শিল্প-সাহিত্য

গ্রাম এক্সপ্রেস : শাহমুব জুয়েল

আসছে ক্রিন ক্রিন এক্সপ্রেস। খোল বাইলের দিন শেষ। নারকেল সুপারি বাগানের বুক কেটেছেটে বাই পথ, যাচ্ছে এবার আলোপথ।

শিশুরা কালো রাস্তা এদুর ওদূর হেসে খেলে। কোল ঘেঁষে সবুজ ধানের মাঠ। মাঠে ঘাটে চিপচিপে শরীরের উঠানামা।কারো কোন ক্লান্তি নেই,অবসর নেই।

কাস্তে, কোদাল, হাইকা এদের সার্ভিস কলকাঠি।

প্রয়োজনবোধে হাতলের ব্যবহার। নরনারী সবাই সংসারের তোষে বেশ খাটে। এদের মধ্য নাসিমা বেগম তাকে কোনদিন কেউ দেখেনি। পর্দার আড়াল থেকে স্বামী সাইমুনকে সহায়তা করে আবার প্রতিবেশীদের কাছেও বেশ নাম ডাক তাঁর। দীর্ঘ দিন তাদের সুখ থাকলেও কোথায় যেন ঘাটতি রয়ে যায়। মাঝে মাঝে চেহারায় শুন্যতার বক্ররেখা দেখা মেলে।।

হঠাৎ একদিন আজান শোনা গেল। ফজরের আযান কিন্তু হঠাৎ টিকটিক শব্দ বেজে ওঠলে নজর গেল দেয়ালে, পনে তিনটা বাজে। তার মানে অন্য কোন খবর। ঠিক সীমা বইন কে দেখা গেল। বাচ্চা-কাচ্চা হলে যার উপস্থিতি সবার আগে। কালি গ্রামে যার হাতে বহু পোলা পান চাঁদ সুরুজের মুখ দেখেছে। সীমা বইন দৌড়ে বাড়ি আসে ঘাটে চ্যাপটা মাইরা বসে এবং জালি দিয়ে শরীর আলতু পালতু জায়গা ঘসে আর বকে মাগো পোলা একখান। কত বছর দাইগিরি করি। অমন কষ্ট আর পাইনি।
ফজরের আজান পড়ে গেল। চুন্নু মিয়া মাওলারে ডেকে ডেকে ঘাটে পা রাখে। খুস খুস শব্দ শোনা যায়।

কে? কে? আমি সীমা বইন- তুই কোনতে এলি। বলতে ই চুন্নু মি.ার পনে তিনটা মনে ভাসে।

ও আযান? কার বাড়ি গো। সাইমুন! থাক কওয়া লাগবে না।

বলতে বলতে সাইমুন হাল ছেড়ে সিএনজি ধরে। দিনভর সিএনজি চালায়। রাতে নারকেল- সুপারির বাগানে একছালা টিনের ঘরে তা রাখে। সকালে মসজিদ থেকে চুন্নু মিয়া দেখলো। ঝফঝফ করে পানি পড়ছে।

দূর থেকে দেখলো বাচ্চা নিহরে তা ঘসামাজা করছে। চেহারাখানা সাইমুন এর মতো,বুঝতে বাকি নেই। সে কে। তবুও বলা হলো তুমি কে? আমি দ্বিতীয় গাড়িওয়ালা, ও তাই। চুন্নু মিয়াা তার উপর দেখে আর ভাবে বাগানে খোলের গাড়ি আমি রাজকুমার ছোটরা টেনে হুররে হুররে বলে চেঁচায়।

আজ ওদের মাঝে কেবল আমি আছি।

সপ্তাহের শেষ দিন। কিস্তি দিতে হবে। সাইমুন ছেলেকে ডেকে ওঠায় বাবা যাও সিএন জি মুচে দাও।বাচ্চা মানুষের ওত সহজে ঘুম কবার হয় না।বহু চেঁচামেচি করে মেহবুব চোখ কছলাতে কছলাতে ওঠে। মায়ের সেলাই মেশিনের তল থেকে কাপড় তুলে পা বাড়ায়। সিএনজি মুচে দেয়। সাইমুন চলে আসে। বলে বাবা তোমাকে আজ আমার সাথে যেতে হবে। তাই বাবা। হু, তিন চার টিপ এদিক সেদিক মারে। কচকচা দু’খান পাঁচ’শ টাকা পায়।

আজ সাইমুুন বেজায় ফুরফুরে। বলে বাবা মেহবুব আজ তোরে আননে বেজায় কামাই করলাম। এ কথা বলতেই গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়।কী হলো বা জান দেহি। সাইমুন প্লাগ ঘসে মেহবুব কে বলে দেখতো মবিল আছে কিনা। দেখতে না দেখতে মেহবুব এর পায়ে গরম মবিল পড়ে।

মেহবুবের চিৎকার আশপাশ কেঁপে ওঠে। সাইমুন লক্ষ্মীপুর জেলা সদর নিয়ে যায়। কিন্তু ডা. নুরুল আফসার ঢাকা রেপার করে।

