ধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাবেক এক ‘কমরেড’ তিনি। অশীতিপর রাজনীতিক। এক দশক ধরে শেখ হাসিনার ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের ইতি ঘটাতে এখন তিনি লড়াইরত বিরোধীদের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
তিনি ড. কামাল হোসেন। আগামী মাসে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এমন পরিস্থিতিতে অক্সফোর্ডে শিক্ষিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ও বাংলাদেশের সংবিধানের রচয়িতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি নতুন জোট গড়ে উঠেছে। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ আসন্ন নির্বাচনে এই নতুন জোটের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। ড. কামাল হোসেন ৮২ বছর বয়সী একজন আইনজীবী।
তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘কাকা’ ডেকে বড় হয়েছেন। জোট গঠনের বিষয়ে তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র সঙ্গে তার জোট গঠনের সিদ্ধান্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বল্প বয়সী বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসেন। ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও ওই নির্বাচন পরিহার করেছিলেন। নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
এক সাক্ষাৎকারে ড. কামাল হোসেন রয়টার্সকে বলেছেন, গত ৫ বছরে যা ঘটেছে তা নজিরবিহীন। আমরা এর আগে কখনো ৫ বছরের জন্য কোনো সরকার পাইনি, যারা অনির্বাচিত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন তিক্ত বিরোধিতায় লিপ্ত। গত ২৮ বছর তাদের মধ্যেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। এ বছরের শুরুর দিকে দুর্নীতির অভিযোগে জেল দেয়া হয় বেগম খালেদা জিয়াকে, তিনি অবশ্য এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাকে জেল দেয়ার পর থেকে বিএনপি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। আগামী ৩০শে ডিসেম্বর নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে গত মাসেও সংশয় ছিল। ওই সময়ে তারা ও অন্য তিনটি দল নিয়ে একটি নতুন জোট গঠনের ঘোষণা দেয়। এর নাম দেয়া হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এর হাল ধরেন ড. কামাল হোসেন। তিনি নিজেও গণফোরাম নামে একটি দল চালান।
ড. কামাল হোসেন লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন। তিনি বলেছেন, বয়স অনেক বেশি হয়ে যাওয়ায় তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চান না। ড. কামাল বলেন, জোটের অনেকেই তাকে গোপনে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে তুলনা করছেন। দুর্নীতির অভিযোগে দুষ্ট নাজিব রাজাককে পরাজিত করার পর এ বছরের শুরুর দিকে মালয়েশিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ করেন ৯২ বছর বয়সী মাহাথির। এ প্রসঙ্গে সরল মন্তব্য ড. কামাল হোসেনের। তিনি মাহাথির সম্পর্কে বলেন, হয়তো তিনি আমার চেয়ে বেশি সুস্থ আছেন।
‘বিদ্রোহ নয়’
বৃটিশ শাসনের সময়ে একজন চিকিৎসক পিতার ঘরে ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন ড. কামাল হোসেন। সেটা ভারত ও পাকিস্তান ভাগের আগের কথা। এরপর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান ভেঙে জন্ম হয় বাংলাদেশের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশাপাশি তাকেও জেলে পাঠানো হয়েছিল। পরে তিনি বঙ্গবন্ধুর অধীনে দেশের প্রথম আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে আওয়ামী লীগ ছেড়ে আসেন। আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গণফোরাম নামে আরেকটি দল গঠন করেন। পরে তিনি জাতিসংঘে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। বিএনপির ভেতরের সূত্রগুলো বলছেন, ড. কামাল হোসেনের আন্তর্জাতিক অবস্থান ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাবমূর্তির কারণে তাকে জোটের সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।
