জাতীয়

কোটা বাতিলের ঘোষণা হলেও জটিলতা কাটেনি

• প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি
• প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্যও আনুষ্ঠানিক কমিটি হয়নি
• চলমান নিয়োগ কার্যক্রম কীভাবে এগোবে, তা পরিষ্কার নয়

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন স্থগিত হয়েছে, কোটা বাতিলের ঘোষণাও এসেছে। কিন্তু এক সপ্তাহেও এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় বেশ কিছু প্রশ্ন ডালপালা মেলেছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় করণীয় ঠিক করতে পারছে না।

ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সন্তানদের বিভিন্ন সংগঠন ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে মাঠে নেমেছে, শাহবাগে তারা মহাসমাবেশ ডেকেছে ২৮ এপ্রিল। নারী সংগঠনগুলো নারী কোটা রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জেলা কোটা নিয়েও আছে পক্ষে-বিপক্ষে মত।

সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলে প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় আন্দোলনকারীদের সন্দেহ বেড়েছে। প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য আনুষ্ঠানিক কমিটিও গঠন করা হয়নি। এখন চলমান নিয়োগ কার্যক্রমগুলো কীভাবে এগোবে, তা নিয়েও পরিষ্কার করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরে স্পর্শকাতর বিষয়টি কত দূর গড়াবে, তা নিয়ে নানা ধরনের জল্পনাকল্পনা চলছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা মনে করছেন, কোটার বিষয়টি স্পষ্ট করা জরুরি। তবে তাঁরা ধারণা করছেন, এটা একেবারে বাতিল হবে কি না, থাকলে কতটা থাকবে, সেসব বিষয় স্পষ্ট হতে আরও সময় লাগবে। কারণ, যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক, তাতে এক পক্ষ খুশি হবে, আরেক পক্ষ নাখোশ। ফলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনেক কিছুই পর্যালোচনা করতে হবে।

আন্দোলনকারীদের মধ্যেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। তাঁদের একাধিক নেতা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, দেখেশুনে এখন মনে হচ্ছে, আন্দোলন থামানোই ছিল সরকারের লক্ষ্য। কর্মসূচি স্থগিত করার পর পুলিশ ও গোয়েন্দা এবং সরকারি ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের শীর্ষ কিছু নেতার কার্যক্রমে তাঁরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ।

যদিও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, একদিকে জাতীয় সংসদের মতো জায়গায় বলা, আরেক দিকে সরকারপ্রধানের নিজের মুখে বলা-এরপর কারও মধ্যে বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। তবে বিষয়টি আনুষ্ঠানিক করতে একটি প্রজ্ঞাপন দরকার। এই প্রজ্ঞাপন জারির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন তাঁরা।

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোজাম্মেল হক খান প্রথম আলোকে বলেন, কোটা নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা বাতিলের যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটাই এখন পর্যন্ত কোটার বিষয়ে সরকারের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত। তবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের বিশেষ ব্যবস্থায় চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে-এটা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট।

প্রজ্ঞাপন জারি করতে বিলম্ব কেন হচ্ছে, জানতে চাইলে সচিব বলেন, প্রজ্ঞাপন জারি না করলেও কোটা বাতিল-এটাই চূড়ান্ত। প্রজ্ঞাপন জারিতে একটু বিলম্ব হলেও অনেক সময় লাগবে না বলে জানান তিনি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর কোটা বাতিল বলেই তাঁরা ধরে নিয়েছেন। এখন যদি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের মতো অবহেলিতদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হয়, সেটা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটির মাধ্যমে ঠিক করা হবে। কিন্তু এই কমিটি বা এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত তাঁরা লিখিত কোনো নির্দেশনা পাননি। ফলে তাঁরা সবকিছুর জন্য লিখিত নির্দেশনার দিকে চেয়ে আছেন।

কোটা নিয়ে বা কমিটি করার বিষয়ে কোনো অগ্রগতি আছে কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম গতকাল প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, কোনো অগ্রগতি নেই।

