কুমিল্লার বাঁশি পল্লীতে কারিগরদের ব্যস্ততা

বৈশাখী মেলা অন্যতম অনুষঙ্গ বাঁশি। বৈশাখকে মুখর করতে বাঁশির যেন কোন বিকল্প নাই। সারা বছর জুরেই বাঁশের বাঁশি তৈরি করেন কুমিল্লার হোমনার উপজেলার শ্রীমদ্দি ও সদর উপজেলার সংরাইশের বৈরাগী পাড়া বাঁশি পল্লীর শত শত শিল্পী। বৈশাখ এলেই ব্যস্ততা বেড়ে যায় তদের। বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে বাঁশি তৈরীর ধুম পড়ে যায়। বৈশাখী মেলায় নানান রঙ আর সুরের বাঁশি যোগান দিতে রাত দিন বাঁশি তৈরীতে ব্যস্ত কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দি গ্রামের ১৩০ টি পরিবার। শ্রীমদ্দির বাঁশির আলাদা চাহিদা রয়েছে। শুধু শ্রীমদ্দি নয়, সদর উপজেলার সংরাইশ বৈরাগী পাড়ার বাঁশির কদর রয়েছে। মেলাকে কেন্দ্র করে এবারও ব্যাস্ততা বেড়েছে তাদের। শিল্পীরাও এখন ভীষণ ব্যস্ত বাঁশি তৈরীতে। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটিকে কেন্দ্র করেই তাদের বাঁশি তৈরী ও বিক্রির প্রধান লক্ষ্য।

করোনার ধকল কাটিয়ে দীর্ঘ দুই বছর পর এবার দুরদুরান্তের কারিগররা এসেছেন বাঁশি নিতে। বরিশালের বাঁশি শিল্পী ও পাইকার আবদুল জলিল জানান, নানান দামের নানা জাতের বাশি তৈরী হয় শ্রীমদ্দির কারিগরদের হাতে। বৈশাখী মেলায় শ্রীমদ্দির আঁড়, মুরালী, খিলা, নাগিন আর বেলুন বাঁশির চাহিদা বেশী।

বাঁশি তৈরীর প্রক্রিয়ায় শুরুতেই চট্টগ্রাম ও ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে কিনে আনা হয় সরু মুলি বাঁশ প্রথম ওই বাঁশ গুলো রোদে শুকানো হয়। এরপর বিভিন্ন ধরনের বাঁশির উপযোগী বাঁশগুলো বাছাই করে চেঁছে মসৃণ করে মাপ অনুসারে কাটা হয়। মোহন বাঁশি, মুখ বাঁশি, নাগিনী বাঁশি, পাখি বাঁশিসহ নানা রকমের বাঁশি তৈরি করে কারিগরেরা।

একটি বাঁশ থেকে কমপক্ষে পাঁচটি বাঁশি বানানো যায়। প্রতিটি বাঁশের দাম পাঁচ টাকা। আর বড় আকৃতির একটি বাঁশির দাম পড়ে পাঁচ-ছয় টাকা। ছোট বাঁশির দাম তিন টাকা। তবে মোহন বাঁশির দাম ১০ টাকা, মুখ বাঁশি আট টাকা, নাগিনী বাঁশি সাত টাকা এবং পাখি বাঁশি ছয় টাকা দরে বিক্রি হয়। বাঁশ আনা-নেওয়ার খরচ এবং কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো লাভ হচ্ছে না বলে কারিগরেরা জানিয়েছে। তাই বাঁশির কারিগরদের অনেকে উৎপাদন ও বিক্রির কাজটি নিজেরাই করে থাকেন। আর যাদের পুঁজি নেই, তারা মজুরির ভিত্তিতে বাঁশি তৈরীতে কাজ করেন। ১০০ বাঁশির মজুরি ২০ টাকা। প্রতিদিন প্রায় এক হাজার বাঁশি বানাতে পারেন একজন কারিগর।

তবে, আজকাল কারিগর সংকট এবং কয়লা, বাঁশ ও অণ্যান্য কাঁচামালের দাম বেশী থাকায় প্রভাব পড়েছে বাঁশির দামেও। প্রবীণ কারিগর সিরাজুল ইসলাম জানান, এসব কারনে আশানুরূপ লাভ পাচ্ছেন না তারা।

এছাড়া প্লাাস্টিকের সামগ্রীর প্রভাবসহ নানা কারনে একদিকে যেমন মেলায় বাঁশির চাহিদাও কমছে আসছে অন্যদিকে মেলাও কমে আসায় এই পেশায় টিকে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে বাঁশি তৈরীর শিল্পীদের। যুগের চাহিদা অনুযায়ী সুযোগ সুবিধা না বাড়ায় এবং কাঁচা মালের দাম বেশি হওয়াতে রাতদিন বাশি তৈরী করেও লাভ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কারিগরদের। পূর্ব পুরুষের এই পেশাটিকে শিল্পের আওতায় এনে সরকারি সহযোগিতাও প্রত্যাশা করলেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার সহায়তায় শ্রীমদ্দির বাঁশি রপ্তানি হচ্ছে সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন, জাপান, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রে। বিদেশেও চাহিদা থাকা কুমিল্লার বাঁশি শিল্প উন্নয়ণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে মনে করেন সাংস্কৃতিক সংগঠক আবদুল হক সরকারসহ স্থানীয় সংস্কৃতিসেবীরা।

বৈশাখী মেলা ছাড়া বাংলা ঐতিহ্যের নববর্ষ উদযাপন যেমন অপূর্র্ন, তেমনি মেলা জমে উঠে না বাঁশির শব্দ ছাড়া। বাঁশি বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে আছে হাজার বছর ধরে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার দাবি সকলের।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বাঁশি শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের পৃষ্ঠপোষকতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। এই বৈশাখী মেলায় সকল বাঁশি উৎপাদনকারীদের জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সামনে স্টল দেয়ার আহবান জানান তিনি।

প্রতিবেদক: জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল, ১৩ এপ্রিল ২০২২

Share