মার্কিন শীর্ষ দূতের ইউরোপ সফরের আগে শতাধিক আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা গত বুধবার সতর্ক করে বলেছে, গাজায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ছে। এ সফরে যুদ্ধবিরতি ও ত্রাণ করিডোর নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
২১ মাস ধরে চলা সংঘাতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। গাজার ২০ লাখের বেশি মানুষ চরম খাদ্য সংকটসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঘোর ঘাটতির মুখে পড়েছে।
জাতিসংঘ গত মঙ্গলবার জানিয়েছে, গত মে মাসের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সমর্থিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)’ নামে নতুন সহায়তা উদ্যোগ চালুর পর থেকে জাতিসংঘের ত্রাণ কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়ে।
সংস্থাটি জানায়, জিএইচএফ থেকে ত্রাণ নিতে গিয়ে ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
সেইভ দ্য চিলড্রেন, অক্সফাম, ডাক্তারি সাহায্য সংস্থা এমএসএফসহ ১১১টি সংস্থা এক যৌথ বিবৃতিতে সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমাদের সহকর্মীরা এবং যাদের আমরা সেবা দিচ্ছি, তারা না খেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছেন।’
তারা অবিলম্বে একটি সমঝোতার ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতি, সব স্থল পথ খুলে দেওয়া ও জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মানবিক সহায়তা চালু করার দাবি জানায়।
এর একদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র জানায়, তাদের দূত স্টিভ উইটকফ এ সপ্তাহে ইউরোপে যাচ্ছেন গাজা ইস্যুতে আলোচনা করতে। এরপর তিনি মধ্যপ্রাচ্য সফরেও যেতে পারেন।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস সাংবাদিকদের বলেন, উইটকফ ‘জোরালো আশা’ নিয়ে যাচ্ছেন যে, উভয় পক্ষের সম্মতিতে একটি নতুন যুদ্ধবিরতি এবং সহায়তা প্রবাহে একটি মানবিক করিডোর গঠনের পথ বেরিয়ে আসবে।
গত মে মাসের শেষ দিকে ইসরায়েল দু মাসেরও বেশি সময়ের সহায়তা অবরোধ কিছুটা শিথিল করলেও, গাজার মানুষ এখনো খাদ্য ও মৌলিক চাহিদার ঘাটতির মধ্যে রয়েছেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস গত মঙ্গলবার জানান, গাজায় ইসরায়েলি সামরিক হামলার মুখে ফিলিস্তিনিরা যে ‘ভয়াবহতা’র মধ্যে রয়েছে, তা সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে, গাজা সীমান্তের ভেতরে ও বাইরে টনকে টন সহায়তা সামগ্রী গুদামে পড়ে আছে, কিন্তু সেগুলো গাজাবাসীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ মিলছে না।
ফিলিস্তিনের গাজার কেন্দ্রীয় হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্রতি ঘণ্টায় অপুষ্টির রোগী পাচ্ছেন। গাজা শহরের একটি ৩৫ দিনের শিশু ও দেইর এল-বালাহতে চার মাস বয়সী এক শিশু আল-আকসা শহীদ হাসপাতালে অপুষ্টিতে মারা গেছে। হাসপাতালে এক মা তাঁর সন্তানের শরীর ছুঁয়ে আর্তনাদ করছিলেন,‘আমি দুঃখিত, আমি তোমাকে খাওয়াতে পারিনি। আমার চোখের সামনে তোমাকে মরতে দেখা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।’ প্রতিনিয়ত শিশুদের এমন মৃত্যু দেখতে হচ্ছে গাজার মায়েদের।
এই দুটি ঘটনাই কেবল নয়। গত ৭২ ঘণ্টায় আরও বেশি ঘটনা ঘটেছে। হাসপাতালের চিকিৎসকদের মতে,প্রতি ঘণ্টায় অপুষ্টিতে ভোগা শিশু ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে।
শিশুদের অনাহার থেকে বাঁচাতে বাবা-মায়েরা মার্কিন-ইসরায়েলের তৈরি জিএইচএফ বিতরণ কেন্দ্রে যেতে বাধ্য হন। কারণ, তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। বাবা-মায়েরা বলছেন, নারী-শিশুসহ তারা সবাই ক্ষুধার্ত এবং তারা নিজ সন্তানদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে অক্ষম। অনেক শিশুকে শুধুই পানি খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। কারণ, আটা কেনার সাধ্য তাদের নেই।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় ৫৪ ত্রাণপ্রত্যাশীসহ কমপক্ষে ১৩০ জন নিহত এবং ৪৯৫ জন আহত হয়েছেন। গত ২১ মাসে দখলদার বাহিনীর হামলায় এ পর্যন্ত ৫৮ হাজার ৮৯৫ জন ও ১ লাখ ৪০ হাজার ৯৮০ জন আহত হয়েছেন।
আলজাজিরা জানায়, আরও এক ইসরায়েলি সৈনিক আত্মহত্যা করেছেন। দখলদার বাহিনী জানিয়েছে,এ নিয়ে গত দু সপ্তাহে চারজন সেনার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটল। নরওয়ের বাসিন্দা ও প্রশিক্ষণরত সৈনিকের নাম ড্যান ফিলিপসন। দক্ষিণ ইসরায়েলের একটি প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরে হাসপাতালে মারা যান। ইসরায়েলি গণমাধ্যমের মতে,বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১৯ জন এবং গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ২১ মাসে ৪২ জন সৈন্য আত্মহত্যা করেছেন।
গাজা যুদ্ধের নামে ‘বর্বরতার’ অবসানের আহ্বান জানিয়েছেন পোপ লিও। গত বৃহস্পতিবার গাজার একমাত্র ক্যাথলিক গির্জায় ইসরায়েলি হামলার পর গতকাল রোববার এক প্রার্থনা সভায় পোপ লিও এ আহ্বান জানান। ইসরায়েলি রাজনৈতিক বিশ্লেষক গিডিয়ন লেভি সরকারকে গাজায় জাতিগত নির্মূলের পরিকল্পনার অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার মধ্যাঞ্চলের একটি জনাকীর্ণ অংশ থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ জারি করেছে। যুক্তরাজ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত মানবাধিকার সংগঠন প্যালেস্টাইন অ্যাকশন গ্রুপের ৫৫ জন সদস্যকে আটক করা হয়েছে।
২৪ জুলাই ২০২৫
এজি
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur