Home / কৃষি ও গবাদি / গণকবর এখন পীর সাহেবের খানকাহ শরীফ! চলে নাচ-গানের আসর
গণকবর এখন পীর সাহেবের খানকাহ শরীফ! চলে নাচ-গানের আসর

গণকবর এখন পীর সাহেবের খানকাহ শরীফ! চলে নাচ-গানের আসর

একাত্তরে একই গ্রামের ৪২ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে একসঙ্গে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। সেই সেখানেই তাদের গণকবর দেয়া হয়। আর সেই স্মৃতিময় গণকবরই দখল হয়ে গেছে। সেখানে গড়ে উঠেছে পীর সাহেবের খানকাহ শরিফ।

রাজশাহীর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুস্তম আলী ওই গণকবর দখল করে সেখানে খানকাহ শরিফ গড়ে তুলেছেন। ক্ষোভ ও দুঃখ বুকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া নারকীয় তাণ্ডবের বর্ণনা দিতে গিয়ে এমন অভিযোগ করেছেন সেদিনের সেই ঘটনায় নিহত যুগীশো গ্রামের শহীদ বিভারণ চন্দ্র প্রামাণিকের ছেলে বীরেন্দ্রনাথ প্রামাণিক।

১৯৭১ সালের ২২ অক্টোবর দুপুর অনুমান সাড়ে ১২টা। ঠিক সে সময় অতর্কিতভাবে পাক-হানাদার বাহিনী ঢুকে পড়ে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার যুগীশো ও পালশা গ্রামে। পাক-সেনাদের সঙ্গে থাকা শান্তি কমিটির ইউনিয়ন সমন্বয়কারী আব্দুল আজিজ সরকারের ডাকে সায় দিয়ে ওই গ্রামের সকল মানুষ এসে জড়ো হয় স্থানীয় একটি বাঁশ ঝাড়ের নিচে। এরপর পাকবাহিনী হিন্দুদের আলাদা করে মাটিতে উপর করে শুইয়ে দেয়। আর মুসলমানদের সেখান থেকে চলে যেতে বলে।

এর কিছুক্ষণ পরেই মেশিনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয় তাদের। এ নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাকবাহিনী চলে গেলে সেখানে ওই ৪২ জনের লাশ পাওয়া যায়। এরপর সেদিন ওই বাঁশঝাড়ের নিচেই ৪২ জনকে গণকবর দেয়া হয়।

শুক্রবার সকালে উপজেলার যুগীশো পালশা গ্রামে একাত্তরে ঘটে যাওয়া নির্মম হত্যাযজ্ঞের একমাত্র নিদর্শন দেখতে গিয়ে দেখা যায়, যেখানে ওই ৪২ জনের গণকবর ছিল সেখানে খানকাহ শরিফ নির্মাণ করা হয়েছে। আর তার নাম দেয়া হয়েছে ‘শাহ্ সুফি হযরত তৈয়ব আলীর খানকাহ শরিফ’।

কে এই তৈয়ব আলী? এমন প্রশ্ন করা হলে স্থানীয় অধিবাসী ষাটোর্ধ খোদাবক্স মণ্ডল জানান, তৈয়ব আলীর বাড়ি নাটোরে। প্রায় ১০ বছর আগে তিনি মারা গেছেন বলে শুনেছি। পালশা গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা রুস্তম আলী ছিলেন, তৈয়ব আলীর ভক্ত। সে কারণেই তার গুরুর নামানুসারে এই খানকাহ শরিফের নামকরণ করেছেন তিনি। তবে গণকবরের জায়গা দখল করেই রুস্তম আলী খানকাহ শরিফ নির্মাণ করেছেন বলেও জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে ক্ষমতাধর হয়ে উঠে পালশা গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা রুস্তম আলী। ওই গণকবর সংরক্ষণের জন্য এক লাখ টাকা জেলা পরিষদের মাধ্যমে অনুদান দেয়া হয়। আয়তনের দিক থেকে প্রায় ৪-৫ শতক জমির ওই গণকবরে মাত্র ৬০ হাজার টাকা খরচ করে এক হাত উঁচু সীমানা প্রাচীর দেয়া হয়। সেইসঙ্গে শহিদ হওয়া ৪২ জনের নামফলক লাগানো হয় ওই সীমান প্রাচীরে।

