Home / কৃষি ও গবাদি / গ্রামে বসবাসকারী দেশের দুই ধান বিজ্ঞানীর গল্প
গ্রামে বসবাসকারী দেশের দুই ধান বিজ্ঞানীর গল্প

গ্রামে বসবাসকারী দেশের দুই ধান বিজ্ঞানীর গল্প

সেন্টু কুমার হাজং ও মীর আবদুল আজিজ দেশের দুই প্রান্তে বসবাসকারী দুজন কৃষক। একজন থাকেন উত্তর-পূর্বের শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার এক অজপাড়াগাঁয়ে, আরেকজনের বাস দক্ষিণাঞ্চলের বরগুনা জেলার পাথরঘাটায়।

দুজনই উদ্ভাবনী কৃষক। ধানের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন তাঁদের নেশা। এই দুই কৃষকের বাড়ির উঠান অচেনা এক গবেষণাগারের চেহারা নিয়েছে। আঙিনায় নানা রকম মাটির টবে নানা আকৃতির ধানগাছ। বারান্দায় ঝোলানো নানা ধরনের অজস্র প্লাস্টিকের ব্যাগে ধানবীজ। তাতে লেবেল লাগিয়ে ধানের জাত লিখে রাখা হয়েছে।

সেন্টু হাজং ও মীর আবদুল আজিজ নতুন নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করে সেগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন স্থানীয় কৃষকদের মাঝে। মূলত দেশি জাতের বিভিন্ন ধানের মধ্যে সংকরায়ণ ও পরাগায়ন করে তাঁরা এসব জাত তৈরি করেন। আবার উচ্চফলনশীল জনপ্রিয় বিভিন্ন জাতের সঙ্গে দেশি জাতের সংকরায়ণ করে তাঁরা ধানের মধ্যে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যের সূচনা করছেন।

দেশের বিশিষ্ট ধানবিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষক পর্যায়ে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিরাট ইতিবাচক প্রভাব আছে। যদিও উৎপাদনের পরিমাণ ও ফলনকালের দিক থেকে এসব ধান পিছিয়ে থাকে, কিন্তু এসব স্থানীয় উদ্ভাবকের কল্যাণেই দেশি জাতগুলো সক্রিয়ভাবে টিকে থাকছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বাড়ির উঠান যখন গবেষণাগার
১২ বছরে একক প্রচেষ্টায় ১৯ প্রকারের দেশি নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কৃষক সেন্টু কুমার হাজং। নন্নী ইউনিয়নের কতুবাকুড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। বয়স এখন ৪৭ বছর।

সেন্টু হাজংয়ের উদ্ভাবিত সাতটি ধানের নাম দেওয়া হলেও বাকি জাতগুলোর এখনো দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া সংকরায়ণের মাধ্যমে দেশি বিলুপ্ত প্রজাতির ৩৫ প্রকার ধান চাষাবাদ করে সেগুলোর বীজ সংরক্ষণ করছেন তিনি। স্থানীয় শতাধিক কৃষক তাঁর উদ্ভাবিত বীজ নিয়ে চাষাবাদ করে লাভবান হয়েছেন। নতুন নতুন ধানের জাত কীভাবে উদ্ভাবন করতে হয়, সে জন্য কৃষকদের তিনি প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।

এদিকে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার প্রত্যন্ত মাদারতলী গ্রামের ৫৮ বছর বয়সী কৃষক মীর আবদুল আজিজ আট বছর ধরে নিরলস প্রচেষ্টায় আমন ও আউশের দুটি জাত উদ্ভাবন করেছেন। এলাকার কৃষকেরা এ ধানের নামকরণ করেছেন ‘মীর ধান’ নামে। একটির নাম ‘মীর মোটা’, অপরটির নাম ‘মীর-১ ’।

নালিতাবাড়ীর সেন্টু হাজং ধান সংকরায়ণ করে মাটির টবে সেই ধানের বীজ রোপণ করেন। গাছ হলে সেখান থেকে মুঠি মুঠি বীজ সংরক্ষণ করেন। আমন মৌসুমে সেই বীজ ছোট ছোট আকারে খেত (প্লট) তৈরি করে চাষাবাদ করেন। এভাবে নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন চলতে থাকে।
উদ্ভাবনী কৃষক হিসেবে গত বছরের ৬ মে ইস্টল্যান্ড ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ঢাকায় সেন্টু হাজংকে সংবর্ধনা দিয়েছে। ক্রেস্ট ও ১ লাখ টাকার চেক দেওয়া হয়েছে তাঁকে।

অভাবের কারণে সেন্টু হাজং মাধ্যমিক পাস করার পর আর লেখাপড়া করতে পারেননি। ২০০৫ সালে একটি বেসরকারি সংগঠন পাহাড়ি দরিদ্র কৃষকদের নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন শিখিয়েছিল তিন দিনের একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায়। সেটাই সেন্টুর মধ্যে ঘুমন্ত উদ্ভাবক সত্তাকে জাগিয়ে দিয়েছে। এরপর ধানের নতুন জাত উদ্ভাবন তাঁর ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়।

নতুন জাতের ধান
পাইজামের সঙ্গে বিনা-৭ ধানের সংকরায়ণ করে সেন্টু হাজং যে ধান তৈরি করেছেন, তার নাম দেওয়া হয়েছে সেন্টু-১ ‘সুনালো’। দুধবিন্নির সঙ্গে মার্কাবিন্নি সংকরায়ণ করে সেন্টু-৪ ‘বিশালীবিন্নি’। এ রকম উচ্চফলনশীল জাতের সঙ্গে দেশি জাতের আরও বেশ কিছু সংকরায়ণ করেছেন সেন্টু।

