সারাদেশ

গ্রাম ডাক্তারদের বড় ভূমিকা মানতেই হবে করোনাযুদ্ধে

‘আপনিই যা পারেন করেন। মরলে মরব, তবু হাসপাতালে যাব না!’ বললেন চল্লিশোর্ধ্ব গৃহিণী রাজিয়া বেগম (ছদ্মনাম)। রাজিয়ার ১২ দিন ধরে খুব কাশি। আর সহ্য করতে না পেরে এসেছেন বাজারের ফার্মেসিতে। এখানে বসেন তাঁর বহু বছরের পরিচিত ও আস্থার মানুষ গ্রাম ডাক্তার মিজানুর রহমান (ছদ্মনাম)। তাঁদের সবার মিজান ডাক্তার।

মিজান রাজিয়াকে পরামর্শ দিয়েছিলেন শহরে গিয়ে করোনার পরীক্ষা করাতে। তাঁরই উত্তরে রাজিয়া জোর দিয়ে বলেন, কোনোভাবেই তিনি হাসপাতালে যাবেন না।

‘ধরে নিয়ে যাবে’, ‘আত্মীয়স্বজন লাশও দেখতে পাবে না’—এ ধরনের অসংখ্য গুজব উড়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে। আর খবরে দেখা রোগীদের ভোগান্তি এবং চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর কাহিনি তো আছেই। তাই রাজিয়ার মতো অনেকেই আজকাল ভয়ে উপসর্গ লুকিয়ে বাড়িতে বসে আছেন। শরীর বেশি খারাপ হলে এলাকার ফার্মেসি থেকেই যা চিকিৎসা নেওয়ার নিচ্ছেন।

রাজিয়ার কথায় মিজান একটু অপ্রস্তুত হলেন। একটু ভয়ও যে লাগল না তা নয়। সবাই বুঝে ওঠার আগে থেকেই তো তিনি খবরে দেখছেন সারা বিশ্বে করোনার ধ্বংসলীলা। গত দুই মাস জ্বর-কাশির কোনো রোগী দেখলেই ভয় হয়, না জানি করোনার রোগী! নিজের জন্য ভয় পান না তিনি। গত ৩০ বছরে এ পেশার কারণে বহুবার তাঁকে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। শুধু বাড়িতে থাকা বয়স্ক মা–বাবার কথা চিন্তা করে ভয়ে শিউরে ওঠেন। তাঁর পরিবার অনেক করে বলেছে, ফার্মেসি বন্ধ করে বাড়িতে থাকতে। তিনি শোনেননি। শুনবেনই বা কীভাবে? এলাকার মানুষ তাঁকে যে ভালোবাসা আর সম্মান দিয়েছে, তার প্রতিদান দিতে হলেও এই দুঃসময়ে তাঁকে যে থাকতে হবে মানুষের পাশে! বাড়ির সবাইকে আশ্বাস দিয়ে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঠিকই প্রতিদিন সকাল ১০টায় নিয়মমাফিক খুলে বসেন ফার্মেসির চেম্বার।

তাই রাজিয়াকেও তিনি ফিরিয়ে দিতে পারলেন না। বুকের ভেতর আতঙ্ক চেপে রেখেই স্টেথেসকোপ লাগিয়ে একটু দেখে দুটি কাশির ওষুধ লিখে দিলেন। বললেন, তিন দিনের মধ্যে ভালো না হলে জানাতে।

