নুসরাতের ‘বোকার বাক্সে’ কোটি টাকা আয়!

‘শান্তিরক্ষী মিশনে সেনা কর্মকর্তা স্বামী মারা গেছেন’, এখন সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে এক কোটি টাকা। এই পরিচয়ে নতুন নতুন স্থানে বাসা ভাড়া নিতেন নুসরাত জাহান জান্নাত। এরপর বাড়ির মালিক ও প্রতিবেশীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে বলতেন, ‘সরকারের দেওয়া সেই এক কোটি টাকা পেতে ভ্যাট হিসেবে জমা দিতে হবে ১০ শতাংশ অর্থ (১০ লাখ টাকা)। কিন্তু সেই টাকা নেই আমার কাছে।

কেউ যদি সেই টাকা দুই-এক দিনের জন্য দিয়ে সহায়তা করে তাহলে বিনা সুদে তাকে ২০ লাখ টাকা ধার দেব। ’ এমন কথা বলে ফেলা হতো প্রলোভনে। এরপর সুযোগ বুঝে আট থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যেতেন। এভাবে ‘বোকার বাক্সে’ ফেলে কোটি টাকার প্রতারণা করেছেন নুসরাত। তার সহযোগিতায় ছিল স্বামীসহ ৯ জনের একটি চক্র।
এভাবে বেশ কয়েকজনকে ফাঁদে ফেলে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাব-১১ কুমিল্লার সদস্যরা। তাদের মধ্যে চক্রের মূলহোতা কথিত সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীও রয়েছেন। ওই চক্রের আরো তিন সদস্য পলাতক রয়েছেন।

সোমবার (১০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-১১, সিপিসি-২ কুমিল্লার কম্পানি অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন। কুমিল্লা কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের শেষে এদিন বিকেলে ওই সাতজনকে কুমিল্লার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

র‌্যাবের ভাষ্য, প্রতারণার কৌশলটি নতুন। মোট চারটি ধাপে চক্রের সদস্যরা মানুষকে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিত টাকা।

৯ অক্টোবর রোববার রাতে কুমিল্লা, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃত প্রতারকচক্রের সদস্যরা হলেন লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ থানার পশ্চিম জামিরতলী গ্রামের মৃত শামছুল হকের মেয়ে নুসরাত জাহান জান্নাত (২৭), জান্নাতের স্বামী একই গ্রামের আবদুর রহমান (৩৫), পাশের মোহাম্মদনগর গ্রামের মৃত ইব্রাহিমের ছেলে শাহাবুদ্দিন ওরফে আলাউদ্দিন (৪৬), তার স্ত্রী পারভীন আক্তার (৪৬), চাঁদপুরের শাহরাস্তি থানার থামপার গ্রামের সোলেমান মিয়ার ছেলে ইলিয়াস হোসেন (৩০), কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার সালমানপুর এলাকার কিশোর খানের স্ত্রী ফাতেমা আক্তার (৩৫) এবং কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার এগারগ্রাম এলাকার জাকির হোসেনের ছেলে বশির উদ্দিন (৪৭)। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ৯টি মোবাইল ফোন, দুটি ব্যাংকের চেক বই, নগদ টাকা ও ভাড়া বাসার চাবি উদ্ধার করা হয়েছে।

র‌্যাবের কর্মকর্তা মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন জানান, গত ২০ আগস্ট হাসিনা বেগম নামের এক নারী ভুক্তভোগী কুমিল্লা র‌্যাব কার্যালয়ে এসে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, শান্তিরক্ষী মিশনে নিহত সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীর পরিচয়ে স্বামীর অনুদানের টাকা উত্তোলনের নামে প্রতারণার মাধ্যমে আট লাখ টাকা হাতিয়ে নেন নুসরাত জাহান জান্নাত নামের এক নারী। ভুক্তভোগী কুমিল্লা নগরীর দৌলতপুর এলাকার টিঅ্যান্ডটি মোড়ের একটি বাড়ির মালিক। প্রতারক জান্নাত সে বাড়িতে ভাড়ায় থাকতেন। বাসায় থাকতে গিয়ে বাসার মালিক হাসিনা বেগমের সঙ্গে পরিচয় হয়। এ সময় প্রতারক জান্নাত নিজেকে শান্তিরক্ষী মিশনে নিহত সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী পরিচয় দিয়ে তার ব্যাংকে কোটি টাকা আছে বলে জানান। এ টাকার ভ্যাটস্বরূপ ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে মর্মে হাসিনা বেগমের কাছ থেকে আট লাখ টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান।

এদিকে বিল্লাল হোসেন নামের আরেক ভুক্তভোগী গত ২ অক্টোবর র‌্যাবের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগে ভুক্তভোগী বিল্লাল উল্লেখ করেন, নুসরাত জাহান জান্নাত নামের এক নারী তার পাশের ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। এ সময় জান্নাত নিজেকে শান্তিরক্ষী মিশনে নিহত সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী পরিচয় দিয়ে তার ব্যাংকে অনুদানের কোটি টাকা আছে বলে জানান। সেই টাকা উত্তোলনের জন্য ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে মর্মে বিল্লাল হোসেনের কাছ থেকে ৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। কোটি টাকা তুলে বিল্লালকে ২০ লাখ টাকা বিনা সুদে ধার দেওয়ার প্রলোভন দেখান জান্নাত।

মেজর সাকিব বলেন, দুই ভুক্তভোগীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্তে নেমে এই প্রতারণাচক্রের মূলোৎপাটন করতে সক্ষম হয় র‌্যাব। চক্রের মূলহোতা ছিলেন জান্নাত। তাকে এ কাজে সহযোগিতা করেন তার স্বামী আব্দুর রহমান, নিকটাত্মীয় শাহাবুদ্দিন, পারভীন, ইলিয়াস ফাতেমা, বশিরসহ অপর অভিযুক্তরা। গ্রেপ্তারকৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তারা এমন কৌশল অবলম্বন করে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে কোটি টাকা প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছেন। এই চক্রে আরো তিনজন জড়িত আছেন, তাদেরকে ধরতে অভিযান চলছে।

মেজর সাকিব বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রতারণার এই কৌশলটি নতুন মনে হয়েছে। তাই মানুষকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। চক্রটি মূলত চারটি ধাপে মানুষের টাকা নিয়ে লাপাত্তা হতো। এর মধ্যে রয়েছে প্রথমে টার্গেট বা বাসা ভাড়া নেওয়া, বাসায় কয়েক দিন বসবাস করে টার্গেটের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা, টার্গেট ঠিক হলে তাকে ব্যাংকে নিয়ে যাওয়া এবং প্রতারক আবদুর রহমানকে ব্যাংক কর্তকর্তা সাজানো আর সব শেষে ব্যাংকের আশপাশে টাকা নিয়ে গেলে টার্গেটকে বোকা বানিয়ে টাকা নিয়ে পালানো।

বার্তা কক্ষ, ১০ অক্টোবর ২০২২

Share