বিদ্যমান কোটাব্যবস্থাকে জটিল ও বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে তা সংস্কার বা কমানোর দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন চাকরিপ্রার্থী ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে চাকরিতে কর্মরত ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিসিএস পর্যন্ত সরকারি চাকরির প্রায় সব পর্যায়েই কোটার চাপে মেধাবীদের দিশেহারা অবস্থা। এর কারণ হলো, এখন স্নাতক-স্নাতকোত্তর পাস করা বেকার যুবকের সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৫-১৬) বলছে, দেশে বেকারের সংখ্যা এখন ২৫ লাখ ৯০ হাজার। আর গত জানুয়ারি মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তাতে সব মিলিয়ে চাকরিযোগ্য শূন্যপদ আছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ২৬১ টি। এই অবস্থায় কোটার কারণে চাকরি না পাওয়ায় তরুণদের মধ্যে আরও হতাশা বেড়েছে। সাবেক ও বর্তমান এসব কর্মকর্তা মনে করেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোটা কমানো দরকার, কিন্তু একেবারে কোটা বাতিলের সময় এখনো আসেনি।

সরকারি কর্ম কমিশনও (পিএসসি) বিভিন্ন সময় বিদ্যমান কোটা সহজ বা সংস্কারের কথা বলেছে। বিদ্যমান কোটা সংস্কারে ৫ দফা দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করলেও সরকার প্রথমে বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। সর্বশেষ ৮ এপ্রিল ঢাকার শাহবাগে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ লাঠিপেটা এবং কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করলে আন্দোলন সহিংস আকার ধারণ করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। এরপর আন্দোলনকারীরা কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করেন।

বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশ সফরে আছেন। ২৩ এপ্রিল তাঁর দেশে ফেরার কথা। ফলে এর আগে কোনো অগ্রগতি হবে বলেও তাঁরা মনে করছেন না। আবার ২৩ এপ্রিল দেশে ফিরে এ মাসের শেষ সপ্তাহে আবারও প্রধানমন্ত্রীর বিদেশে যাওয়ার কথা আছে। এ জন্য কোটা জটিলতা নিরসনে কিছুটা সময় লাগতে পারে বলে তাঁরা ধারণা করছেন।

কিন্তু এর মধ্যে বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি নিয়োগ কার্যক্রম চলছে। এগুলো কীভাবে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগের কাজ করে থাকে পিএসসি। চলমান নিয়োগ কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, কোটা নিয়ে সরকার যে নীতি প্রণয়ন করবে, তাঁরা সেটাই অনুসরণ করবেন এবং অতীতেও তাই করেছেন।

২০১৪ সালের বিজ্ঞাপনের আলোকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগে ১২টি জেলায় লিখিত পরীক্ষা হবে ২০ এপ্রিল। পর্যায়ক্রমে ৬১টি জেলায় মে মাসের মধ্যে এই নিয়োগ পরীক্ষা শেষ করতে চায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ৬১টি জেলায় মোট পদ কমবেশি ১০ হাজারের মতো। এখন প্রশ্ন উঠেছে, এই নিয়োগে কোটা কীভাবে নির্ধারণ হবে। কারণ, প্রাথমিকে ৬০ শতাংশ নারী কোটায় শিক্ষক নিয়োগ হয়। এ ছাড়া প্রাথমিকের নিয়োগ হয় মূলত উপজেলাভিত্তিক। কোটা বাতিল হয়ে গেলে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা আছে।

এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকার বলে দিতে পারে, ইতিমধ্যে যেসব বিজ্ঞাপন হয়েছে, সেগুলো আগের মতোই হবে, আবার চলমান অবস্থাতেও তা কার্যকর হতে পারে।

এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন পদে প্রায় ৪০ হাজার কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কিছু না কিছু নিয়োগ কার্যক্রম চলছে, যেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।

জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, উদ্ভূত সমস্যা নিরসনের জন্য যত দ্রুত সম্ভব, কোটার বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি করে পরিপত্র জারি করা উচিত। ব্যক্তিগতভাবে তিনি মনে করেন, কিছু ক্ষেত্রে এখনো কিছু কোটার প্রয়োজন আছে। যেমন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং ধাত্রী পদে সবাইকে নারী হওয়া উচিত। এ ছাড়া বিসিএস এবং নিচের স্তরের চাকরি একই নীতিতে চলবে না। তাঁর মতে, সবকিছু বিবেচনায় নিয়েও বিসিএসে মেধা কোটা কমপক্ষে ৮০ শতাংশ হওয়া উচিত।

Share