কেঁচো চাষ করে স্বাবলম্বী শতাধিক পরিবার

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ও রায়গ্রাম ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের হাজারো দরিদ্র নারী কেঁচো চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তারা কয়েক বছর ধরে সংসারের দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি এ কাজ করছেন।

একদিকে কেঁচো ও সার বিক্রি করে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা আয় করছেন। অন্যদিকে কৃষি জমিতে বিষমুক্ত স্বাস্থ্যকর ফসল উৎপাদনহচ্ছে। এতে কৃষি খরচ অর্ধেক কমে গেছে।

কালীগঞ্জ উপজেলার মোস্তবাপুর গ্রামে ৮৫, দাপনা গ্রামের ৭৫, মহেশ্বরদাচা গ্রামের ৯০, নিয়ামতপুর গ্রামের ৬৫, মহিষাডোরা গ্রামের ৪৬, বলরামপুর গ্রামের ১৬১, অনুপমপুর গ্রামের ৬১, হরিগোবিন্দপুর গ্রামে ৫৬, আড়ুয়াশলুয়া গ্রামে ৬১, বলাকান্দর গ্রামের ৫১, ভোলপাড়া গ্রামের ৫৩, বারোপাখিযা গ্রামের ১২৬, খামারমুন্দয়া গ্রামে ১৪, আগমুন্দিয়া গ্রামে ২৫ এবং মল্লিকপুর গ্রামের ৮১ জনসহ সহাস্রাধিক নারী কেঁচো চাষ করছেন।

দিন দিন তাদের চাষ পদ্ধতি গ্রামের পর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। এসব গ্রামের নারী কৃষকরা গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা ।

কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে তারা জানান, বাড়ির আঙিনায় মাটিতে গর্ত বা পাকা হাউজ করে খুব সহজেই কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি করা যায়। এরপর গর্ত বা হাউজে গরুর গোবর, নিমগাছের পাতাসহ বাড়ির ময়লা আবর্জনা দিয়ে ভরাট করার পর বিশেষ ধরনের কেঁচো ছেড়ে দেয়া হয়। এসব কেঁচো ময়লা আবর্জনা খেয়ে ‘আদর্শ জৈব সার’ উৎপাদন করে। এতে সময় ৩০ থেকে ৩৫ দিন লাগে।

নিজের জমিতে দেয়ার পর অতিরিক্ত সার ১০ টাকা কেজি দামে বিক্রি করা হয়। এক কেজি কেঁচো ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা বিক্রি হয়।

উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের মোস্তফাপুর গ্রামের কৃষাণী মনোয়ারা বেগম চাঁদপুর টাইমসকে জানান, জাপানভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ‘হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। বর্তমানে তিনি সচ্ছল। প্রতি মাসে কেঁচো ও সার বিক্রি করে প্রায় ১৫ হাজার টাকা আয় হয়। সংসারের কারো ওপর নির্ভর করতে হয় না। আগে তার কাঁচা ঘর ছিল। এখন পাকা ঘর। দুধ খাওয়ার জন্য একটি গাভী কিনেছেন। এ ছাড়া বিষমুক্ত সবজি ও ফসল উৎপাদন করছেন।

তিনি কৃষি ও সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য এ পর্যন্ত ৫ বার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পুরস্কৃত হয়েছেন।

বলরামপুর গ্রামের কৃষাণী মরজিনা খাতুন চাঁদপুর টাইমসকে জানান, নারীদের অধিকার আদায়ে সংগঠিত করা ও কৃষিতে বিশেষ অবদান রাখায় ২০১৩ সালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হয়ে ভিয়েতনাম পরিদর্শন করেছেন।

সেখান থেকে জৈব সার ব্যবহার করে উন্নত চাষ পদ্ধতি রপ্ত করেছেন। বর্তমানে তিনি প্রতিমাসে ১২ হাজার টাকার বেশিআয় করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিশেষ সাফল্যের জন্য ২০১৪ সালে তাকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার প্রদান করেছেন।

একই গ্রামের রাজিয়া খাতুন চাঁদপুর টাইমসকে জানান, কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন এবং বিক্রি করে ৪৫ শতক জমি কিনেছেন। এ ছাড়া পাকা বাড়ি করেছেন। তার অক্ষম প্রতিবন্ধী স্বামীর সংসারে একমাত্র আয়েরউৎস কেঁচো কম্পোস্ট।

নিয়ামতপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সাজেদুর রহমান লিটন চাঁদপুর টাইমসকে জানান, কেঁচো কম্পোস্ট এলাকার কৃষিতে বিশাল এক বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে। পুরুষের পাশাপাশি এলাকার স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা ও দরিদ্র মহিলারা কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করে। এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে কেঁচো চাষ হচ্ছে। তিনি এসব পিছিয়ে পড়া নারীদের সফলতা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।

কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. এম গুল হোসেন চাঁদপুর টাইমসকে জানান, কেঁচো দিয়ে তৈরি কম্পোস্ট সারাদেশের কৃষিক্ষেত্রে বিরাট এক পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে। কৃষি জমিতে কেঁচো কম্পোস্ট পর পর ৩ থেকে ৪ বছর ব্যবহার করলে রাসায়নিক সার ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না। এমনকি কোনো জৈব সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করেই চাষ করা সম্ভব।

তিনি আরো বলেন, দেশের উর্বর মাটিতে যেসব উপাদান থাকে, তার চেয়ে কেঁচো কম্পোস্ট সারে নাইট্রোজেন ৫ গুণ, ফসফরাস ৭ গুণ এবং পটাশ ১১ গুণ বেশি।এ ছাড়া সালফার, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, বোরন, ম্যাগনিজ, কপার, অ্যালিমুনিয়াম ও জিঙ্কসমৃদ্ধ ।

ফলে মাটির গুণাগুণ অনুযায়ী প্রতিবছর শতকে ৫ থেকে ১০ কেজি কেঁচোকম্পোস্ট ব্যবহার করা হলে ৩ থেকে ৪ বছরে মাটির পূর্ণতা ফিরে আসবে ।

তখন জমিতেকোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না । এমনকি কোনো ধরনের জৈব সার এবং কীটনাশক ছাড়াই চাষ-আবাদ করা যাবে।

ঝিনাইদহ জেলা কৃষি অফিসার আকরামুল হক চাঁদপুর টাইমসকে জানান, কেঁচো কম্পোস্ট বা জৈব সার কৃষি চাষাবাদে দারুণ ফলপ্রসু । এ সার মাটি যেমন সুস্থ রাখে তেমন এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি ও ফসল খেলে সুস্থ জীবন উপভোগ করা যায়।

প্রতিবেদক- জাহিদুর রহমান তারেক, ঝিনাইদহ করেসপন্ডেন্ট

Share