী তাদের মধ্যে অন্যতম। গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে যাবজ্জীবন শাস্তি দেয়া হয়েছে। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান হারিছ চৌধুরী। বর্তমানে তার অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য নেই। তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ একাধিক দেশে আসা যাওয়া করছেন বলে তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর তাকে আটক করা হয়। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) প্রধান ছিলেন তিনি। গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুর রহিম
তিনি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক। গ্রেনেড হামলা মামলায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনিও এখন কারাগারে আছেন।
লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অবসরপ্রাপ্ত) সাইফুল ইসলাম ডিউক
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবেক এ কর্মকর্তা খালেদা জিয়ার ভাগ্নে। এ মামলায় দীর্ঘ সময় তিনি জামিনে থাকলেও এখন তিনি কারাগারে রয়েছেন।
শহুদুল হক
গ্রেনেড হামলার সময় পুলিশ প্রধান ছিলেন শহুদুল হক। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন। মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ড হয়েছে তার। গ্রেনেড হামলা হওয়ার পর তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রাষ্ট্রপক্ষ। কারণ হামলার পর ঘটনাস্থল একবারও পরিদর্শন করেননি তিনি। শহুদুল হক এক সময় সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। পরে তাকে পুলিশ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর শহুদুল হককে পুলিশ প্রধানের পদে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়।
মোহাম্মদ আশরাফুল হুদা
গ্রেনেড হামলার সময় আশরাফুল হুদা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। পরে ২০০৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত অর্থাৎ চার মাসেরও কম সময় পুলিশ প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন আশরাফুল হুদা। মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আশরাফুল বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
খোদাবক্স চৌধুরী
গ্রেনেড হামলার সময় অতিরিক্ত পুলিশ প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন খোদাবক্স চৌধুরী। পরবর্তীতে তিনি পুলিশ প্রধান হয়েছেন। গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ
বিএনপির টিকিটে কুমিল্লা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া কায়কোবাদ গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। মামলার অভিযোগপত্রে তাকে পলাতক দেখানো হয়েছে। ধারণা করা হয়, তিনি সৌদি আরবে পলাতক রয়েছেন।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এটিএম আমিন
বিএনপি সরকারের সময় তিনি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ছিলেন। পরবর্তীতে সেনা-সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি ডিজিএফআই’র প্রধান হয়েছিলেন। সে সরকারের মেয়াদ শেষ হলে তিনি আমেরিকায় চলে যান। মামলার কাগজপত্রে তাকে পলাতক দেখানো হয়েছে।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) সাইফুল ইসলাম
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। মামলার কাগজপত্রে তাকে পলাতক দেখানো হয়েছে।
তারেক রহমান
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত প্রায় েএক যুগ ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। গ্রেনেড হামালা মামলায় তিনি যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। অভিযোগপত্রে তাকে পলাতক দেখানো হয়েছে।
লুৎফুজ্জামান বাবর
বিএনপি সরকারের সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা লুৎফুজ্জামান বাবর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আটক হন। তখন থেকে তিনি কারাগারেই আছেন। গ্রেনেড হামলা মামলায় তিনি মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামি।
আব্দুস সালাম পিন্টু
বিএনপি সরকারের সময় শিক্ষা উপমন্ত্রী ছিলেন আব্দুস সালাম পিন্টু। তারেক রহমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়। গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ ছিলেন গ্রেনেড হামলা মামলায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসামি। কিন্তু যুদ্ধাপরাধ মামলায় তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় গ্রেনেড হামলা মামলা থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়।
সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সাবেক সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান এবং এএসপি আব্দুর রশিদ বর্তমানে কারাগারে আছেন। এ তিনজন বিএনপি সরকারের সময় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন। গ্রেনেড হামলা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক হানিফ পলাতক রয়েছেন।
বার্তা কক্ষ, ২১ আগস্ট ২০২০