এ ছাড়া তিনি চিনিশাইল, তুলসীমালা, চাপাল, পাইজাম, বাইশমুঠি, হরি, স্বর্ণলতা ও রঞ্জিত ধানের সঙ্গে সংকরায়ণ করে নতুন জাতের ধানের বীজ উদ্ভাবন করেছেন। এখনো এই ধানের কোনো নাম দেওয়া হয়নি।

দেশি জাত চিনিশাইল একরে ৩০ থেকে ৩৫ মণ হয়। আর সেন্টু হাজংয়ের উদ্ভাবিত সেন্টুশাইল একরে ফলন হয় ৫০ থেকে ৫৬ মণ। চিনিশাইলের ধানের গাছের উচ্চতা সাধারণত ১৬০ সেন্টিমিটার হয়। ঝড়ে বা বাতাসে গাছ হেলে পড়ে। কিন্তু সেন্টুশাইল উচ্চতায় ১০০ থেকে ১২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। তাই বাতাসে হেলে পড়ে না।

সম্প্রতি সেন্টু হাজংয়ের বাড়িতে গেলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুনেছি, ফিলিপাইনে কৃষকেরা নিজেরাই নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করেন। সেই ধান তাঁরা আবার চাষাবাদ করেন। তাহলে আমরা কেন পারব না? তবে অনেক ধৈর্য থাকতে হয়।’

সেন্টুর উদ্ভাবিত ধানের বীজ এখন তাঁর এলাকা ছাড়াও আশপাশের কয়েকটি উপজেলার কৃষকেরা নিয়ে যেতে শুরু করেছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফ ইকবাল বলেন, হাতের মাধ্যমে পরাগায়ন ও নির্বাচনে (হ্যান্ড পলিনেশন অ্যান্ড সিলেকশন) এককভাবে একক প্রচেষ্টায় সেন্টু হাজং গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তা ছাড়া স্থানীয় জাতের ধানকে আরও উন্নত করার চেষ্টা তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে, সার-কীটনাশক ছাড়াই স্থানীয় দেশি জাতের চেয়ে পাথরঘাটার মীর ধানের ফলন দেড় গুণ বেশি হয়। এ কারণে এলাকার গণ্ডি পেরিয়ে এ ধানের ব্যাপ্তি ছড়িয়েছে পাথরঘাটা, বামনা ও মঠবাড়িয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে।

অচেনা জাতের সঙ্গে বিদেশি জাত
পাথরঘাটার আবদুল আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৭ সালে সিডরের তাণ্ডবের পর মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় পাথরঘাটার কৃষকেরা কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কৃষকদের আবার সক্রিয় করতে তিনি এলাকার অর্ধশতাধিক কৃষককে নিয়ে গড়ে তুলেছেন মাদারতলী কৃষক সংগঠন। আবদুল আজিজ এটির সাধারণ সম্পাদক।

সিডরের পরপর একদিন তিনি আগাছা তুলতে গিয়ে অচেনা একটি ধানের গাছ দেখতে পেয়ে সেটির বীজ সংরক্ষণ করেন। ফলন বেশি বলে এ বীজ তিনি এলাকার কয়েকজন কৃষককেও দেন। কৃষকেরা জানতে চান ধানের বীজের নাম। আজিজ নাম বলতে পারেন না। লোকজন ঠাট্টা করে বলতে থাকেন ‘মীর ধান’।

২০০৯ সালে নেপালের তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে দুই দিনের আন্তর্জাতিক কৃষক সম্মেলনে বাংলাদেশের একমাত্র কৃষক প্রতিনিধি হিসেবে আবদুল আজিজ যোগ দেন। সেখানে ফিলিপাইনের এক কৃষক আবদুল আজিজকে উপহার দেন ‘এম-৭৪-১’ নামের কয়েকটি ধানবীজ। এর সঙ্গে তিনি দেশি ‘বগি আউশ’-এর সংকরায়ণ করান। এভাবে উন্নত আরেকটি জাত উদ্ভাবিত হয়।

উপজেলা কৃষি দপ্তরের কর্মকর্তা ও স্থানীয় কৃষকেরা জানান, সাদা মোটা, লাল মোটা, মোতামোটা, কাজলসাইসহ স্থানীয় জাতের ধানের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ১ দশমিক ৮০ থেকে ২ টন। সেখানে মীর মোটা ও মীর-১ ধানের উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ৩ থেকে ৩ দশমিক ২০ টন।

এ ব্যাপারে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সেন্টু হাজং ও মীর আবদুল আজিজের মতো স্থানীয় পর্যায়ের কৃষকদের এসব উদ্ভাবন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতে ধানের দেশি জাতগুলোর উন্নয়ন ঘটছে। দেশি জাতের ধানের বড় বৈশিষ্ট্য হলো এগুলোর স্বাদ, যা উচ্চফলনশীল ধানে সেভাবে পাওয়া যায় না।

মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম আরও বলেন, এ ধরনের স্থানীয় কৃষকদের উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে গবেষণাগারের আধুনিক গবেষণার সমন্বয় সাধন করা গেলে আরও ভালো ফল পাওয়া যাবে। (প্রথম আলো)

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৪ :০০ পিএম, ৬ জানুয়ারি ২০১৮, শনিবার
এএস