সারাদেশ

পুলিশ কর্মকর্তার চৌকস ভূমিকায় ধরা পড়লো ‘ভয়ংকর দেবর’

পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার কাশিনাথপুর ইউনিয়নের পাইকরহাটি গ্রামে গৃহবধূ আলেয়া খাতুনকে (৪০) ধর্ষণ চেষ্টার পর হত্যা মামলার আসামি টুটুল মল্লিককে (৩০) গত ৭ নভেম্বর গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদালতের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে টুটুল ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকারও করেছেন।

প্রিয় পাঠক বলতে গেলে এ এক প্রকার পুরোনো খবর। এ নিয়ে ৭ নভেম্বরই স্বাভাবিক প্রতিবেদনের মতো কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে এটি প্রকাশ হয়েছে।

কিন্তু যে ঘটনায় কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না, ছয়দিন ধরে আলেয়ার কোনো খবর ছিল না, শুধু একটি সাধারণ ডায়েরির সূত্র ধরে কীভাবে ধরা পড়ল খুনি? কীভাবে বিলের মধ্যে মিলল আলেয়ার লাশ? এই রকম অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে পুরো তদন্ত প্রক্রিয়া জানিয়েছেন পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বেড়া-সাঁথিয়া সার্কেল) আশিস বিন হাসান।

গত ৭ নভেম্বর সকালে তাঁকে নিয়ে সবার সামনে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যা রহস্য উন্মোচনের আগে এভাবে (ছবিতে) লুঙ্গি পরে খালি গায়ে গ্রামের বিলে ঘুরে বেড়ান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশিস বিন হাসান।

এ নিয়ে গত ৯ নভেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বেড়া সার্কেল বেড়া আইডি থেকে একটি পোস্ট দেয়া হয়। সেখানে পাবনার পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশিস বিন হাসানসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ট্যাগ করা হয়।

এরপর শুক্রবার ১০ নভেম্বর একই ঘটনা শেয়ার করে ফেসবুকে পোস্ট দেন জিহাদুল কবির। আজ শনিবার সেটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়।

সময় নিয়ে পড়তে হবে পুরো লেখা। মনে হবে দক্ষ কোনো পুলিশ কর্মকর্তার গোয়েন্দা কাহিনী পড়ছেন। বানান ঠিক করে পুরো পোস্টটি নিচে দেওয়া হলো :

‘উরু পর্যন্ত শাড়ি-পেটিকোট উঁচু করে ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মাঝবয়সী এক নারী। তাঁর নাম আলেয়া। বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। বয়স বাড়লেও দুই সন্তানের জননী আলেয়ার শরীর ভেঙে পড়েনি। এখনো যৌবনের পূর্ণ রেশ শরীরে রয়েই গেছে। কে জানত তার সুগঠিত অবয়বই কোনো নরপশুর লোলুপ দৃষ্টি কাড়বে; অতঃপর নির্জন বিলে ধর্ষণের শিকার হয়ে লাশকাটা ঘরে পড়ে থাকবে তার পচা গলা নিথর দেহটি।

ঘটনার ভেতরে যাওয়া যাক

গত ৩-১১-২০১৭ তারিখে সাঁথিয়া থানায় একটি নিখোঁজ জিডি এন্ট্রি করা হয়। যার নম্বর ১০২। জিডিতে মো. আরদোশ মল্লিক (৫০), গ্রাম-চর পাইকরহাটি, সাঁথিয়া জানান, গত ১-১১-১৭ইং তারিখে তাঁর স্ত্রী (আলেয়া খাতুন) চরপাইকরহাটি, কুমির বিলের পাশের ঈদগাহে লাকড়ি কুড়াতে যান। এরপর তিনি আর ফেরত আসেননি। জিডি এন্ট্রির পর এসআই রাশেদ, সাঁথিয়া থানা ঘটনাস্থলে যান। গিয়ে জানতে পারেন পার্শ্ববর্তী ডোবার মধ্যে নিখোঁজ মহিলার পরনের শাড়ি পাওয়া গেছে।