বাংলাদেশে মিজানের মতো গ্রাম ডাক্তার এবং পল্লি চিকিৎসকেরা সব সময়েই প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রোগীর প্রথম গন্তব্য। স্বাভাবিক সময়েও যেকোনো অসুস্থতায়, বিশেষত নিম্ন আয়ের রোগীরা প্রথমে তাঁদের কাছে যান। গ্রামগঞ্জে যেখানে এমবিবিএস ডাক্তার নেই, নেই ভালো ক্লিনিক বা হাসপাতাল, সেখানে যুগ যুগ ধরে ডিগ্রিবিহীন এই ‘চিকিৎসকেরা’ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সমাজের সর্বস্তরে এই নিবিড় ভরসার সম্পর্ক তাদের আজও জনপ্রিয় করে রেখেছে, যার ফলেই হয়তো এই করোনাকালেও যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির গবেষকদের ইনোভেশনস ইন পভার্টি অ্যাকশনের (আইপিএ) গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ করোনার উপসর্গ দেখা দিলে প্রথমে সেবা নিচ্ছেন ফার্মেসিতে বসা এই অনানুষ্ঠানিক চিকিৎসকদের (informal healthcare provider) কাছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই সময়ে তাই গ্রাম ডাক্তাররা আছেন উভয়সংকটে। একদিকে তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা রোগীরা, সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে যাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে যেকোনো মুহূর্তে করোনা সংক্রমণের ভয়। এর মধ্যে নেই কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণ বা প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম। দেশে ডাক্তার এবং নার্সদের জন্যই পর্যাপ্ত সরঞ্জাম আর ট্রেনিং নেই, আর তাঁদের কথা কে ভাববে?

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু যে গ্রাম ডাক্তাররা ঝুঁকিতে আছেন তা ভাবলে ভুল হবে। এমনকি সম্পূর্ণ লকডাউনের সময়ও বেশির ভাগ ফার্মেসি খোলা রয়েছে জরুরি সেবা হিসেবে। একেকজন জনপ্রিয় গ্রাম ডাক্তার দিনে অন্তত ৫০ থেকে ১০০ রোগী দেখেন, বড় ফার্মেসির ক্ষেত্রেও তাই। যদি এর মধ্যে একজন রোগীর কাছ থেকেও আজকে সংক্রমিত হন তাঁদের কেউ, আগামী ১০ দিনে তিনি একাই সংক্রমিত করতে পারেন আরও হাজার রোগীকে। আর যেহেতু করোনা উপসর্গ-যুক্ত রোগীরা এখন আনুষ্ঠানিক খাতে চিকিৎসা নিতে ভয় পাচ্ছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে উপসর্গ লুকিয়ে ফার্মেসি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাই ফার্মেসি থেকে বহু-সংক্রমণ বা super-spreading হওয়ার আশঙ্কা এখন আরও অনেক বেশি।

কাজেই যদি ওষুধ বিক্রেতা এবং বিশেষ করে গ্রাম ডাক্তারদের শিগগিরই প্রশিক্ষণ এবং পিপিইর আওতায় না আনা যায়, দেশের করোনা পরিস্থিতিতে এর ফল হতে পারে মারাত্মক।

তবে এত এত খারাপ খবরের মধ্যে গ্রাম ডাক্তাররা কি শুধুই আরেকটি দুঃসংবাদ? ফার্মেসি বন্ধ করে রাখাই কি এর সমাধান? অবশ্যই নয়! গ্রাম ডাক্তারদের ছাড়া ওই ৭০ শতাংশ মানুষের কী হবে? তাই এই সময়ে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে গ্রাম ডাক্তারদের ভূমিকাকে আরও গুরুত্বসহকারে নিতেই হবে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়াও যখন ঝুঁকিপূর্ণ, তখন অন্যান্য সব প্রাথমিক চিকিৎসা অব্যাহত রাখা, রোগীদের সঠিক পরামর্শ দেওয়া, গুজব প্রতিরোধ করা, করোনা উপসর্গসহ রোগীদের চিহ্নিত করে তাদের আইসোলেশনের ব্যবস্থা করাসহ হাসপাতাল ব্যবস্থা এবং এমবিবিএস ডাক্তারদের ওপর চাপ কমাতে সারা দেশের লক্ষাধিক গ্রাম ডাক্তার হতে পারেন আমাদের দুঃসময়ের বন্ধু। দেশের নিম্ন আয় এবং শিক্ষার মানুষের ভরসার জায়গা হিসেবে তাঁরাই পারেন সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে এই যুদ্ধে শামিল হতে।

