আত্মজীবনীমূলক বই লিখেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বইটি লিখতে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় লেগেছে তার। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় উপলক্ষে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। ৮৮০ পৃষ্ঠার এ বইয়ে শৈশব, কৈশোর, সামরিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবনে প্রেম, বিয়ে, পারিবারিক অনেক কথা তুলে ধরেছেন তিনি। বইয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আছে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বগুণ ও তার জনপ্রিয়তার আকর্ষণীয় বর্ণনা। হাজার টাকা মূল্যের এ বইটিতে জিয়াউর রহমান হত্যায় জেনারেল আবুল মঞ্জুরের সম্পৃক্ততা এবং সঙ্কটময় ওই সময়ে গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে তার ভূমিকার সব ইতিবৃত্ত তুলে ধরেছেন। এছাড়া বইয়ে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে বিচারপতি শাহাবউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকাও। ওই সরকার ব্যবস্থার ব্যাপক সমালোচনাও করেছেন সাবেক এ প্রেসিডেন্ট।
এরশাদের আত্মজীবনী ‘আমার কর্ম আমার জীবন’ গ্রন্থের আমাকে কারাগারে পাঠিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন দুই প্রধান দলের দুই শীর্ষ নেত্রী অধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ে আজকের আয়োজন।
জেলখানায় আমার একটা নতুন নামকরণ হলো কয়েদি নম্বর ৪১৮০। যার শাস্তি ১০ বছর, অস্ত্র মামলায়। আমার সেলের গেটের চাবির নম্বর ছিল ৩১৬। প্রতিটি বিষন্ন বিকেলে এই চাবিতেই বিকট শব্দে বন্ধ হয়ে যেতো আমার সেলের লৌহ কপাট। আবার পরের দিন সকালে ওই ৩১৬ নম্বর চাবি দিয়েই খোলা হতো সেলের তালা।
দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিতে আমি স্বৈরাচার ছিলাম। অবশ্য তারাও একে অপরকে স্বৈরাচারী সরকার কিংবা ফ্যাসিবাদী সরকার হিসেবেই অভিহিত করে থাকে। তবে তাদের দৃষ্টিতে আমি স্বৈরাচার হলেও কোনোদিন শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ও বেগম জিয়াকে কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করে রাখিনি। তাদের আন্দোলন যখনই নৈরাজ্যের রূপ নিতো, তখনও কেবলই জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনবোধে নিজ নিজ গৃহেই অন্তরীণ করে রেখেছিলাম।
অন্তরীণ থাকা অবস্থায় তারা বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার মতো গণমাধ্যমকেও সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। আমি কোনো বাধা দিইনি, তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় অন্তরায় সৃষ্টি করিনি। ইচ্ছে করলে আমি তাদেরকে বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে বিপাকে ফেলতে পারতাম, যা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ নিয়ে ‘হুকুমের আসামি’ করে অনেক মামলা দায়ের হতে পারতো। আমি সে পথে পা বাড়াইনি। অথচ আমাকে গুলশানের সাব-জেলে বন্দি রেখেও তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ হয়নি।
এই আমাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর জন্য তারা উঠে পড়ে লাগলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সাথে দেখাও করলেন। আমার ওপর বিএনপির রোষ ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ এতোই প্রবল ছিল যে, শীর্ষ নেত্রী বেগম জিয়া প্রায়ই খোলামেলা বলে বেড়াতেন, ‘এরশাদ আর জীবনে কারামুক্ত হবে না। তাকে জেলেই মরে পঁচতে হবে।’
এরশাদ তার বইতে লিখেছেন, জেল কোডে বলা হয়েছে, সূর্যাস্তে জেলের ‘সেল’ লক হয়ে গেলে পরদিন ভোরের আগে তা খোলার বিধান নেই। অথচ ১৮ এপ্রিল (’৯১) তারিখে রাত ১১টায় যখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল পুরো ঢাকা শহর, তখন আমাকে গুলশান সাব-জেল থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয় এবং রাত সোয়া এগারোটায় জেলের পুরনো সেলে পৌঁছানো হয়। কারণ, দিনের আলোকে ওদের বড় ভয় ছিল। ওরা ভয় পেয়েছিল দিনের মানুষকে, মানুষের ভিড়কে, জনতাকে। তাই অন্ধকারের চাদরে ঢাকা রাতে, লোকচক্ষুর আড়ালে আমাকে নিয়ে যায় কেন্দ্রীয় কারাগারে।
আমার প্রিয় সকল মানুষ- আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, আমার প্রিয় বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের মানুষের কাছ থেকে, সবুজ বৃক্ষ আর নীলাভ আকাশের সান্নিধ্য থেকে আমি নির্বাসিত হলাম। আমাকে নিক্ষেপ করা হলো অচিন্তনীয় ও নির্মম এক নিষ্ঠুরতার গভীরে। আমি বিচ্ছিন্ন হলাম সবার সান্নিধ্য থেকে। মনে হলো, এক অবিচারের অট্টহাসি আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন দুই প্রধান দলের দুই শীর্ষ নেত্রী। আমাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করায় আওয়ামী লীগ প্রধান সন্তোষ প্রকাশ করলেন আর বিএনপি চেয়ারপারসন তার ‘আপসহীন’ সংগ্রামের বিজয় বলে ঘোষণা করলেন।
তিনি বইতে লিখেছেন, জেলখানার ভেতরে আরেক জেলখানায় বন্দি করা হলো আমাকে। কারণ, আমাকে নিয়ে তাদের অনেক দুশ্চিন্তা। পাঁচটি গেটে পাহারাদার তো আছেই, মাথার ওপরে সেন্ট্রি, পেছনে সেন্ট্রি। তবুও ওদের দুশ্চিন্তার শেষ ছিলনা।
আমার একটা নতুন নামকরণ হলো- কয়েদি নং ৪১৮০, যার শাস্তি দশ বছর, অস্ত্র মামলায়। অস্ত্রটি আমার নয়, সরকারের, সরকারি ভবনেই রক্ষিত ছিল। সরকারি সফরে ইরাক গেলে সে দেশের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ইরাকের শহীদদের স্মৃতির প্রলেপমাখা নাইন মিলিমিটারের একটি পিস্তল আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। তবুও তো, শাস্তি দিতে হবে, তাই দেয়া হয়েছিল।
আমার সেলের গেটের চাবির নং ছিল ৩১৬। প্রতিটি বিষন্ন বিকেলে এই চাবিতেই বিকট শব্দে বন্ধ হয়ে যেতো আমার সেলের লৌহ কপাট। আবার পরের দিন সকালে ওই ৩১৬ নং চাবি দিয়েই খোলা হতো সেলের তালা। (চলবে)
সূত্র : বাংলামেইল
নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ১০:৫১ অপরাহ্ন, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, শনিবার
এমআরআর