বিষয়টি আমার মনে দাগ কাটে। ৪-১১-১৭ তারিখ আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে শাড়িটি দেখি। আশপাশের লোকজনের সাথে কথা বলি। জায়গাটি একদম নির্জন, নিঝুম। মূল গ্রাম থেকে সামান্য বাইরে। যেখানে ঈদগাহ তার ঠিক সামনেই পূর্বদিকে ১০ বিঘার একটি বিশাল পুকুর। পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশজুড়ে বিশাল বিল। উত্তর দিকে প্রায় ৩০০ মিটার দূরে মূল গ্রাম। ওই জায়গায় দিনের বেলা গেলেও গা ছম ছম করে। থাক সে কথা, ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রচুর উৎসুক জনতা পাই। মহিলার (আলেয়া) ঝাড়ু দেওয়ার ঝাটা ঈদগাহের দেয়ালের পাশে পড়ে থাকতে দেখি। শাড়ি যে ডোবায় ছিল, সেই স্থান পরিদর্শন করি। কিন্তু মহিলার সন্ধান কেউ দিতে পারে না। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে শোনা যায়, খালের ওপারে কাউকে টেনে বিলের ভেতরে নেওয়ার মতো দাগ আছে। কিন্তু ওখানে যেতে হলে বুকসমান পানি পার হয়ে যেতে হবে। গ্রামবাসী একজনের কাছে লুঙ্গি চেয়ে নিয়ে আমি নিখোঁজ মহিলার (আলেয়া) দেবর রেজাউলকে সাথে নিয়ে খাল পাড়ি দিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে গেলে অজস্র পায়ের ছাপ দেখি।

রেজাউল জানান, গ্রামের শত শত লোক গত দুদিন ধরে বিলের ভেতর নেমে কোনো কিছু পাওয়া যায় কি না তার সন্ধান করেছে। এগুলো তাদের পায়ের ছাপ। তারপরও ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যাচ্ছে, কাউকে টেনে নেওয়ার দাগ। এরপর সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। কিন্তু কোনো কূল কিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না। পুনরায় ডাঙায় ফিরে আসি। মহিলা (আলেয়া) সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করি।

মহিলা দরিদ্র আরদোশ মল্লিকের স্ত্রী। ১-১১-১৭ তারিখ সকালে খড়ি কুড়াতে বাড়ি থেকে বের হন। পথে মিলন নামের এক ছেলের সঙ্গে দেখা হয়। সে আখ থেকে গুড় বানাচ্ছিল। তার কাছ থেকে দুই টুকরো আখ চেয়ে নেন। এরপর বিলের পাশে ঈদগাহের দিকে চলে যান। এতটুকু জানার পর মিলনকে খুঁজে বের করি। সে আমার অফিসে এসে সাবলীলভাবে জানায় যে, সে কিছুই দেখেনি, তবে তার গ্রামের ইন্দাই তাকে সকাল ১০-১১টার দিকে বলেছিল ঈদগাহের পাশের জমিতে কিছু একটা নাকি দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু তারা দুজন ঈদগাহের কাছে গিয়ে কিছু না পেয়ে ফিরে এসেছে। এ ছাড়া সে আখ ভাঙানোর সময় শুধু নিখোঁজ আলেয়ার ভাইয়ের বউকে পাশ দিয়ে পুকুরে কাপড় কাচতে যেতে দেখেছে। আর একজন টুটুল (৩০) নামের একটা ছেলে এক টুকরা আখ তাঁর কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে ওই দিকে গিয়েছিল।

আমি এবার ইন্দাই আর কাপড় কাঁচা মহিলার খোঁজ নিতে শুরু করি। কেননা টুটুল শুনেছি ঢাকায় চাকরি করে। সে ঢাকায় চলে গেছে। তাই তাকে আপাতত খোঁজা বন্ধ করি। এবার ইন্দাইকে আমার সার্কেল অফিসে ডাকি।

