গানে গানে জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত সুরের ছকিত চাহনির মত পথিকের চলা, মুক্তির উদার্ত আহবান, জীবন পান্তরে গেয়ে গেছেন মুক্তির গান। অপমানিত্বের মর্ম বেদনায় শুধু গান আর গান।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি বিদ্রোহী কবি এবং আধুনিক বাংলা গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে পরিচিত। যার ব্যতিক্রমী বর্ণোজ্জ্বল কবি প্রতিভার জন্যই ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা পাঠকের কাছে হয়েছিল সহজতর। যিনি জন্মের প্রথম প্রহর থেকেই পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা সা¤্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশ তথা বিশ্ববাসীর ওপর শোষণ এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রাম করে গেছেন।
তিনি বিদ্রোহী চেতনায় জেগে ওঠার আহ্বানে মুক্তির গান গেয়েছেন বাবড়ি চুলে যুবা কিশোর নজরুল। শত যন্ত্রনা ও নিষ্পেষনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদের প্রখরতায় মুক্তির গান গেয়ে ওঠতেন যিনি, তারই নাম কাজী নজরুল ইসলাম।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কাজী ফকির আহম্মেদ ছিলেন মসজিদের ইমাম ও মাজারের খাদেম। জীবনের বেশিরভাগ সময়ে দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণার সাথে যুদ্ধ করার কারণে বিদ্রোহী যুদ্ধাকে ‘দুখু মিয়া’ বলে ডাকা হতো।
শিশু বয়সেই পিতৃহারা নজরুল জীবন যুদ্ধে থেমে থাকেননি। শৈশবেই হাজী পলোয়ানের মাজারের সেবক এবং মসজিদের মুয়াজ্জ্বিন ছিলেন। এখান থেকেই ইসলামি ধ্যান ধারণার শিক্ষা অর্জন করেন। তার এ শিক্ষায় নজরুল ইসলামি গজল ও মুসলিম সাহিত্য এবং কাব্য রচনায় উপজীব্য হয়ে ওঠেন।
রুটির দোকানের শ্রমিক নজরুলের আর্বিভাব হয়েছিল লেটো গানের দল থেকে। রাজা প্রজার দৈত নীতি নজরুলকে বিস্মিত, ভস্মিভূত, প্রবাবিত করেছে। মরণ বরণের যন্ত্রনায় নজরুলকে পিঁড়ায়িত করেছে বার বার। মানবমুক্তির বাসনায় পরাধীন শক্তির বিরুদ্ধে তার কন্ঠে বেজে ওঠতো নব তরুণের জয়ের ডঙ্কা।
একদিকে তিনি ছিলেন কঠোর ক্লান্ত বীর অন্য দিকে মানবপ্রেমী। প্রতিবাদের ভাষা এতোই কঠিন ছিল যে ধ্বংসের মধ্যদিয়ে তিনি নতুনের আর্বিভাব কামনা করেছেন। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যিনি ছিলেন সমান দরদী। শ্রেণি বৈষম্যের উর্ধ্বে যার কলম ছিল প্রবল ¯্রােতের ধারা। পরাধীনতার অন্তর্বেদনায় তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। জীবন যুদ্ধে সব সময় তিনি চেয়েছেন মুক্তির উচ্ছ্বাস। মুক্তিবাদী পথের পথিক ছিলেন অজোপাড়া গায়ের ‘দুখু মিয়া’ খ্যাত আমাদের সবার প্রিয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেও নজরুল ছিলেন উদার মানব প্রেমী। তার মুখের শব্দ গান হয়ে বহিঃপ্রকাশ পেয়েছে বার বার।
কাজী নজরুল ইসলাম শৈশবকাল থেকেই লেটো গানের দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর রচিত রাজপুত্রের সঙ, চাষার সঙ, আকবর বাদশা প্রভৃতি লেটো গানের সন্ধান পাওয়া যায়।
লেটো গান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে প্রচলিত এক প্রকার লোকসঙ্গীত। দুখুমিয়ার লেটো গান’ শীর্ষক গ্রন্থটি নজরুলকে নিয়ে আলোচনার নতুন দ্বার খুলে দিয়েছিল। নজরুলের অনেক রচনা এবং সূত্রও পাওয়া গেছে দুখু মিয়ার লেটো গানে। সে সময় লেখা হয়েছিল লেটো-সাহিত্য এবং পরবর্তীতে সেই রচনাসমূহের সাথে আধুনিক সাহিত্যে উক্ত রচনাসমূহের বিস্তৃতায়ন খুলে দিয়েছে সাহিত্যের জন্য নতুন তোরণদ্বার। লেটো গানের দলের প্রধানকে বলা হত গোদা।
দুখু মিয়া লেটো গানের দলে গোদা ও ওস্তাদ ছিলেন কাজী করীম। তার সহযোগিতা-প্রশিক্ষণ পেয়ে দুখু মিয়া নাচ-গান-অভিনয়ে এবং বাদ্যযন্ত্রেও দক্ষ হয়ে ওঠেন। জানা যায়, বজলে করীম গানে সুরারোপ, সং ও পালা পরিচালনা এবং অভিনয় পদ্ধতি দেখিয়ে দিতেন। কবি স্বভাব তার কৈশোরেই উন্মোচিত হতে দেখা যায় লেটো গানে।