মিজানের মতো অসংখ্য গ্রাম ডাক্তার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ইতিমধ্যে তা করছেনও। প্রশ্ন হলো আমরা কি সাধারণ সময়ের মতো তাঁদের অবদান উপেক্ষা করে তাঁদের ঢাল–তরবারি ছাড়াই যুদ্ধে পাঠিয়ে দেব? নাকি সার্বিক প্রশিক্ষণ এবং প্রতিরক্ষা দিয়ে তাঁদের উপযুক্ত সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে তৈরি করে নেব?

ইতিমধ্যে ছোট পরিসরে কিছু কাজ হয়েছে, যা সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে। সাভার উপজেলায় স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগে গ্রাম ডাক্তারদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং পিপিই দেওয়া হচ্ছে যেন তাঁরা করোনার উপসর্গযুক্ত রোগী চিহ্নিত করে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি করোনার কারণে মৃত্যুবরণ করা রোগীদের সঠিক সৎকারও নিশ্চিত করতে পারেন। স্থানীয় সরকারি এ উদ্যোগকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

দ্রুত সারা দেশে এই প্রশিক্ষণ ছড়িয়ে দিতে সহায়ক হতে পারে তথ্যপ্রযুক্তি। সরকারের এটুআই প্রকল্পের সহায়তায়, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের অনুমোদনে এবং জীয়নের উদ্যোগে ইতিমধ্যে একটি অনলাইন প্রশিক্ষণ চালু করা হয়েছে এই অনানুষ্ঠানিক চিকিৎসকদের জন্য। যেখান থেকে এরই মধ্যে ১০ হাজারের বেশি ফার্মেসি এবং গ্রাম ডাক্তার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তবে যেখানে সারা দেশে দুই লাখের বেশি ফার্মেসি আছে, সেখানে এই সংখ্যাটি এখনো নেহাতই অপ্রতুল।

এ ছাড়া প্রাথমিক প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম হিসেবে প্রায় দুই হাজার সেট মাস্ক এবং গ্লাভস দেওয়া হয়েছে জীয়নের নিজস্ব উদ্যোগে। কিন্তু দুই লাখ ফার্মেসিকে সুরক্ষা দিতে প্রতি মাসে প্রয়োজন অন্তত ২০ কোটি টাকার পিপিই, যা জোগাড় করার জন্য সরকারি অনুমোদন এবং সহযোগিতা ছাড়াও প্রয়োজন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিদের পৃষ্ঠপোষকতা, যাদের আর্থিক সামর্থ্যের পাশাপাশি বহু বছরের ব্যবসায়িক সম্পর্কের খাতিরে হলেও ফার্মেসিদের প্রতি নিশ্চয়ই একটা দায়বদ্ধতা রয়েছে। এখন এই করোনা পরিস্থিতিতে সারা দেশের ফার্মেসিতে নিয়মিতভাবে পিপিই পৌঁছে দিতে তাঁদের সরবরাহব্যবস্থার সহায়তাও আবশ্যক।

সাধারণ সময়ে হয়তো আমরা পারি গ্রাম ডাক্তারদের অনানুষ্ঠানিক খাত ধরে নিয়ে বিয়োগের খাতায় রেখে দিতে। কিন্তু তাঁদের সাহায্য ছাড়া এই দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব হলেও দুরূহ এবং অনর্থক। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ অন্তত আগামী দুই বছর চালিয়ে যেতে হবে। অর্থনীতি সচল রেখে এই যুদ্ধ করতে হলে আমাদের উচিত হবে স্থানীয় জনসম্পদের ক্ষমতায়ন এবং ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা’। প্রতিটি এলাকায় এই দুর্গের প্রহরী হিসেবে গ্রাম ডাক্তাররা হতে পারেন আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অন্যতম রক্ষাকবচ।

প্রতিবেদক:শিমুল হাসান,২০ মে ২০২০

Share