গণকবরের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষেই ছিল রুস্তম আলীর জমি। আস্তে আস্তে তিনি সেখানে বসতি গড়ে তুলেন। তার বসতি স্থাপনের পর বিভিন্ন দিবসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর কোনো ব্যবস্থাই ছিল না গণকবরটিতে। এ কারণে গণবকরের পাশেই জেলা পরিষদের অর্থায়নে আরো একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। যেটি ২০০৬ সালের ২০ অক্টোবর উদ্বোধন করেন তৎকালীন সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফা। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসলে নিরব থাকে রুস্তম আলী।

২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আবারো আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে নওপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে। পদ পেয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি। গণকবরের সীমানা প্রাচীর থেকে স্মৃতি অম্লানটি (৪২ জন শহীদ হিন্দু ধর্মাবলম্বীর নামফলক) ভেঙে এবার পুরো গণকবরটি দখলে নেন তিনি। তবে স্থানীয়দের চাপের মুখে ‘স্মৃতি অম্লান’টি খানকাহ শরিফের দেয়ালে আটকে রাখেন। স্থানীয় হিন্দু অধিবাসীরা এ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলেও রুস্তম আলীর সঙ্গে পেরে উঠেনি।

স্থানীয় গ্রামবাসী মাসুদ রানা জানান, রুস্তম আলীর কথিত ওই খানকাহ শরিফে প্রতি মাসের শেষ বৃহস্পতিবার রাতে গানের আসর বসানো হয়। সারারাত চলে গান। সেইসঙ্গে বসানো হয় গাঁজার হাট। ফলে রুস্তম আলীর কর্মকাণ্ডে অতিষ্ট গ্রামের সাধারণ মানুষ। কিন্তু তার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়না।

তিনি আরো অভিযোগ করেন, রুস্তম আলীর চলাচল দেখলে মনেই হবে না তিনি এতো ভয়ঙ্কর মানুষ। কথিত পির সেজে তার ভক্ত আশেকানদের নিয়ে তিনি এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছেন। দখল করেছেন গণকবর, সরকারি খাস পুকুর ও মানুষের জমি।

শহীদ বিভারণ চন্দ্র প্রামাণিকের ছেলে বীরেন্দ্রনাথ প্রামাণিক অভিযোগ করেন, শান্তি কমিটির ইউনিয়ন সমন্বয়কারী বখতিয়ারপুর গ্রামের আজিজ সরকারের ওপরে আস্থা রাখতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৪২ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে একসঙ্গে একই সময়ে প্রাণ দিতে হয়েছে। রুস্তম আলীও কিছুটা সেই ধরনের মানুষ। তার কথার বিপরীতে গেলেই আবারো একই ঘটনা ঘটতে পারে এমন আশঙ্ক করছেন বলেও জানান তিনি। তবে ওই গণকবরটি দখলমুক্ত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন এমনটাই প্রত্যাশা করেন তিনি।

এ অভিযোগ অস্বীকার করে নওপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রুস্তম আলী দাবি করেন, গণকবরের পাশেই তার জমি রয়েছে। আর গণকবরের জায়গাটি তিনি কিনে নিয়েছেন। তবে কার কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন বা কিনে নেয়া জমিতে কেন নাম ফলক লাগিয়ে রেখেছেন এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি।

তিনি আরো বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে গ্রামের হিন্দুরা। তবে কোনো ষড়যন্ত্রই কাজে আসবে না বলেও জানান তিনি।

সূত্র  : বাংলামেইল

||আপডেট: ১২:০৩  অপরাহ্ন, ২৬ মার্চ ২০১৬, শনিবার

চাঁদপুর টাইমস /এমআরআর