গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের আয়োজনে চট্টগ্রাম বিভাগের সাংবাদিকদের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৫ জানুয়ারি (রবিবার) বেলা ১১ টায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এ সভায় চাঁদপুরের চার গণমাধ্যম কর্মী উপস্থিত ছিলেন। এরা হলেন, চাঁদপুর টাইমস এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান বার্তা সম্পাদক মুসাদ্দেক আল আকিব, দৈনিক চাঁদপুর দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মোঃ ইলিয়াস পাটোয়ারী, দৈনিক চাঁদপুর সময়ের বার্তা সম্পাদক আশিক বিন রহিম, দৈনিক ইলশেপাড়ের বার্তা সম্পাদক এস এম সোহেল প্রমুখ।
সভায় চট্টগ্রাম বিভাগের ৮টি জেলার জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমের সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন। সভায় সাংবাদিকগণ বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরেন।
চাঁদপুরের গণমাধ্যম কর্মীদের পক্ষে গণ মাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদের হাতে লিখিত প্রস্তাবনা তুলে দেন মুসাদ্দেক আল আকিব।
প্রস্তাবনা সমূহ:
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ
• আইনগত সংস্কার: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে প্রাসঙ্গিক আইন যেমন “মিডিয়া আইন” সংশোধন বা নতুন আইন প্রণয়ন করা উচিত, যা সরকারের হস্তক্ষেপ থেকে গণমাধ্যমকে মুক্ত রাখবে।
• স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নজরদারি কমানো: গণমাধ্যমের ওপর রাজনৈতিক অথবা প্রশাসনিক চাপ কমানোর জন্য নজরদারি কমাতে হবে।
• গণমাধ্যম স্বাধীনতা রক্ষা কমিশন: একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা উচিত, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ নেবে এবং অভিযোগ শোনার ব্যবস্থা করবে।
বস্তুনিষ্ঠতা এবং নৈতিকতার উন্নয়ন
• সাংবাদিকতার নৈতিক গাইডলাইন তৈরি: সঠিক তথ্য প্রদান এবং বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষার জন্য একটি জাতীয় নৈতিক গাইডলাইন প্রণয়ন করা উচিত।
• সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ: গণমাধ্যম কর্মীদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজন করতে হবে, যাতে তারা তথ্য সংগ্রহ ও পরিবেশনে সঠিকতা এবং নৈতিকতা অনুসরণ করে।
• স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা উন্নয়ন: সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা কোনো ধরনের বাহ্যিক চাপ থেকে মুক্ত থাকে।
গণমাধ্যমের মালিকানা এবং অঙ্গীকার
• মালিকানা বৈচিত্র্য: গণমাধ্যমের মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ একাধিক প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা উচিত, যাতে একক কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তির প্রভাব না পড়ে।
• সংকটকালীন মালিকানার স্বচ্ছতা: গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা ও অর্থায়নের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে জনগণ জানতে পারে কে বা কীভাবে কোন সংবাদ মাধ্যম পরিচালিত হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রণ এবং তদারকি সংস্থা গঠন
• স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা: একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা গঠন করা উচিত যা মিডিয়ার কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করবে এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেবে। এই সংস্থাটি সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীন থাকবে এবং শুধু গণমাধ্যমের মানসম্পন্নতা বজায় রাখার জন্য কাজ করবে।
• ফেক নিউজের বিরুদ্ধে আইন: মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে, তবে এটি যেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিঘ্ন না ঘটায়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার ও ডিজিটাল গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ
• ডিজিটাল নিরাপত্তা: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তথ্যের সঠিকতা নিশ্চিত করার জন্য আরও কার্যকর প্রযুক্তিগত নজরদারি ব্যবস্থা থাকতে হবে।
• অনলাইন গণমাধ্যমের সুরক্ষা: অনলাইন মিডিয়ার ক্ষেত্রে কনটেন্ট মডারেশন প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে হবে, যাতে মিথ্যা তথ্য বা ভুয়া খবর দ্রুত বন্ধ করা যায়।
গণমাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ
• পাঠক বা দর্শকের মতামত: গণমাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পাঠক বা দর্শকদের মতামত প্রকাশের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা সংবাদকর্মীদের কাজের প্রতি তাদের মূল্যায়ন জানাতে পারে।
• গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা: গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতা, স্বাধীনতা ও নৈতিকতা বজায় রাখতে গণমাধ্যমকর্মীদের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা পালন করতে হবে।
এ ধরনের সংস্কারের মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং শক্তিশালী ভূমিকা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ সভায় সভাপতিত্ব করেন। কমিশনের সদস্য অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন, আখতার হোসেন খান, বেগম কামরুন্নেসা হাসান, আব্দুল্লাহ আল মামুন, মোস্তফা সবুজ উপস্থিত ছিলেন। চট্টগ্রাম পিআইডির উপপ্রধান তথ্য অফিসার মো. সাঈদ হাসান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ কামরুজ্জামানসহ বিভিন্ন দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ সভায় উপস্থিত ছিলেন।
কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, সংবাদপত্রকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও বস্তুনিষ্ঠ করার জন্য এ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এ কমিশনের প্রধান লক্ষ্য থাকবে সংবাদ প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিকদের কাজের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের সম্পাদকীয় নীতিমালা নেই। সারা দেশে সম্পাদকীয় মান অভিন্ন ন্যাশনাল স্টান্ডার্ড থাকা উচিত, সব প্রতিষ্ঠান মেনে চলবে ন্যূনতম সাংবাদিকতার নৈতিকতার দিকগুলো- সেরকম কোন কিছু নেই। সেটার জন্য আমরা সম্পাদক পরিষদকে বলেছি।
কমিশন প্রধান বলেন, আমাদের দেশে একই মিডিয়া হাউসকে টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন পোর্টাল, প্রিন্ট ভার্সন বা অনলাইন রেডিওর অনুমতি দেয়া হয়েছে। ফলে একই খবর ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এতে পাঠক ভিন্ন কোন মত বা বৈচিত্র পাচ্ছেন না। এগুলোর সমাধান আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আপনারা আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত mrc.portal.gov.bd এ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মতামত বা সুপারিশ কমিশনের কাছে পৌঁছাতে পারবেন। আপনাদের প্রেরিত মতামত বিবেচনা করে কিভাবে গণমাধ্যমে সংস্কার আনা যায় এ বিষয়ে কমিশন সুপারিশ পেশ করবে।
প্রতিবেদক: মুসাদ্দেক আল আকিব, ৫ জানুয়ারি ২০২৪