ইন্দাই আমাকে জানায়, ঈদগাহের সামনের পুকুরপাড়ে তার সবজি বাগান পরিষ্কার করছিল। তার টয়লেট চাপলে পুকুরের পূর্ব পাড়ের বাঁশঝাড়ে যায়। হঠাৎ ঈদগাহের দক্ষিণের নিচু জমিতে কাউকে নড়তে দেখে। আর মনে হচ্ছিল কেউ একজন বুঝি কাউকে জড়াজড়ি করছে। সে ভাবে গ্রামের কোনো প্রেমিক-প্রেমিকা হয়তো গোপনে শারীরিকভাবে মিলিত হচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি টয়লেট সেরে পুকুরপাড় বেয়ে এসে আখ ভাঙানোর স্থানে থাকা মিলনকে ডাকে। মিলন তখন খাবার খাওয়ার জন্য পুকুরে হাত ধুচ্ছিল। সে মিলনকে বিষয়টি জানায়। দুজন এগিয়ে গিয়ে কিছুই দেখতে পায়নি। পরে হাসি-ঠাট্টা করে ফেরত চলে আসে। পরে সে শুধু শুনেছে টুটুল আরো কিছুক্ষণ পরে এসে মিলনের কাছে বলেছে, তার একটা চশমা হারিয়েছে, তারা কেউ পেয়েছে কি না?

এরপর যে মহিলা কাপড় কাঁচছিল তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আবার পাইকরহাটি গ্রামে যাই। সে জানায়, কাপড় কাঁচতে যাওয়ার পথে মিলনকে আখ ভাঙাতে দেখেছে। পরে টুটুল পুকুরপাড় দিয়ে যাওয়ার সময় তার সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরা করে চলে যায়। দেবর হিসেবে কিছু রসাত্মক কথা বলে। প্রচুর কাপড় ছিল, কাঁচতে দেরি হয়। পরে ভেজা কাপড়ে টুটুলকে ফিরতে দেখে। কিন্তু এবার সে ডাকলেও টুটুল ব্যস্ততার কথা বলে চলে যায়। তিনজনের কথা শোনার পর টুটুলের প্রতি আমার তীব্র আগ্রহ জন্মায়।

আমি পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির, পিপিএম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস স্যারকে বিষয়গুলো জানাই। তাঁরা আমাকে লেগে থাকার পরামর্শ দেন। কেউ আমাকে বলেছিলেন, ঘটনাস্থলে যত বেশি বেশি যাবে, তত বেশি বেশি রহস্য উন্মোচনের দিকে এগিয়ে যাবে। আমি আবার বিলের মধ্যে যাই। আবার বিলে নামি।

ওই দিন মসজিদে মাইকিং হয়। বিলের অনেকটা জুড়ে সকালে সবাই ধানক্ষেতে তল্লাশি চালায়, কিছুই পায় না। তারপরও পুনরায় আমি নামি। প্রায় আধা কিলো বুক পানির ভেতর দিয়ে বিলের ভেতর যাই কোনো আলামত পাই কি না। বিলের মধ্যখানে কচুরিপানা-ভর্তি ডোবা দেখতে পাই। আমার সঙ্গে পথ দেখায় নিখোঁজ আলেয়ার দেবর রেজাউল। কিছু না পেয়ে ঘণ্টা দুই পর আবার ফিরে আসি। তখন সুরমান নামের এক ব্যক্তি আমাকে বলে, ওই দিন সে উঁচু জমিতে বিলের মধ্যে ঘাস কাটছিল। বেলা ১১টার দিকে টুটুল এসে তাকে বলে তুমি কি আমার চশমা দেখেছো। সে বলে আমি কীভাবে তোর চশমা দেখব। টুটুল বলে তোমার বোঝা তুলে দেই, তুমি বাড়ি যাও। সে জানায়, ঘাস কাটাই শেষ হয়নি। তো বোঝা নিয়ে যাবে কেন। এরপর টুটুল চলে যায়।

এতটুকু শুনে আমি ওপরে উঠে ইন্দাইকে নিয়ে পুকুরপাড়ে হাঁটতে থাকি। বাঁশঝাড়ে গিয়ে ইন্দাই তাঁর টয়লেটের চিহ্ন দেখায়। আমি সব ঘৃণা, দুর্গন্ধ ভুলে তা দেখতে যাই। কারণ বিষয়টা আমার মধ্যে একটা নেশার জন্ম দিয়েছিল। ওইখানে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি যে, ওখান থেকে পুকুরের অপর পাড়ে আসতে বেশ সময় লেগেছিল। তাই মিলন আর ইন্দাই এসে কিছুই দেখতে পায়নি। সন্ধ্যার দিকে ফেরার পথে হেলাল নামের একজন আমাকে বলে, ওই দিন সন্ধ্যার সময় টুটুলকে বিলের পূর্ব পাশে স্কুলের মাঠের কোনায় একা বসে থাকতে দেখেছে। আমার টুটুলের প্রতি আগ্রহ বাড়তেই থাকে।

এরপর আমি টুটুলের ফোন নম্বর জোগাড় করি। প্রথমে ফোন দিলে সে ধরে না। তার ভাগ্নে হাফিজকে দিয়ে ফোন করাই। এরপর ৬-১১-১৭ তারিখে সকালে সে আমাকে ফোন করে জানায় যে, তার ছুটি শেষ হয়ে গেছে। সে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাকরি করে। তার পক্ষে এখন আসা সম্ভব নয়। আমি বিনয়ের সঙ্গে তাকে বোঝাই যে না এলে এলাকার লোকজন হয়তো তাকে সন্দেহ করবে। সে এক ব্যক্তিকে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বলে, কথা বলেন। তিনি জানান যে, টুটুল তাঁর কর্মচারী। তার নির্ধারিত ছুটি অবশিষ্ট নাই। অলরেডি এবার ছুটিতে গিয়ে সে ওভার স্টে করে এসেছে। আমি পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে বললে তিনি টুটুলকে ছাড়তে রাজি হন।

বিকেলে (৬ নভেম্বর) বেড়া এলাকার স্থানীয় নেতাকে দিয়ে টুটুল আমাকে ফোন করান। আমি নেতাকে আশ্বস্ত করি যে, কোনো মামলা হয়নি। তাকে গ্রেপ্তারও করা হবে না। শুধু ওই দিন সে কী দেখেছে তা জানা দরকার। এরপর শুরু হয় আসল নাটক।

সন্ধ্যা ৬টার দিকে চমৎকার একটি চশমা পরা সুদর্শন যুবক আমার অফিসে প্রবেশ করে জানায় তার নাম টুটুল। আমি তাকে সাদরে বসতে দেই। তার ফোনটি হাতে নিয়ে দেখতে থাকি। কুশলাদি বিনিময় শেষে তাকে কিছুই জিজ্ঞেস না করে সাদা কাগজে তার নাম-ঠিকানা লিখতে বলি। সে খুব দ্রুত তার ঠিকানা লিখে দেয়। এরপর কাগজ কলম দিয়ে বলি ০১-১১-১৭ তারিখ বুধবার ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে সে পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠা পর্যন্ত কী কী করেছে তা আমাকে লিখে দিতে হবে। তখন সে জানায়, সে লিখতে পারে না, তবে যা যা জানে তা বলতে পারবে। আমি তাকে বলি যে, ‘আপনি না লিখতে পারলে নাম-ঠিকানা এত দ্রুত লিখলেন কীভাবে? যতই সময় লাগুক আপনি লেখেন, কোনো সমস্যা নাই’ পুরো তিন ঘণ্টায় সে ১৪ লাইন লেখে। যেখানে মূল ঘটনার ধারেকাছেও সে যায় না, এই ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যেও ফ্যানের নিচে বসে ঘামতে থাকে। তখন আরো নিশ্চিত হই যে সে কিছু লুকাচ্ছে। সময় নষ্ট না করে এবার তাকে ঘটনার বর্ণনা করতে বলি। সে জানায়, জমি দেখতে বিলের পাড়ে গিয়েছিল। সেখানে তার চশমা হারিয়ে গেলে খুঁজে না পেয়ে সে চলে এসেছে। পরে শুনেছে আলেয়াকে (তার চাচাতো ভাবিকে) পাওয়া যাচ্ছে না। এর বেশি তার জানা নাই। এবার তাকে প্রশ্ন শুরু করি।

