রাজনীতি

খালেদা জিয়ার জামিন শুনানিতে এরশাদের বিয়ের প্রসঙ্গ

আজ সোমবার দুপুর আড়াইটার দিকে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন মঞ্জুর করে তাঁকে চার মাসের জামিন দেন।

একইসঙ্গে আগামী চার মাসের মধ্যে পেপারবুক তৈরির জন্য হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

চারটি যুক্তি আমলে নিয়ে খালেদা জিয়াকে জামিন প্রদান করেন আদালত। সেগুলো হলো — এ মামলায় খালেদা জিয়াকে সংক্ষিপ্ত পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত সাত বছরের কম মেয়াদের সাজা হলে জামিন পাওয়া যায়।

দ্বিতীয়ত, মামলাটি শুরু থেকেই মোকাবিলা করে আসছেন খালেদা জিয়া। তৃতীয়ত, শুরু থেকেই তিনি জামিনে ছিলেন এবং জামিনের অপব্যবহার করেননি। চতুর্থত, তাঁর বয়স ৭৩ বছর, দীর্ঘদিন ধরে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ভুগছেন তিনি।

এর আগে দুপুর ১টার পর থেকে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামীপক্ষের আইনজীবীদের ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে বিচারকক্ষ। একপাশে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, অপরপাশে খালেদা জিয়ার প্রায় কয়েকশ আইনজীবী আদালত কক্ষে উপস্থিত হন। তবে, আদালত এজলাসে ওঠার আগেই একজন পেশকার আইনজীবীদের ডেকে এই বলে সতর্ক করে দেন — ‘আদালত বলেছেন আপনারা হৈ চৈ করবেন না। তাহলে বিচারক এজলাসে উঠবেন না।‘ পরে আইনজীবী জয়নুল আবেদীন সহকর্মীদের কোনো হৈ চৈ বা শব্দ না করার জন্য সতর্ক করে দেন। এরপর দুপুর ২টা ১৪ মিনিটে এজলাসে আসেন বিচারপতিরা। তখন বিচারকক্ষে থাকা কয়েকশ আইনজীবী পিনপতন নিরবতা বজায় রেখে আদেশের জন্য অপেক্ষায় থাকেন।

শুরুতেই খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের উদ্দেশে বিচারক বলেন, ‘আপনারা কিছু বলবেন কি?’

এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, ‘মাই লর্ড (মামলাটি) শুনানি শেষে আদেশের জন্য (অপেক্ষায়) রয়েছে।’

জবাবে আদালত বলেন, ‘আপনারা তো অনেক বই নিয়ে আসলেন; কিছু বলতে চাইলে বলতে পারেন।’

এ সময় আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, ‘মি. অ্যাটর্নি, আপনি কিছু বলবেন?’

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল দাঁড়িয়ে বলেন, ‘মাই লর্ড, এটি একটি সেনসেশন (স্পর্শকাতর) মামলা। এ মামলার নথি ইতোমধ্যে এসে গেছে। তাই, নথি দেখে শুনানির পর জামিন আদেশ দেওয়া হোক।’

আদালত বলেন, ‍‌’কি ধরনের সেনসেশন মামলা?’

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটি একটি দূর্নীতির মামলা। এখানে এতিমের টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আত্মসাত হয়েছে। সাবেক নথিতে সব পরিস্কার, কিভাবে টাকা আত্মসাতের জন্য উত্তোলন করা হয়েছে। তাই আমি বলবো, এ মামলার আদেশ আরো দুইদিন পর দেওয়া হোক।’

এ সময় আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাই লর্ড, দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) আইনজীবী জামিন না দেওয়ার জন্য ইতোপূর্বে দুটি যুক্তি দিয়েছিলেন। আমরা এসব মামলার নথি এনেছি। এখানে দেখা গেছে, ওই সব মামলায় আসামীদের হাইকোর্টের একক বেঞ্চ জামিন দিয়েছিলো।’

এই বলে তিনি আদালতে দুটি মামলার নথি বাড়িয়ে দেন।

এ সময় আদালত দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খানকে বলেন, ‘আপনি কিছু বলবেন?’

তখন দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘এ মামলায় উনি (খালেদা জিয়া) সব মিলিয়ে আড়াই মাসের মতো কারাভোগ করছেন। উনি এ মামলায় প্রধান অভিযুক্ত আসামী। এক বছর বা দুই বছর জেল হলে কথা ছিলো। সাজার পরিমাণ কম, এ বিবেচনায় জামিন দেওয়া উচিত হবে না। এটা জামিন দেওয়ার গ্রাউন্ড হতে পারে না। তাঁর (খালেদা জিয়ার) শারীরিক অসুস্থতার বিষয়ে কোন মেডিকেল সার্টিফিকেট দেখানো হয়নি।’

এ সময় আদালত বলেন, ‘এ শুনানি তো আপনি আগেও করেছেন। নতুন কি আছে সেটা বলুন।’

এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ.জে. মোহাম্মদ আলী আদালতে বলেন, আগে খালেদা জিয়া অসুস্থ ছিলেন। এই অসুস্থতার কারণে তিনি হাঁটাচলা করতে পারেননি।

এ সময় আদালত দুদকের আইনজীবীকে বলেন, ‌‘উনাকে পাঁচ বছর সাজা দেওয়া হয়েছে। আপনারা কি রায়ের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন?’

