করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর হঠাৎ করে বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার বাতিল, স্থগিত ও পাওনা টাকা আটকে দেওয়ায় বাংলাদেশি এক গার্মেন্টস মালিকের কান্না আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ইপিজেড এলাকায় মোস্তাফিজ উদ্দিন নামে এই পোশাক ব্যবসায়ীর কারখানা ডেনিম এক্সপার্টে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাদের বেতন-বোনাস দেওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন এই কারখানা মালিক পাওনা টাকা আদায়ের জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়েও সফল হননি।
তিনি শুক্রবার বলেন, বরাবরের মতো এবারও ঈদের আগে শ্রমিকদের হাতে বেতন-বোনাস আর ঈদ উপহার তুলে দেওয়ার তাড়না থেকে টানা ১০ দিনের বেশি বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে আসছিলেন। শেষ দিন সকাল ১০টায় ব্যাংকে বসেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন।
বিকাল ৩টার দিকে ব্যাংক থেকে জানানো হয়, ইউরোপ কিংবা আমেরিকা কোনো দেশ থেকেই টাকা আসেনি। তাই আজকে আর কোনো লেনদেনের সুযোগ নেই।
“এ কথা শোনার পর আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। আগের রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি। বুধবার সকালে শেষ কর্মদিবসে শ্রমিকদের কী করে খালি হাতে বিদায় করব তা ভাবতেই আমার কান্না চলে আসে। কিছুক্ষণের জন্য নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি।”
তার কান্নার ছবি দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে অ্যাপারেলইনসাইডার ডটকম নামের একটি ওয়েবসাইট।
২০০৯ সালে চট্টগ্রামে কারখানা বানিয়ে মাত্র কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি অর্জন করেন মোস্তাফিজ উদ্দিন। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ন্যায্য মজুরি, ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ভাতা ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি স্থাপন করে ইউরোপ আমেরিকার ক্রেতাদের নজরে আসেন।
বাংলাদেশি পোশাক শিল্পোদ্যোক্তা ও পশ্চিমা ক্রেতাদের মধ্যে সংযোগ ঘটাতে গত পাঁচ বছর ধরে ট্রেড শো এবং ব্যবসায়ী সম্মেলন আয়োজন করে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন ‘ডেনিম মোস্তাফিজ’ নামে।
কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর গত ফেব্রুয়ারি থেকেই সংকটের শুরু হয়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার পশ্চিমা বিশ্বে পোশাকের চাহিদা যায় কমে।
এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ক্রেতা কোম্পানি আকস্মিকভাবে একের পর এক কার্যাদেশ বাতিল করতে থাকে। অনেকে পণ্য হাতে পেয়েও সেগুলোর দাম আটকে রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর হিসাবে, কোভিড-১৯ মহামারী শুরুর পর বাংলাদেশের ১১৫০টি কারখানার ৩ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে। গত দুই মাস ধরে প্রায় বন্ধ রয়েছে নতুন ক্রয়াদেশ। এতে করে এসব কারখানার প্রায় ২৮ লাখ শ্রমিকের জীবনে আর্থিক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
এই সংকটের শিকার মোস্তাফিজ বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমেরিকার গ্লোবাল ব্র্যান্ড গ্রুপ বা জিবিজির কাছে তার ছয় কোটি টাকার শিপমেন্ট হয়েছে। ফিলিপ গ্রিনের কোম্পানি আর্কেডিয়ার কাছে গেছে ২৫ কোটি টাকা পণ্য। পিকক নামের একটি ব্র্যান্ডের কাছেও প্রায় সমপরিমাণ টাকা বকেয়া পড়েছে। এভাবে গত ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত বিদেশি ক্রেতাদের কাছে প্রায় ৫৪ কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে।
“হাতে গোনা দুই-চারটি কারখানা হয়ত এমন ধাক্কা সমলাতে পারবে। কিন্তু আমার মতো ছোট কারখানাগুলো কী করে টিকে থাকবে,” প্রশ্ন রাখেন তিনি।
প্রায় দুই হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কারখানা ডেনিম এক্সপার্টে প্রতি মাসে শ্রমিকের বেতন বাবদ খরচ হয় দুই কোটি ৬০ লাখ টাকা। কর্মকর্তাদের বেতন, ইউটিলিটি চার্জ আর জমি ভাড়া মিলিয়ে এক মাসে খরচ হয় প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। আর উৎসব ভাতা হিসাবে দিতে হয় প্রায় এক কোটি টাকা।
করোনাভাইরাস সংকটে রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য সরকার স্বল্প সুদের যে ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, সেখান থেকে ঋণ নিয়ে শ্রমিকের এপ্রিলের বেতন দিয়েছেন মোস্তাফিজ উদ্দিন। কিন্তু দীর্ঘ তিন মাস ক্রেতাদের কাছে বকেয়া জমে থাকায় ঈদের বোনাস দিতে গিয়ে সঙ্কটে পড়েন বলে তার ভাষ্য।