সাইমুন স্ত্রীকে জানায়। সে দৌড়ে ওয়ার্ডপ খুলে গত ঈদে পাখি ড্রেস সেলাই করে যা পেয়েছে তা এবং বাপের দেওয়া গহনার পুটলি নিয়ে দাঁড়ায় রাস্তার কার্ণিশে। দুধারি সুপারি বাগান মাঝে কালো রাস্তা। খাঁ খাঁ রৌদ্রে খা খা অমরাবতী।

হঠাৎ বখাটেদের শিঁশ এবং কী রে নতুন— তো! দেখি ই না।

এরাস্তা এরাস্তার কুকুরের ঘেউ ঘেউ কারণে স্কুল ছেড়েছে নাসিমা। সেদিন সুপারি নারকেল গাছ কান পেতে শুনতো হজম করতো নাছিমা বহু বছর। নাসিমার কুকুরের শব্দ আসেনি। হুই হুই বলে ছোঁ মেরে নিয়ে। গেলো অ্যাম্বুল্যান্স। কান্নায় কেঁপে ওঠছে রাজপথ।

বার্ণ ইউনিট রাজনীতির দহনে ভরপুর। মানুষ হুরহুর।চিকিৎসা দুরদুর। কী করে সামলাবে সাইমুন-
চারদিকে পোড়া মানুষের চিৎকার।

কেঁপে ওঠছে হাসপাতাল। দেখা গেল ডিউটি ডা. পা নেড়ে কী মাফছেন দৌ গেল সাইমুন।

স্যার আমার ছেলেটা। এবার চোখ বুলে বাঁ দিকে ভ্রু কুচকিয়ে বললেন কয়জন আপনারা তিন জন ও আচ্চা। নাসিমাকে বললেন বাচ্চা কী আপনার। কাঁপা গলায় নাসিমা উত্তর করলো জি। আচ্চা চলে আসুন।

বাবা নেই, মা আমাকে দেখছেন, মায়ের পরনে সুন্দর ড্রেস খুব ভালো লাগছে মাকে।মা নতুন মোবাইল কিনেছেন মিহি সুরে কার সাথে কথা বলছেন।আমাকেও একদিন বলেলেন গেম খেলো বাবা ভালো লাগবে। ভালো লেগেও ছিল। মা আমাকে দেখালে কী করে বিডিও তে কথা বলা চলে।

ভোর রাত দেখি মা মিমিমিটি হাসছেন। আমার মাকে বেজায়। খুশি লাগছে। কিন্তু মা কার সাথে কথা বলছেন। এত রাতেই বা কেন?

মা খাবার মুখে তুলে দিচ্ছেন আমার অবস্থাও আগের চেয়ে একটু ভালো বটে। ডা. নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছেন আঙ্কেল আঙ্কেল বলে বেশ জাগিয়ে তুলছেন। মা এর মুখেও মৃদু হাসি কিন্তু মায়ের দেওয়া খাবার তিন বারের পর হঠাৎ দেখা গেল কার একটি হাত মায়ের হাতের উপর। শব্দ শুনা গেল।কে যেন বলছে একটু সরো আমি দেখছি! নিহরে দেখি ডা. মশায়। এমন দিনের পর দিন বেলা ওবেলা দেখছে ওসব।বাবাকেও দেখছে না। কী হয়েছিল বাবা মায়ের।

হাঁটার চল করে বেরিয়ে পরে মেহবুব ।কেন মা ওমন হয়ে গেলেন কী বা কারণ।

ফার্মঘেট চৌরাস্তা বড় বড় সাইনবোর্ড।

ছোট্ট সাইনবোর্ডে লেখা বাচ্চাদের স্কুল আনা নেয়ার জন্য লোক চাই!
নাসিমা অনেক খুঁজেও ছেলেকে পেলেন না পাগলের মতো ছুটলেন। কিন্তু কোথায় যাবে নাসিমা।

ডাক্তারকে বললেন। ডা.চুপ মেরে বললো। চলো দেখি। নিজ গাড়িতে ডাক্তার চলছেন। হঠাৎ ডাক্তারের ফোন বেজে উঠলো। বলতে শোনা গেলো শেষ করে ফোন দিস। সামনে এগুলে লোকজন জড়ো হয়ে কী দেখছে। নাসিমা নেমে গেলে ভীড়ের মাঝে ফাঁক করে ডুকে পড়লো নাসিমা। দেখে চিৎকার করে উঠলো। কিন্তু ডা.সামলে নিতে বার বার নাসিমাকে। জড়িয়ে ধরলেন। অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হলো।

কিন্তু ততক্ষণে মেহবুব নেই। অ্যাম্বুলেন্স হাই স্পিডে এগিয়ে গেলো। যত চেঁচামেচি করা হলোকে শুনে কার কথা। বকে ঝকে কানের মাছিও নাড়ে না। ডাক্তার এবার রাগত স্বরে বলে থামাও কী পেয়েছো তুমি ওমন করছো কেন? পাই নি পাবো?

কী অমন সাহস তোমার নাসিমা কাঁপছে আর ভাবছে। স্বরটি কেমন চেনা চেনা লাগছে। ঠিক সাইমুনের মতো কিন্তু এ তো সাইমুন নয় তাহলে কে?

অ্যাম্বুল্যান্স হঠাৎ করে হাই স্পিডে চলে। মনে হলো শহরটাকে প্রচ- ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এ শহর হিংসা , জোর, তদবির, মৃদুপ্রাণ, কোমল প্রাণ লুপে নেয়ার শহর, এখানে মমতা, স্বার্থের -শোধের লেন -দেনের, কারো প্রতি দয়া সেটুকুর পেছনে আস্তো স্বার্থ।

গাড়ি থেমে গেল। পিঁপড়ার গাড়ি, মাঝে মাঝে দু চারটি রিক্সা সাইকেল। ধীরে ধীরে গ্লাসের সামনে একটি রিক্সা, সিটে রমণী বসা দেখতে হাজারে একখান। আশে পাশে দুচারটি জোড়া চোখ নিহরে, ভ্রু কুচকিয়ে, ভেলবেলিয়ে তাকিয়ে আছে। আমার পাশে পছন্দ করা লোকটি? সাড়া শব্দ নেই। দেখতেই দেখি জিভ চোঁখ এক করে নড়াচড়া করছে। আমি তার আড়াল। বড্ড হাঁফিয়ে উঠলাম, মনে পড়লো গ্রামের কুকুরের কথা, আমি কী জাতের ফান্দে বগা মারছি নাকি ভাবিয়ে তুললো।

এমন সময় একটি সাইকেল ড্রাইভার সাইকেলের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কী ভাবছে হাই তুলছে। গ্লাসের আয়না পরিস্কারের চলে পেছনটা দেখে নিচ্ছে। এমন একটি সাইকেল মেহবুবের ছিল। আগের ঈদে কথা ড্রেস সেলাই করে কিনে দিয়েছিলাম। ছেলে আমার আড় ধরেছিল মা আগামি ঈদে দেখবে কিরণমালা ড্র্রেস বেরুবে। তুমি বেশ টাকা কামাই করবে। তখন আমাকে ট্যাপ কিনে দিতে হবে কিন্তু।

আজ মেহবুব!
ডাক্তার মনে হলো কেটে পড়তে চাচ্ছে তাই তো নেমে পড়লো। আড়পথে হেঁটে যাবো। গাড়ি একটু এগিয়ে গেল সামনে ওই রিক্সাটি পাশে একটি লোক দাড়ানো কথা হচ্ছে ক্ষীণ গলায়। চেনা গেল ডাক্তার মশায় ওঠে গেল রিক্সায় । আমি কাঁপতে শুরু একি? তাহলে আমি শহুরে কুকুরের ফান্দে পড়ে ঐ রেখে আসা জীবন রুখে দিলাম।

কিছু রিক্সার ফুট ওঠানো। চালচলন বেগতিক বটে। জোড়ান জিনিসে এমন ঘটে না। তাহলে কী কুকুরের দৌরাত্ম্য। যারা খপ্পরে পড়েছে তারা বেরুবে কী করে। ফুরিয়ে গেলে কেউ ছোবেও না
ডাস্টবিনে কত ময়লা ; কেউ কী ওসব রয়।
পাশে এসে হাড্ডিগোনা একটি মহিলা। কিছু চায় , কী চাই! ভিক্ষা বইন। তোমার মত যৌবনে বহু গাড়ি চড়ছি এখন শরীরের বান খাপছাড়া। গাড়িতে কেউ লয় না। কী করবো। দুচারটে যা পাই ওতে খাই। ফুটপাতে হান্দাই থাহি। পথিকের পায়ের চাপে রাত ভাঙ্গে।

হঠাৎ মেহবুব নড়াচড়া দিয়ে ওঠে। অবাক হাত বুলাই। আমার বাজান তুই বাইচ্চা আচোস।কী হইছে। তোর। মা মাগো আমারে রুমাল দিল ওমনিতে ঘুম।

গাড়িয়াল ভাই আমগোরে গ্রামে লইয়্যা যাও।
হিয়ানে অনেক শান্তি।

কালি গ্রাম ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে গ্যাস কারেন্ট স্কুল কলেজ, ই সেন্টার। সবই আছে সময়ে অনেক পরিবর্তন। জমির ভাই টি এস টি কারখানায় চাকুরি করতো সে ও শেষে একদিন গ্রামে এলো আর যায় নি। আরো অনেকে –
গ্রামেই শান্তি।

হঠাৎ গাড়িয়াল ঝর ঝর কইরা পানি চেড়ে দেয়। নাসিমা কয় কী হইছে গাড়িয়াল ভাই।
অমনিতেই গাড়িয়ালের দাঁড়ি খুলে গেল।

: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৬:০০ পিএম, ২০ নভেম্বর ২০১৬, রোবার
ডিএইচ

About The Author

লেখক- শাহমুব জুয়েল
Share