তার চশমা কীভাবে হারালো। সে জানায়, চশমা খালের পাড়ে খুলে সেন্ডেলের ওপর রেখে জমি দেখতে গিয়েছিল। আমার অবাক লাগে মানুষ কিছু দেখতে গেলে চশমা পরে আর সে চশমা খুলে দেখতে গেছে। এর কারণ জানতে চাইলে সে বলে। ‘আমার চশমায় তো পাওয়ার নাই; পরলেও যা না পরলেও তা।’ আমি জানতে চাই, তবে এখন আপনার চোখে চশমা কোথা থেকে এলো। সে বলে চশমা পরতে পরতে অভ্যেস হয়ে গেছে, না পড়লে অস্বস্তি লাগে তাই নিজের মেয়ের চশমা পরে আমার অফিসে এসেছে। এতে আমার অবাক লাগে যে, চশমা না পরলে অস্বস্তি লাগলে জমি দেখতে গিয়ে সে চশমা খুলে রাখবে কেন? সে কোনো উত্তর দিতে পারেনি।

এরপর তাকে বলি, সুরমানের কাছে কেন গিয়েছিলেন? সে জানায়, সুরমান তাকে জমি কেনার ব্যাপারে ডেকেছিল। কিন্তু আমি আগেই সুরমানের কাছে শুনেছি, এমন কোনো কথাই হয়নি।

আসার পথে তার জামা-কাপড় ভেজা কেন ছিল, জানতে চাইলে জানায়, গোসল করেছিল তাই। সে বলে, বড় পুকুরটিতে নাকি গোসল করেছে। অথচ পাশেই যে মহিলা কাপড় কাঁচতেছিল, সে তাকে গোসল করতে দেখে নাই।

তা ছাড়া গোসলে গেলে লুঙ্গি-গামছা থাকার কথা, সেগুলো কেন নেয়নি। এর কোনো উত্তর সে দিতে পারেনি। এরপর তাকে আমি শত চাপাচাপি করলেও আমার কথার সে কোনো উত্তর দেয়নি।

এদিকে কোনো মামলাও এখনো রুজু হয়নি। মহিলা (আলেয়া) মারা গেছে কি না তারও প্রমাণ নেই। এমতাবস্থায়, আমি সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গৌতম স্যারকে জানাই। তিনি এসপি স্যারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এসপি স্যার বলেন, আরো জিজ্ঞেস করো। প্রয়োজনে মামলা নিয়ে আটক করো। তিনি জিজ্ঞাসাবাদে সাহায্যের জন্য ইন্সপেক্টর (তদন্ত) আবদুল মজিদকে আমার কাছে নিয়ে আসতে বলেন।

এরপর আমি বুঝতে পারি, এভাবে চললে কিছুই পাব না। আমি গোপনে মোবাইলের ক্যামেরায় টুটুলকে কয়েক সেকেন্ড ভিডিও করি। কিছুক্ষণ পর তাকে ওইটুকু দৃশ্য দেখাই আর বলি যে, আপনি যা করেছেন তা কিন্তু স্যাটেলাইটে ধরা পড়েছে। এইবার সে ঘাবড়ে যায়। তবু সে মুখ খোলে না। তখন তাকে নতুন টোপ দেই। বলি, দেড় লাখ টাকা লাগবে, যদি সে দিতে পারে তবে তাকে ছেড়ে দেব। আরো শর্ত থাকে, সে যদি লাশটা কোথায় বলতে পারে তবেই তার মুক্তি। এর মাঝে আমি তাকে ফোনে কথা বলতে দিই। তাকে সিগারেট পান করাই। সে ফোনে টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করে। তার আত্মীয়কে বলে জরুরি ভিত্তিতে টাকার দরকার। পরে তার আত্মীয় এসে আমাকে দেড় লাখ টাকার চেক প্রদান করে। তখন রাত আড়াইটা। টুটুল বলে লাশ কোথায় আছে আমি খুঁজে দেব। কিন্তু কে রাখছে তা আমি জানি না। আমি বুঝে ফেলি মহিলাকে হত্যা করা হয়েছে এবং লাশটা গুম করা হয়েছে। টুটুল শর্ত দেয় যে, কোনো পুলিশ সঙ্গে গেলে চলবে না। আমি জানাই যে, তাকে উপকার করতে গিয়ে যদি সে আমাকে মেরে ফেলে, তাই আমিও লোক ছাড়া যাব না। শেষে রাজি হয়। তার সঙ্গে আমি রাতের খাবার খাই এবং বন্ধুর মতো আচরণ করি। আমাকে সে ঘুষখোর হিসেবে বিশ্বাস করে। তারপর একটি সিভিল মাইক্রোতে আমিসহ ইন্সপেক্টর (তদন্ত), সাঁথিয়া, এই মামলার আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) রাশেদসহ আরো সাত-আটজন নিয়ে চরপাইকরহাটি গ্রামে যাই। গ্রামে ঢুকতেই টুটুল মাইক্রোর লাইট নিভিয়ে দিতে বলে। এরপর গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের কাছে গিয়ে বলে, এই দিক দিয়ে বিলে নামতে হবে। স্কুলের পাশে ঘন জঙ্গল।

