প্রধান বিচারপতির পদ থেকে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা পদত্যাগ করার পর থেকেই দেশের নতুন প্রধান বিচারপতি কে হচ্ছেন তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে সব মহলে।
শুরুর দিকে সম্ভাব্য নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে আপিল বিভাগের তিন বিচারপতির নাম শোনা গেলেও এখন সেই তালিকা একটু ছোট হয়েছে। প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালনরত আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, নয় তো তার পরে কর্মে প্রবীণ বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনই হচ্ছেন দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি।
তাদের মধ্যে বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা অবসরে যাবেন চলতি বছরের ১০ নভেম্বর আর ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর অবসরে যাবেন বিচারপতি মাহমুদ হোসেন।
তবে প্রধান বিচারপতি যে-ই হোন, আগামী ৩১ জানুয়ারির আগে এ নিয়োগ চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। জানা গেছে, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটিতে যাওয়ার পর থেকেই আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্্হাব মিঞা ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
ওই সময় থেকেই প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্্হাব মিঞার পাশাপাশি বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নাম আসে। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।’ সংবিধানে এ বিষয়ে আর বিস্তারিত কিছুই বলা হয়নি। তবে দীর্ঘদিনের রীতি অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের যে বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন, তার ব্যাপারে সম্মতি দিয়ে প্রথমে তা আইন মন্ত্রণালয়কে জানান।
এরপর মন্ত্রণালয় থেকে ওই বিচারপতির ব্যাপারে ফাইল প্রস্তুত করে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরের পর বিষয়টি রাষ্ট্রপতির কাছে যায়। রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর প্রধান বিচারপতি নিয়োগের গেজেট জারি করে আইন মন্ত্রণালয়।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে বিচার বিভাগ-সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ের এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালনরত বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা চলতি বছরের নভেম্বরেই অবসরে যাবেন। তিনিই আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্যে কর্মে প্রবীণ। এ ছাড়া পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ ১১ অভিযোগের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞপ্তির বিষয়েও তিনি ভূমিকা পালন করেছেন।
এসব বিষয় বিবেচনায় বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞাকেই দেশের নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি দেখছেন তিনি। তবে কোনো কারণে বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া না হলে আপিল বিভাগের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকেই দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে বলে জানায় ওই সূত্র।
সূত্র আরও জানায়, চলতি মাসে এ নিয়োগ চূড়ান্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কবে নাগাদ প্রধান বিচারপতির নিয়োগ হতে পারে এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘সব নিয়োগই হবে। সব সময় বলে এসেছি, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ রাষ্ট্রপতি দেবেন। কবে কাকে নিয়োগ দেবেন সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার শুধু রাষ্ট্রপতির।’ তবে খুব তাড়াতাড়িই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হতে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
গত বছর ১০ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সিঙ্গাপুর থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। এরপর ১৪ নভেম্বর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতির দফতর তা পাঠিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ে। পরে আইন মন্ত্রণালয় আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির পদটি শূন্য ঘোষণা করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করার প্রয়োজনীয়তা ছিল বলে মনে করেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ।
তাঁর মতে, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পদত্যাগ ছিল একটি অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তার পদত্যাগপত্র গৃহীত হলে পদ শূন্য হয়েছে বলে একটি গেজেট জারির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু সেই গেজেটটা এখনো হয়নি। গত বছর ১ আগস্ট উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিয়ে করা ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রকাশিত হয়।
এ রায়ে প্রধান বিচারপতির দেওয়া বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছিলেন মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সরকারপন্থি আইনজীবীরা। তারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিও তোলেন। সমালোচনার মধ্যেই ১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা হঠাৎ করে এক মাসের ছুটির কথা জানিয়ে চিঠি দেন।
পরদিন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্্হাব মিঞাকে সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। ৯৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে প্রধান বিচারপতি তাহার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে ক্ষেত্রমতো অন্য কোনো ব্যক্তি অনুরূপ পদে যোগদান না করা পর্যন্ত কিংবা প্রধান বিচারপতি স্বীয় কার্যভার পুনরায় গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারকের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম, তিনি অনুরূপ কার্যভার পালন করিবেন।’
ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিয়োগের পর আইনমন্ত্রী জানান, প্রধান বিচারপতি ক্যান্সারে আক্রান্ত। এ কারণ উল্লেখ করে তিনি ছুটির আবেদন জানিয়েছেন। পরে ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন প্রধান বিচারপতি।
দেশ ছাড়ার আগে প্রধান বিচারপতি তার বাসভবনের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি অসুস্থ নই। বিচার বিভাগের স্বার্থে আবার ফিরে আসব। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে একটি মহল প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়েছেন।’ তিনি একটি লিখিত বিবৃতিও সাংবাদিকদের দিয়ে যান। পরদিন ১৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১টি দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর তার কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
এ কারণে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসতে চাননি আপিল বিভাগের বিচারপতিরা। এরপর ছুটি শেষ হওয়ার আগে বিচারপতি এস কে সিনহা অস্ট্রেলিয়া থেকে সিঙ্গাপুরে আসেন। সেখানে উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধানে দফায় দফায় সমঝোতা বৈঠক করেন তিনি।
শেষ পর্যন্ত কোনো সমঝোতা না হওয়ায় ১০ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে বসেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে বিচারপতি সিনহা কানাডায় চলে যান। পরদিন পদত্যাগপত্রটি রাষ্ট্রপতির দফতরে পৌঁছায়। ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি ওই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১:০৩ এএম, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার
ডিএইচ