মোস্তাফিজ বলেন, “প্রতি বছর ঈদে শ্রমিকদের হাতে উপহার তুলে দিই। তাদেরকে নিয়ে ভালো মানের হোটেলে একদিন বসে ইফতার করি। এবার এসব কিছুই করতে পারিনি। কিন্তু ঈদ বোনাস থেকেও বঞ্চিত রাখতে হবে সেটা ভাবতে পারিনি। শেষ মুহূর্তে পরিচিত বন্ধু-স্বজনদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে তাদের হাতে বোনাস তুলে দিয়েছি।”
সংকটের এই সময়ে শ্রমিকদের বেতনের জন্য সরকার ঋণ দিলেও অনেক কারখানা শ্রমিকের বেতন-বোনাস ঠিকমতো দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। বকেয়া বেতন আর ঈদ বোনাসের দাবিতে গত এক সপ্তাহে ঢাকা, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সড়কে নেমে এসে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকরা।
মহামারীর মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে কারখানার কাজে থেকেও বেতন-বোনাস না পাওয়ার কষ্টের পাশাপাশি ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে কারখানা শ্রমিকদের মনে।
এই সংকটে মালিক-শ্রমিক-সরকার ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে ঈদ উপলক্ষে তিন দিনের ছুটি এবং বোনাসের ৫০ শতাংশ এখন পরিশোধ করে বাকিটা পরে সুযোগমতো দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
ডেনিম এক্সপার্ট কত শতাংশ বোনাস দিয়েছে তা বলতে রাজি হননি মোস্তাফিজ। তবে কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা ‘প্রত্যাশিত’ বোনাস পেয়েছেন। পাশাপাশি ঈদে পেয়েছেন ১০ দিনের ছুটি।
বিদেশি ক্রেতাদের অসহযোগিতার কথা তুলে ধরে মোস্তাফিজ বলেন, “মহামারী শুরু হওয়ার পর ক্রেতারা কোনো আলোচনা ছাড়াই একতরফাভাবে অর্ডারগুলো বাতিল করে দিল, কিছু শিপমেন্ট স্থগিত করে দিল। তারা অর্ডার করল, আমরা পণ্য তৈরি করলাম। এখন তারা টাকা না দিয়ে অর্ডার স্থগিত করল, এটা তো কোনো ব্যবসার পদ্ধতি হতে পারে না।
“আমার আমেরিকার ক্রেতারা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আমাকে তো শ্রমিকের বেতনসহ অন্যান্য খরচ চালিয়ে নিতে হচ্ছে। তাদের উত্তর হচ্ছে, তারা সময় হলে টাকা দেবে। কিন্তু তাদের কখন সময় হবে? সে পর্যন্ত আমার শ্রমিকরা কি না খেয়ে থাকবে? তারা যদি অস্থিরতা শুরু করে?
“এখন বল তো ওদের (ক্রেতাদের) কোর্টে। কারণ এ ধরনের আচরণের ক্ষেত্রে তাদের ধরার জন্য কোনো আইনকানুন তো আমরা তৈরি করতে পারিনি।”
বাংলাদেশের অধিকাংশ রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার সঙ্গে ক্রেতারা একই ধরনের আচরণ করছে বলে অভিযোগ করেন মোস্তাফিজ।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তা নিয়ে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ালেও বিশ্ব সংস্থাগুলো ‘নীরব ভূমিকা’ পালন করায় হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
এই কারখানা মালিক বলেন, “কোনো সঙ্কট দেখা দিলেই আমরা সরকার, বিজিএমইএ এবং কারখানা মালিক এই তিনটি পক্ষের কথা বলা শুরু করি। আইএলও, ইউএন, ইইউ আছে। তারা শ্রমিকদের জন্য এই সঙ্কটে কী করলেন?
“সরকার যেভাবে দিক, যা-ই দিক সেটা সরকারই দিয়েছে। কিন্তু অন্য সংস্থাগুলো কোথায়? এই সঙ্কটে তাদের ভূমিকা কী? আইএমএফ বিভিন্ন জায়গায় একশ বিলিয়ন দুইশ বিলিয়ন টাকা দিয়ে দেয়। এই শ্রমিকদের প্রতি তাদের দীর্ঘদিনের ভালোবাসা রয়েছে। এখন এদের জন্য কিছু একটা করুক না!”
গত বছর ইউরোপ-আমেরিকায় ৩৩টি সম্মেলনে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়ে মোস্তাফিজ বলেন, “কোপেনহেগেন, নিউ ইয়র্ক, লন্ডনে কত সম্মেলনে কথা বলেছি। তাদের কাছে বার বার সমস্যাটি তুলে ধরেছি। ওরা যদি ওদের বায়ারদেরকে চাপ দিত, তাহলে আমাদেরকে ফেব্রুয়ারির টাকা বকেয়া রাখতে হত না।
“এমনকি আমি ইউরোপ-আমেরিকায় আমার পরিচিত প্রভাবশালী সবাইকে বলতে শুরু করলাম যেন বায়াররা সবার সাথে এক ধরনের আচরণ না করে। অনেক বড় প্রতিষ্ঠানের বছরের পর বছর মাল ফেলে রাখার সক্ষমতা আছে। আমাদের মত ছোট কারখানাগুলোর তো সেটা নেই। সর্বশেষ আমি বললাম যে, তোমরা আপাতত শুধু শ্রমিকের বেতন-বোনাসের টাকা দাও।”
তিনি বলেন, “বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো দুর্বল। কারখানা মালিকরা এক্ষেত্রে ভয় পায়। ফলে ক্রেতারা কারখানাগুলোর সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াতে পারে। তারাই আবার শ্রমিকের অধিকার ইস্যুতে কারখানাগুলোকে চাপ দেয়। তারাই টাকা বকেয়া রেখে শ্রমিকদের বিপদে ফেলে।