আমি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গৌতম স্যারকে বিষয়টি জানাই। স্যার আমাকে খুব সাবধান হতে বলেন। আমি টুটুলকে বলি, ‘আপনাকে ছাড়লে যদি দৌড় দেন সেক্ষেত্রে আমি কী করব?’ সে বলে, ‘তবে আমার হাতে হ্যান্ডক্যাপ লাগায়ে দেন।’ আমি চিন্তা করি সে যদি বিলে নেমে পানিতে ডুব দেয় তাহলে হ্যান্ডক্যাপ নিয়েই সে পালাবে। এ জন্য তার এক হাত আর আমার অফিসের কনস্টেবল মুকুলের আরেক হাত যুক্ত করি। সে অনেকগুলো ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে বুক পানির ভেতর দিয়ে বিলের মধ্যখানে (ধান বিল নামক স্থান) নিয়ে যায়। এরপর কিছুক্ষণ উল্টাপাল্টা ঘুরায়। আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দেই সকাল হয়ে যাচ্ছে, লাশ না পেলে তার মুক্তি নাই। এরপর সে বলে ‘এক জায়গায় মাছ মারা বাঁশের চাড় আছে, এটা খোঁজেন।’ আমরা পাশেই তা খুঁজে পাই। তখন সে ওই বরাবর ধানক্ষেতের ভেতর গিয়ে ধানগাছে ঢাকা পচা, গলা আলেয়ার লাশ দেখিয়ে দেয়।

এরপর সে তাকে ছেড়ে দিতে বলে। আমি বলি, ডাঙায় উঠে ছেড়ে দেব। মাঝবিলের মধ্যে ছাড়লে যদি তার কোনো বিপদ হয় তবে তার স্বজনদের কী উত্তর দেব? ডাঙায় এসে আমার সহযোগী কনস্টেবল মুকুলের হাত খুলে টুটুলের দুই হাতে হ্যান্ডক্যাপ লাগাই। তখন সে বুঝতে পারে যে, তার রেহাই নাই। এরপর জানতে চাই, এই বিরান জায়গায় লাশ আছে তুমি জানলে কেমনে? স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারো জানার কথা নয়। তখন সে সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলে।

মূলত সে বিলের ধারে তার জমি দেখতে এসেছিল। সেই সময় তার চাচাতো ভাবি আলেয়া কাপড় উঁচু করে পানিতে নিমজ্জিত ধানক্ষেতের ভিতর হাঁটছিল। সুগঠিত দেহ দেখে সে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। তখন সে আলেয়াকে জড়িয়ে ধরে। ধর্ষণের চেষ্টা করে। তখন সন্নিকটে কেউ ছিল না। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে তার চশমা কাদা পানিতে পড়ে যায়। এরপর মহিলা (আলেয়া) এই সমস্ত ঘটনা ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেয়। ঘটনা জানাজানির ভয়ে সে মহিলার আঁচল দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরে। মহিলা মারা গেলে পাশেই ডোবায় লাশ নামিয়ে রাখে। এরপর হাত-পা ধুয়ে ফেরার পথে কেউ বিষয়টি দেখছে কি না ত নিশ্চিত করতে সামনে যাকেই পেয়েছে তাকেই চশমা হারানোর গল্প বলেছে। সারা দিন সে রাত নামার অপেক্ষায় থাকে। পরে ওই দিন গভীর রাতে (আনুমানিক রাত ৩টার দিকে) গিয়ে নিজে নিজেই একা লাশ টেনে বিলের ভেতর নিয়ে যায়। নেওয়ার সময় আলেয়ার পরনের শাড়ি খুলে যায়। যা পরে ডোবার মধ্যে পাওয়া যায়। বিলে ধানক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে পানি থাকায় লাশ টেনে নিতে তার কষ্ট হয়নি। পরে বাড়ি ফিরে আসে। এরপর দু-একদিন পরিস্থিতি অবজার্ভ (পর্যবেক্ষণ) করে ঢাকায় ফিরে যায়।

