মামলা-হামলা, জেল-জুলুম সহ্য করে, দলের দুঃসময়ে কাণ্ডারির ভূমিকা রেখেও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ‘গুডবুকে’ নেই দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
গত শুক্রবার ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে একে একে দলের সবার নাম ধরে প্রসংশা করলেও ঘুণাক্ষরে নিজের মহাসচিবের নাম উল্লেখ করলেন না খালেদা। এতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন দলের নেতাকর্মীরা।
বিগত কয়েক বছরে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দলের জন্য যেসব শীর্ষনেতা নানা ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ও প্রধান ব্যক্তি হিসেবে এরইমধ্যে পরিচিতি পেয়েছেন মির্জা ফখরুল। শুধু নিজ দলই নয়, অন্যান্য দল ও ব্যক্তির কাছেও ফখরুলের স্বচ্ছ, ত্যাগী ও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন নেতা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু নিজ দলের চেয়ারপারসনের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা কেন এত ধোঁয়াশায় ভরা? এমন প্রশ্ন অনেকের।
শুক্রবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারর্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ছাত্রদলের ৩৭তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর ছাত্র সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পৌনে এক ঘণ্টার বেশি বক্তৃতা রাখেন। সেখানে তিনি ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের নানা নির্দেশনা দেন এবং সংগঠনটিকে নিয়ে তার আশা ও পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করেন। একইসঙ্গে ক্ষমতার বিপরীত মেরুতে থাকা বিএনপির বিভিন্ন নেতাদের মূল্যায়নও করেন তিনি।
এসময় দলের নেতাকর্মীদের চিকিৎসা সেবায় সব সময় সচেষ্ট থাকেন বলে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনের প্রশংসা করেন খালেদা জিয়া।
দলীয় প্রধানের মুখে এরকম প্রসংসা শুনে হয়তো কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন ডা. জাহিদ। বেগম জিয়া যখন তার প্রশংসা করছিলেন তখন দর্শক সারির সামনে বসে থাকা জাহিদ মাথা নীচু করে ছিলেন।
আইনজীবীদের প্রশংসা করতেও ভুলেননি খালেদা জিয়া। এ ক্ষেত্রে তিনি ‘অনেকের নাম বলা লাগে’ বললেও শুধুমাত্র যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহাবুব উদ্দিন খোকন, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার, গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়ার নাম উল্লেখ করেন।
আইনজীবীদের তালিকায় প্রথমে নিজের নাম শুনতে না পেয়ে গ্যালারির দ্বিতীয় সারিতে বসা সানাউল্লাহ মিয়াকে কিছুটা গম্ভীর থাকতে দেখা যায়। পরে নিজের নাম শুনতে পেয়ে স্মিত হাসি হাসেন সানাউল্লাহ মিয়া। আর একই সারিতে বসা মাসুদ আহমেদ তালুকদার তো খুশিতে দলীয় প্রধানের উদ্দেশ্যে একাধিকবার সালাম প্রদর্শন করে যাচ্ছিলেন।
১৫৩ সদস্যের আংশিক কমিটি দিয়েই প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করতে হয় ছাত্রদলের। কমিটি গঠনের পরই এ নিয়ে বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে। তবে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর এ অনুষ্ঠানে বিদ্রোহী নেতাদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে।
ছাত্রদলে যাদের জায়গা হবে না তাদের অন্যান্য জায়গায় মূল্যায়ন করা হবে এমন আশ্বাস দেন খালেদা জিয়া।
বিএনপির যুব বিষয়ক সম্পাদক ও যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের নাম উচ্চারণ না করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘তার এখন যুবদলের বয়স নেই। সে এখন এমপি নির্বাচন করবে। তার নিজেরও যুবদলে থাকার ইচ্ছে নেই বলে আমাকে জানিয়েছে।’
আত্মগোপনে থাকা হাবিব উন নবী খান সোহেলকে নিয়ে কথা বলেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ‘সোহেলও খুব ভালো। ছাত্র দলের সভাপতি ছিলো। আমি তার কাজ দেখেছি। তাকে মূল্যায়ন করে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি করা হয়েছে। এখন তাকে মূল দলের আনা হবে। সিটি বিএনপিতে তাকে মূল্যায়ন করা হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন যখন নেতাদের নাম ধরে এভাবে কথা বলছিলেন তখন হলরুম জুড়ে করতালির ধুম পড়ছিলো।
নেতাদের নিয়ে দলীয় প্রধানের মূল্যায়নের সময় দর্শক সারির মাঝামাঝি দিক থেকে বলা হচ্ছিলো মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব হিসেবে দেখতে চাই।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের দুঃসময়ে কঠিন দায়িত্ব পালন করছেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি বার বার কারাভোগ করছেন। তাকে নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন কোনো কথা না বলায় কারে কারো মুখে অভিমানের সুর লক্ষ্য করা গেছে।
দর্শক সারির প্রথমে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ থাকলেও তার নাম উচ্চারণ করেননি খালেদা জিয়া। এছাড়াও এক সময়ে ঢাকার দুই দাপুটে নেতা মির্জা আব্বাস এবং সাদেক হোসেন খোকার বিষয়েও কোনো কথা বলেননি বিএনপি চেয়ারপারসন।
মওদুদ, আব্বাস, খোকার নাম না তোলাতে উপস্থিত নেতাকর্মীদের মধ্যে তেমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও ফখরুলের নাম মুখে না নেয়ায় একটা চাপা অসন্তোষ লক্ষ করা গেছে গোটা হলরুমে।
অনেককে বলতে শোনা গেছে, দলের দুঃসময়ের কাণ্ডারি যিনি, সর্বজনে যার বিপুল গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, সেরকম একজন নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাকে রাজনীতির মাঠে কত অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে। তারপরও খালেদা জিয়ার কাছে তিনি আস্থাভাজন হতে পারলেন না। তার বুকে জায়গা করতে পারলেন না। এটা স্বাভাবিকভাবেই বিস্মিত ও অসন্তুষ্ট করেছে দলীয় নেতাকর্মীদের।
ছাত্রদলের ওই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মামুনুর রশিদ মামুন।