জবাবে খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘আমরা রায়ে অসন্তুষ্ট।’

আদালত বলেন, ‘আপনারা কোনো আপিল করেছেন?’

জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘আমরা রায়ের নথি দেখছি। কেননা এ মামলায় আপিল করার জন্য ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সময় রয়েছে।’

এ সময় আদালত বলেন, ‘সোজা কথায় বলেন, আপনারা রায়ের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কিনা?’

জবাবে আইনজীবী বলেন, ‘এখনো নিইনি, তবে আমরা রায়ে সন্তুষ্ট না।’

এ সময় আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, ‘উনি তো (খালেদা জিয়া) ফিজিক্যালি ফিট না।’

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সাবেক একজন প্রেসিডেন্টও (হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ) পাঁচ বছর জেলে ছিলেন।’

পরে আদালত বলেন, ‘ওই সময় উনার বয়স কত ছিলো?’

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ’উনার বয়স ৬৫ কিংবা ৬৬ হবে।’

এ সময় আদালত বলেন, ’উনি তো অনেক সামর্থ্যবান ছিলেন। উনি পরে কারাগার থেকে বের হয়ে বিয়ে করলেন। একটি পুত্র সন্তানও হয়েছে শুনেছি।’

এ সময় বিচারকক্ষে কিছুটা হাসির রোল পড়ে যায়।

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘উনি সামর্থ্যবান ছিলেন। খালেদা জিয়াও সামর্থ্যবান রয়েছেন।’

এ সময় আদালত বলেন, ‘যাইহোক আমরা আদেশ দিচ্ছি।’

এরপর আদালত বলেন, আমরা আইনজীবীদের শুনানিগুলো লিখিত আদেশে দিয়ে দিবো। এখানে শুধু আদেশ দিচ্ছি।’

পরে আদালত চারটি যুক্তি দেখিয়ে খালেদা জিয়ার চার মাসের জামিন আদেশ দেন এবং চার মাসের মধ্যে পেপারবুক তৈরির জন্য হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখাকে নির্দেশ দেন।

এ সময় বিচারকক্ষের দরজায় অবস্থান করা আইনজীবী ও নেতাকর্মীরা আনন্দে বিভিন্ন শ্লোগান ও উল্লাস প্রকাশ করতে থাকেন। এ ছাড়া বিচারকক্ষের বাইরে এসে আইনজীবী ও নেতাকর্মীরা বিভ্ন্নি শ্লোগান দিয়ে আনন্দ মিছিল বের করেন।

এর আগে, গতকাল রোববারই এই আবেদনের আদেশ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশেষ আদালতের রায়ের নথি হাইকোর্টে না পৌঁছায় আদালত আদেশের জন্য আজকের দিন নির্ধারণ করেন। পরে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে নিম্ন আদালত থেকে রায়ের নথি হাইকোর্টে এসে পৌঁছে।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়। এরপর পুরান ঢাকার পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারকে বিশেষ কারাগার ঘোষণা দিয়ে খালেদা জিয়াকে সেখানে রাখা হয়।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল দায়ের করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। এর পরই গত ২২ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় নিম্ন আদালতের দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার করা আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে জামিন আবেদনের ওপর শুনানির জন্য ২৫ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করেন। সেইসঙ্গে স্থগিত করেন খালেদা জিয়ার অর্থদণ্ড।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি হয়। শুনানি শেষে খালেদা জিয়ার মামলার নথি নিম্ন আদালত থেকে হাইকোর্টে এসে পৌঁছানোর পরই আদেশ দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।

এ মামলায় মোট আসামি ছয়জন। তার মধ্যে তিনজন পলাতক। এই তিনজন হলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

২০১০ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুদকের উপপরিচালক হারুন-আর রশিদ। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়।

মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন—মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।তিনি বলেন,খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালতের এই আদেশের পর খালেদা জিয়ার জামিনে কারামুক্তির প্রক্রিয়া হলো, হাইকোর্টের এই জামিন আদেশটি লিখিতভাবে রায় প্রদানকারী আদালতে যাবে। এরপর রায় প্রদানকারী আদালতে একটি বেইল বন্ড (জামিননামা) দাখিল করতে হবে।

ওই বেইল বন্ড জমার পর বিচারিক আদালত কারাগার বরাবর একটি রিলিজ অর্ডার পাঠাবে। সেই অর্ডার হাতে পাওয়ার পর খালেদা জিয়া জামিনে কারামুক্ত হবেন বলেও তিনি জানান। (উৎসঃ এনটিভি)

Share