টুটুলের মুখে ঘটনার বিবরণ শুনতে শুনতে সেখানেই ফজরের আজান হয়। তখন মসজিদে গিয়ে মাইকিং করা হয়। বলা হয়, আলেয়ার লাশ পাওয়া গেছে। হাজার হাজার মানুষ স্কুল মাঠে জমায়েত হয়। অবশেষে গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে টুটুল গিয়ে লাশ বিলের মধ্যে আলেয়ার লাশ দেখিয়ে দেয়। লাশ উত্তোলন করা হয়। মৃতার স্বামী ও বাবার বাড়ির লোকজন উভয় পক্ষই বাদী হতে আগ্রহ দেখায়। সবাই মিলে শেষে মৃতার মেয়ে শাবানা আক্তারকে (২০) বাদী করে। সাঁথিয়া থানার মামলা নম্বর ১০। তারিখ ৭-১১-১৭। ধারা-নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(৪)(খ) তৎসহ ৩০২/২০১ দণ্ডবিধি রুজু হয়।

আসামি টুটুল পরে বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ৮-১১-১৭ তারিখ দেশের সব প্রধান দৈনিক পত্রিকাসহ সব স্থানীয় পত্রিকায় ঘটনাটি বিশদভাবে প্রকাশিত হয়।

সবশেষে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশিস বিন হাসান তাঁর ফেসবুকে বলেন, ‘আমার চাকরিজীবনে এমন নৃশংস ঘটনার সাক্ষী হয়ে যেমন আমি ব্যথিত হয়েছি, তেমনি রহস্য উদঘাটন করতে পেরে গর্ববোধ করছি।’ এরপর তিনি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান পুলিশ সুপার জিহাদুল কবিরকে তাঁর দিকনির্দেশনার জন্য। কৃতজ্ঞতা জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস (অপরাধ ও প্রশাসন) ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শামীমা আকতারকে (জেলা বিশেষ শাখা) তাঁদের পরামর্শ আর সহযোগিতার জন্য। ধন্যবাদ আর অভিনন্দন জানান সাঁথিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), থানার পরিদর্শক (তদন্ত), উপপরিদর্শক (এসআই) রাশেদ, কনস্টেবল মুকুল, গফুর ও আজিজ এবং চুন্নুলাল (ক্লিনার) ও গাড়ি দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য কামরুল হাসান লিটনকে।

সবশেষে লেখেন, ‘বি. দ্র. কার্য সমাপ্তির পর আমাকে প্রদত্ত দেড় লাখ টাকার চেকটি এর যথাযথ মালিককে ফেরত প্রদান করা হয়েছে।’

এই আলেয়া হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটনের ব্যাপারে জানতে চাইলে পাবনার পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির বলেন, ‘এই হত্যারহস্য উদঘাটন পাবনা পুলিশের একটি অন্যতম সাফল্য। যে স্থানে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়, সেখানে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না। কিন্তু অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশিস বিন হাসানের একাগ্রতা ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সঠিক অপরাধীকে চিহ্নিত করা গেছে। নিরীহ কোনো লোকও হয়রানির শিকার হয়নি।’ (এনটিভি)

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ ০৯ : ০৩ পিএম, ১১ নভেম্বর, ২০১৭ শনিবার
ডিএইচ

Share