কিছুদিনের মধ্যেই গুরুর উৎসাহে ও দলের প্রয়োজনে দুখু রচনা করেন বিভিন্ন পালা, ‘প্রেম গান, ইসলামী গান, ডুয়েট গান, রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গান। হাসির গান ও অন্যান্য গান, হাস্যরসাত্মক সং।’
শুধু তাই নয়, “তাঁর আরও একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তা হলো সং ও পালার সঠিক স্থানে। সঠিক রসের গানের সংযোজন। এসব গান তিনি নিজেই রচনা করতেন। যার জন্য সং ও পালাগুলো আকর্ষণীয় হয়ে উঠতো। লেটোর আসরে হাস্যরসাত্মক নাট্যশ্রিত গান এবং এক মুখো কমিকের প্রচলন তিনি করে গিয়েছিলেন।
বয়সের ভারে বজলে করীম দল ছাড়ার আগে দুখু-কে লেটো দলের ওস্তাদ পদে নিযুক্ত করেন। ওস্তাদ হবার পর তাঁর লেটো দলে আসে নতুন করে গতি।
নজরুল লেটো গানের দলের ওস্তাদ হয়েও থেমে থাকেননি। ১৯১৭ সালের শেষের দিকে নজরুল ইসলাম সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন সময়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। কবির বিশ্ব মানব প্রেমের দৃষ্টিভঙ্গির স্ফূরণ ঘটেছিল পল্টন জীবনে। পল্টন জীবনই তাঁর বিশ্ব দৃষ্টি খুলে দিয়েছিল সমাজের মধ্যে সমস্ত নিচতা, স্বার্থ পরতা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, অসুন্দরতা, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ধর্মীয় গোড়ামী এসবের বিরুদ্ধে।
পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে তিনি এক হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। তাই জাতি ভেদে প্রথা, রাজা-প্রজার অসমতাকে তিনি কখনই মানেন নি। ক্রমেই কবি পরাধীনতার অন্তর্বেদনায় গর্জে ওঠেন। ১৯২০ সালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শেষে কবি দেশে ফিরে এসেই কলকাতায় সাহিত্যিক সাংবাদিক জীবন শুরু করেন।
এ সাংবাদিকতা পেশাতেই নজরুল বিট্রিশ বেনিয়াদের চক্ষুশূল্য হয়ে উঠেন। নবযুগ পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা নিয়ে কলম ধরেছিলেন।
নবযুগ পত্রিকা যখন বাজেয়াপ্ত করা হয় তখনি নজরুল পুলিশর দৃষ্টিতে পড়ে। তারপরও নজরুলের কমল অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর জন্য অবিরাম পথে চলতে থাকে। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে কুমিল্লা উদ্বেলিত। নজরুল ইসলাম আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করে বিভিন্ন সভায় যোগ দিয়ে গাইলেন সদ্যোরচিত ও সুরারোপিত স্বদেশীয় গান:
‘এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো,
বন্ধিনী মার আঙ্গিনায়
আজ রক্ত নিশি ভোরে
একি এ শুনি ওরে
মুক্তি কোলাহল বন্দী শৃঙ্খলে……’
এভাবে সৌখিন গীতিকার ও গায়ক নজরুল ইসলাম কুমিল্লায় অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান এবং পরাধীনতার বিরুদ্ধে জাগরণী গান রচনা ও পরিবেশনার মধ্য দিয়ে স্বদেশী গান রচনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক কর্মীতে পরিণত হন।
একই বছরের ২১ নভেম্বর ভারত ব্যাপী হরতাল ছিল। তখন নজরুল পুনরায় পথে নামেন এবং অসহযোগ মিছিলে গাইলেন গান:
‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও!
ফিরে চাও ওগো পুরবাসী–’
গানের পাখির মতই নজরুল গান গেয়ে বিশ্ব মানবের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন। কারাবন্ধী অবস্থায় তিনি শিকল ভাঙ্গার গান গেয়ে ওঠেছেন। তার গানে সাড়া দিয়ে বিশ্ববাসী জেগে উঠার উচ্ছ্বাস পেয়েছে। জাগরণ দেখা দিয়েছে নিষ্পেষিত মানুষের মধ্যে। দীর্ঘ ৩৪ বছর কবির নির্বাক জীবনে কোন চিকিৎসায় বাকশক্তিকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। দেশ স্বাধীনের পর ২৪ মে কবিকে সপরিবারে দেশে আনা হয়।
গানের পাখি নজরুলের জীবনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট। কবি জীবনের সমাপ্তি ঘটলেও সংগ্রামের অগ্নিবার্ণ কবিকে চির অম্লান করে রেখেছে আমাদের মাঝে।
কবির সুপ্ত-প্রতিভা আজও আমাদের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে প্রতিবাদের বাণী।
লেখকঃ গাজী মাহিন উদ্দিন
সংবাদকর্মী
অধ্যয়নরতঃ চাঁদপুর সরকারি কলেজ (বাংলা বিভাগ)
মেইলঃ pressmohin@gmail.com
মোবাইলঃ ০১৮৫২-৫৩২৪৭৩