বিএনপি’র পক্ষ নেয়ার ফলে তিনি নিজেকে শেখ হাসিনার টার্গেটে পরিণত করেছেন। এদিকে, নিষিদ্ধ ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক রয়েছে। এই দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। যুদ্ধাপরাধের দায়ে এ দলটির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
নতুন জোট গঠন করার কয়েকদিন পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন যে, ড. কামাল হোসেন খুনিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এমন অভিযোগের জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, হ্যাঁ, বিএনপি এমন অনেক কাজ করেছে যার আমি কখনোই সমাদর করি না। তারা রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা প্রবেশ করিয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু তিনি বলেন, তার জোট হবে ধর্মনিরপেক্ষ। জামায়াতে ইসলামীর মতো গ্রুপগুলোর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
অনেকেই প্রশ্ন করেন যে, বাংলাদেশের নোংরা রাজনীতির জন্য যেমন চরিত্র দরকার তেমনটা তার মধ্যে আছে কিনা। তার সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, তিনি কোনো বিদ্রোহী নেতা নন। তিনি সংবিধানের অধীনে একজন ক্লাসিক আইনজীবী। তিনি যা করবেন তা আইন মেনে। আমাদের রাজনীতিতে এটা তার জন্য একটা প্রতিকূলতা- আমার মতে, এটাই হলো তার প্রধান দুর্বলতা।
এক ব্যক্তির রাষ্ট্র
কিছু কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক পূর্বাভাস দিচ্ছেন যে, নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিরোধী একটি শক্তিশালী সেন্টিমেন্ট দেখা দেবে। বিরোধীদলীয় বিপুল সংখ্যক সদস্যকে আটক করা হয়েছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করেছে বিএনপি। এ ছাড়াও শেখ হাসিনার সরকার তার সমালোচকদেরও পিছু নিয়েছে। যেমনটা হয়েছে সুপরিচিত ফটোসাংবাদিক ড. শহিদুল আলমের ক্ষেত্রে। তাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য করার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়। ড. কামাল হোসেনের মেয়ে সারা হোসেনও একজন সুপরিচিত আইনজীবী। তিনি গত সপ্তাহে শহিদুল আলমের জামিন প্রাপ্তিতে সহায়তা করেছেন।
শেখ হাসিনা এমন সব আইন প্রণয়ন করেছেন যার বিষয়ে অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলছে, তিনি এর মাধ্যমে যে ক্ষমতা পেয়েছেন তা ব্যবহার করা হবে ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে এবং মিডিয়ার গলা টিপে ধরা হবে। এসব আইনকে ‘পূর্ব পরিকল্পিত প্রচেষ্টা’ বলে আখ্যায়িত করে ড. কামাল হোসেন বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে দেশকে শুধু একদলীয় রাষ্ট্র হিসেবেই গড়ে তোলা হচ্ছে না, বরং ‘এক ব্যক্তির রাষ্ট্রে’ পরিণত করা হচ্ছে। সমালোচকদের টার্গেট করা হবে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আল্লাহ না করুন যদি আগামী নির্বাচনে বর্তমানে যেমন কর্তৃত্ববাদী সরকার আছে তা টিকে থাকে, তাহলে বাস্তব বিপদের কারণ রয়েছে। আমাদের অনেকে এই দেশে আর থাকতে পারবেন না।
তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মিডিয়ার স্বাধীনতা খর্ব করার অভিযোগ অস্বীকার করেছে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি তারা বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোকে ‘আইনসিদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
এর আগের নির্বাচনগুলো সহিংসতা, ব্যালট পেপারে সিল মারা ও ভোটারদের ভীতি প্রদর্শনের কারণে বিঘ্নিত হয়েছে। ড. কামাল হোসেন বলেন, তার জোট প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে বেশকিছু ‘পর্যবেক্ষক’ রাখবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক চাওয়ার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু তিনি যদি হেরেও যান তাতে তার আশা পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে না। ড. কামাল হোসেন বলেন, আমি মনে করি না একটি খারাপ নির্বাচন দীর্ঘস্থায়ী হবে। আমি মনে করি, উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বৈরাচাররা বুঝতে পারেন না যে, আমাদের দেশবাসীর রক্তে গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রুতি কতটা গভীরে প্রোথিত।
জেবা সিদ্দিকী, রুমা পাল, রয়টার্স
২৯ নভেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার