Home / সারাদেশ / কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি শিল্পের একাল সেকাল
খাদি

কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি শিল্পের একাল সেকাল

শিক্ষা সংস্কৃতি আর ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এক জনপদ কুমিল্লা। লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ী এলাকার প্রত্নত্বাত্ত্বিক নিদর্শনসহ বেশকিছু শিল্প-সংস্কৃতি এ জনপদের স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করে। এগুলোর অন্যতম কুমিল্লায় উৎপাদিত রসমলাই। ইতিমধ্যেই যা দেশের অন্যতম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি লাভ করেছে। এছাড়াও রয়েছে বিজয়পুরের মৃৎশিল্প, শ্রীমদ্দির বাশের বাঁশি শিল্প এবং কুমিল্লার খদ্দর বা খাদি শিল্প প্রভৃতি।

খদ্দর বা খাদি। এটি কোন সুতা বা কাপড়ের নাম নয়। খাদি একটি কাপড় বুনন শিল্প। তুলা থেকে চড়কায় সুতা কেটে, সেই সুতা দিয়ে খাদ বা গর্তে বসে হস্ত চালিত তাঁতের মাধ্যমে কাপড় বুনা হয় বলেই একে খদ্দর বা খাদি বলা হয়। আর কুমিল্লার চান্দিনাকে বলা হয় খাদি’র আদি এলাকা বা খদ্দর শিল্পে আতুরঘর।

খাদি

মূলতঃ ১৮ শতকের গোড়ার দিকে কুমিল্লার দরিদ্র জনগোষ্ঠির কাপড়ের চাহিদা মেটাতে স্থানীয় ভাবে কাপড় উৎপাদন করা হতো। চড়কার মাধ্যমে নিজেরাই তুলা থেকে সুতা তৈরী এবং সেই সুতায় হস্তচালিত তাঁতে বুনা হতো কাপড়।
খাদি যে কেবল শিল্প তা নয়; বাঙালী সংস্কৃতির সাথে একাকার হয়ে আছে এ নামটি। শতবর্ষের পথ পরিক্রমায় খাদি শুধু কুমিল্লার ঐতিহ্যই নয়, এ উপমহাদেশের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসের সাথেও জড়িয়ে আছে খাদির নামটি। ঐতিহাসিক কারনে কুমিল্লা অঞ্চলে শিল্প দ্রুত বিস্তার লাভ এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করে ব্রিটিশ ভারতে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের সময়কালে।

১৯২১ সালে মহাত্মাগান্ধীর আহবানে সমগ্র ভারতবর্ষে যখন শুরু হয় ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন, তখন এ আন্দোলনের অংশ হিসেবে সর্বত্র শ্লোগান উঠে “স্বদেশী পণ্য গ্রহণ কর আর বিদেশী পণ্য বর্জন কর”। এ আন্দোলনের সময় থেকে মহাত্মাগান্ধীর হতে ধরেই স্বদেশী পণ্য হিসেবে হস্ত চালিত তাঁতে বুনা এই কাপড়ে উপর নির্ভরশীলতা শুরু হয় এবং দেশীয় পণ্য হিসেবে জনপ্রিয়তা বেড়ে উঠে খাদির। তখন থেকেই খাদি হয়ে ওঠে দেশপ্রেমের প্রতীক। এর ওপর ভিত্তি করেই তৎকালীন সময়ে খাদি একটি শিল্পে রূপ নেয়।

সে সময় ‘নিখিল ভারত তন্তুবায় সমিতি’র একটি শাখাও গঠন করা হয় কুমিল্ল ‘র অভয়াশ্রমে। অল্প সময়ের মধ্যে শিল্পগত উৎকর্ষ সাধন আর খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যায় কুমিল্লার খাদি শিল্প।

পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে ওই সমিতি কুমিল্লা শাখা থেকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করে নেয় ‘নিখিল ভারত তন্তুবায় সমিতি’। ফলে খাদিশিল্প প্রসারের ২৬ বছরের মাথায় হঠাৎই যেন হোচট খায়। থমকে দাঁড়ায় শিল্পটি। বিপর্যয় নামে খাদিশিল্পে।

অবশ্য খাদিশিল্পের এ বিপর্যয় বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এদেশে সমবায় আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, তৎকালীন কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ও কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ণ একাডেমী (বার্ড) এর প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খানের সার্বিক প্রচেষ্টায় এবং তৎকালীন গভর্ণর ফিরোজ খান নুনের সহযোগিতায় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পর থেকে আবারও ঘুরেদাঁড়ায় এ শিল্পটি। তাঁদের দুজনের হাত ধরেই কুমিল্লার অভয়াশ্রমে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘দি খাদি এন্ড কটেজ ইন্ডাষ্ট্রিজ এসোসিয়েশন’ নামে একটি খদ্দর কারখানা। অত:পর এই প্রতিষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষকতায় খাদিশিল্প প্রসারে একটি প্রশিক্ষণ ও বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। কুমিল্লার চান্দিনাতে ড.আখতার হামিদ খান প্রতিষ্ঠা করেন ‘দি খাদি কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড’। তখন থেকেই কুমিল্লার খাদি পণ্যের জৌলুশ ফিরে আসে। উন্নতমানের সামগ্রী হিসেবে সুনামের জায়গাটি আবারও দখল করে নেয়।

মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত কুমিল্লার চান্দিনাতে পরবর্তী কালে ড. আখতার হামিদ খান প্রতিষ্ঠিত ‘দি খাদি কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড’ এর হাল ধরেন যথাক্রমে চান্দিনার শৈলেন গুহ ও তার ছেলে বিজন গুহ। তারা এই খাদিশিল্পের সুনাম ছড়িয়ে দেয়ার জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন। শৈলেন গুহ মারা যাবার পর তার ছেলে বিজন গুহ এ শিল্পটিকে ধরে রাখছেন।

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে গুণগত মান বজায় রাখার জন্য ১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় কুমিল্লার খাদিশিল্প।
খাদির সাথে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপচারিতায় এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানাযায় খাদির সুদীর্ঘ পথপরিক্রমার নানান ইতিহাস। খাদির আদি নিবাস কুমিল্লার চান্দিনা পৌর এলাকাধীন চান্দারপাড় এলাকায় অবস্থিত ‘গ্রামীন খাদি’ নামের খদ্দর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি। এর প্রতিষ্ঠাতা শৈলেন্দ্রনাথ গুহ। তারা নিজেদের আদি খদ্দরের কাপড় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বলে দাবী করেন। আর এর মাঝে বেচেঁ আছে কুমিল্লার খদ্দর। ২০১৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে গ্রামীন খাদির তৎকালীন পরিচালক অরুন কান্তি গুহ (বর্তমানে প্রয়াত) জানান, চড়কায় সুতা উৎপাদন ও খদ্দর কাপড় তৈরীর জন্যে চান্দিনা, দেবিদ্বার, হোমনা, তিতাসের বিভিন্ন তাতঁশিল্পিদের অগ্রীম টাকা দিয়ে এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখার প্রানান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের প্রতিষ্ঠান ‘গ্রামীন খাদি’ ।

তিনি জানান, ঢাকার কিছু পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদের পছন্দের নমুনা পাঠান। সেই অনুযায়ী ‘গ্রামীন খাদি’ কাপড় উৎপাদন করে দেন। ঢাকার ওইসকল প্রতিষ্ঠানের তৈরী খাদি কাপড়ের পোশাক রপ্তানী হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এক্ষেত্রে আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, বেলজিযাম, ফ্রান্স, জার্মানী, অস্ট্রেলিয়া, জাপান উল্লেখযোগ্য।

ঢাকার প্রতিষ্ঠিত রপ্তানী কারক প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বিবি রাসেল, রুবি গজনবী, ছোটনা, দেশাল, ক্রেক্রাফট, প্রবর্তনা, মটিভ, রঙ, অঞ্জনস, নিপূণ, বাংলার মেলা।

একদা কুমিল্লার চান্দিনা, দেবিদ্বার উপজেলার যেসব তাঁত পল্লীতে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁতীরা ব্যস্ত থাকতো খদ্দর কাপড় বোনায়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরেও রপ্তানী হতো প্রসিদ্ধ এই খদ্দর কাপড়। সেখানে এখন চালু রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি তাঁত। যুগের পরিবর্তনে আমাদের দেশীয় পোষাক শিল্প হয়েউঠেছে যান্ত্রিক নির্ভর। পাওয়ার লুম বা মেশিনে তৈরী কাপড়ের দাপটে খদ্দর কাপড় কোনঠাসা। প্রতিযোগীতার বাজারে টিকতে না পেরে তাঁতীদের অনেকেই বাপ দাদাদের পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁতী বাড়ি গুলো আজ যেন হাহাকার করছে। যারাও টিকে আছেন তাদের পক্ষেও ঐতিহ্য ধরে রাখা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রয়োজনীয় তুলা আর পুজির অভাবে তাঁতী বাড়ী গুলো আজ নিশ্চুপ।
এই যান্ত্রিক পেশাক শিল্প বিকাশের কারনে কোনঠাসা হয়ে পরেছে খাদির মতো দেশীয় হস্থশিল্প গুলো। কোনমতে টিকে থাকা খাদি শিল্পের তাঁতীরা সামান্য কাপড় বুনে পাচ্ছেন না তার ন্যায্য মুল্য।

চান্দিনার কান্দার পাড়ে অবস্থিত গ্রামীণ খাদি ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও খাদি কো-অপারেটিভ এর সাবেক সাধারণসম্পাদক প্রয়াত শৈলেন্দ্র নাথ গুহ এর ছেলে অরুণ কুমার গুহ (প্রয়াত) এর সাথে ২০১২ সালে সামাজিক সংগঠন ‘ঐতিহ্য কুমিল্লা’র সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম ইমরুলের দীর্ঘ আলাপচারিতায় উঠে আসে খাদি শিল্পের দীর্ঘ পরিক্রমার গল্প।

তিনি বলেন, কুমিল্লার খাদির কদর কমেনি। ঈদ কিংবা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবগুলোকে কেন্দ্র করে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি কাপড়ের দোকান গুলোতে কেতাদের সমাগমই বলেদেয় খাদির চাহিদা কমেনি। এখনো ঈদ আর পূঁজা পার্বন এলে বাজারে চাহিদা বাড়ে খাদির। একারনেই এসব উপলক্ষকে সামনে রেখে অনেকটাই ব্যাস্ত সময় পার করেন কুমিল্লার খাদি কারিগররা।

‘ঐতিহ্য কুমিল্লা’কে দেয়া ওই সাক্ষাৎকারে খাদি কো-অপারেটিভ এর সাবেক সাধারণসম্পাদক অরুন গুহ বলেন, নকল পন্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেনা খাদি। ঠিক এমনটাই জানালেন বিভিন্ন কারখানা মালিকরাও। তাদের অভিযোগ নরসিংদীসহ দেশের বেশকিছু স্থানে খাদির আদলেই নকল খাদি ব্যাপক হারে উৎপাদন করছে। তাদের নকলের ভীড়ে এতো সীমিত আকারে তৈরী করে কুমিল্লার আসল খাদি টিকে থাকা দূরহ। তিনি বলেন, সরকারী পৃষ্টপোষকাতা না পেলে অচিরেই হারিয়ে যাবে কুমিল্লা ঐতিহ্যবাহি খাদি শিল্পটি। পাশাপাশি বেকার হয়ে পড়বে এ শিল্পের নেপথ্য নায়ক তাঁতশিল্পীরা। যারা অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও সংগ্রাম করে ধরে রেখেছেন এ শিল্পটিকে।

কান্দিরপাড় খাদি ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি ও ‘কুমিল্লা খদ্দর’ এর স্বত্বাধিকারী কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এখনও এ পোশাকের চাহিদা বেশি। কুমিল্লা জেলার বাইরে থেকেও প্রচুর ক্রেতা আসে।

‘ঐতিহ্য কুমিল্লা’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে মনোহরপুরের ‘খাদিঘর’ এর স্বত্বাধিকারী, কুমিল্লা খাদি ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য প্রদীপ কুমার রাহা বলেন, বর্তমানে সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খদ্দরের কাপড়ের চাহিদা রয়েছে।

প্রদীপ কুমার রাহা কান্তি নগরীর মনোহরপুর এলাকার খাদি পোশাকের প্রাচীণ ও নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান আদি খাদির স্বত্তাধিকারী। তিনি বলেন, যুগের পরিবর্তনে আমাদের দেশীয় পোষাক শিল্প হয়েউঠেছে যান্ত্রিক নির্ভর। এই যান্ত্রিক পেষাক শিল্প বিকাশের কারনে কোনঠাসা হয়ে পরেছে খাদির মতো দেশীয় হস্থশিল্প গুলো। সরকারী পৃষ্টপোষকাতা না পেলে অচিরেই হারিয়ে যাবে কুমিল্লা ঐতিহ্যবাহি খাদি শিল্পটি। পাশাপাশি বেকার হয়ে পড়বে এ শিল্পের নেপথ্য নায়ক তাঁতশিল্পিরা। যারা অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও সংগ্রাম করে ধরে রেখেছেন এ শিল্পটিকে।

তিনি বলেন, সময়ের পরিক্রমায় ফ্যাশন ডিজাইনারদের ছোঁয়ায় মোটা ও মিহি সুতায় তৈরি হচ্ছে খাদির পোশাক। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক ও রুচিশীল পোশাক তৈরি হচ্ছে খাদি কাপড়ে। পাশাপাশি কাপড়েও বৈচিত্র্য আনা হয়েছে মোটা সুতার ব্র্যান্ডের সাথে মিহি সুতা এবং খাদির সঙ্গে রকমারি সুতার চেক বুনে। এচাড়া ব্লক দিয়েও তৈরি করা হচ্ছে সুন্দর পোশাক। খাদি কাপড়ের রং, নকশা ও বুনন বৈচিত্র্য এ পণ্যের চাহিদাও বাড়িয়ে দিয়েছে।

কুমিল্লা নগরীর মনোহরপুরের খাঁদি কাপড় ব্যবসায়ী ‘খাদি ভবন’ এর স্বত্তাধিকারী সানাই দাশগুপ্ত আক্ষেপ করে বলেন, খাদি কাপড়্ররে উৎপাদন দিন দিন কমতে থাকায় তাঁতের তৈরী আসল খাঁদির আড়ালে দোকান গুলোতে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে মেশিনে উৎপাদিত নকল খাঁদি। এ ক্ষেত্রে খাঁদি বাজারে প্রশাসনের নজরদারীরও দাবি জানান তিনি।
খাদি কাপড় ও পোশাকের মধ্যে মহিলাদের শাড়ি ও থ্রিপিস, পুরুষের ফতুয়া ও পাঞ্জাবি। পাশাপাশি খাদি কাপড়ে তৈরী হচ্ছে নকশিকাঁথা ও বিছানার চাদর।

কুমিল্লা শহরের উল্লেখযোগ্য দোকানগুলো হচ্ছে- মনোহরপুরে রয়েছে খাদিঘর, পূর্বাশা গিফট অ্যান্ড খাদি-২, রাজগঞ্জের আবরণী, প্রসিদ্ধ খাদি ভান্ডার, কান্দিরপাড় এলাকার খাদি মিউজিয়াম, নিপুণ খাদি ফ্যাশন, খাদি বিপণি, কুমিল্লা খাদি ভান্ডার, খাদি প্রিয়াঙ্গন, খাদি কুটির শিল্প ভবন, খাদি ইয়াছিন বস্ত্রালয়, কুমিল্লা খদ্দর, খাদি শিল্প ভবন, খাদি কটেজ, শিল্পী খাদি বিতান, খাদি বস্ত্র বিতান, পূর্বাশা গিফট অ্যান্ড খাদি-১, জ্যোৎস্না স্টোর, খাদি বসুন্ধরা, শুভেচ্ছা খাদি বিতান, আল আমিন খাদি ঘর, খাদি বস্ত্রালয় ও খাদি বস্ত্র বিতান।

বাজারে খাদি পোশাকগুলোর মধ্যে মেয়েদের থ্রিপিস ৪৩০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা, শর্ট ফতুয়া ৪০০ থেকে ৯০০ টাকা, শাড়ি ৪০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা, জামা (শার্ট) ৪০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা, সাদা ও রঙিন পাঞ্জাবি সর্বনিম্ন ৫৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা। এ ছাড়া বিছানার চাদর ৩০০ থেকে ৬ হাজার টাকা এবং নকশিকাঁথা ৩ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে কুমিল্লার খাদি বাজারে।

কুমিল্লার খাদিশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে যারা নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে খাদি ঘরের প্রদীপ রাহা, খাদি বিতানের আবদুস সাত্তার, হারুন ব্রাদার্সের হারুনুর রশিদ, খাদি কুটিরের তপন চক্রবর্তীসহ আরো অনেকে। তারা কুমিল্লার খাদিশিল্প টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।

অন্যদিকে কুমিল্লার খাদিশিল্পকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে যারা নিরলস পরিশ্রম করেগেছেন তাদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। তাদের মধ্যে ‘খাদি ঘর’ এর তরণী মোহন রাহা, ‘খাদি কুটির শিল্প’ এর শংকর সাহা, ‘খাদি ভবন’ এর দীনেশ দাশ, ‘বিশুদ্ধ খদ্দর’ এর মনমোহন দত্ত, ‘রাম নারায়ণ স্টোর’ এর কৃষ্ণ সাহাসহ অনেকে। এছাড়াও ‘খাদি শিল্পায়ন’, ‘বঙ্গশ্রী খাদি’ এর সত্ত্বাধিকারীরা চলে গেছেন ভারতে।

পোশাকের বাজারে কুমিল্লার যে খদি কাপড়ের খ্যাতি অনেকদূর বিস্তৃত, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও। আজ নানা প্রতিকূলতায় ঐতিহ্যবাহী এই খাদি জৌলুস হাড়াচ্ছে । নকল খাদিতে সয়লাব বাজার।

একটা সময় কুমিল্লার খাদি পল্লী গুলোতে তাঁতীদের দিনরাত কর্মব্যস্তা ছিলো চোখে পড়ার মতো। গ্রামময় কারখানায় তাঁতের খট খট শব্দ দিন রাত শোনা যেতো। অথচ সময়ের ব্যাবধানে অনেক পটপরিবর্তন হয়েছে এশিল্পে। নানা প্রতিকূলতার কারনে বাপ দাদাদের পেশা আর ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারছেন না এই শিল্পে সংশ্লিষ্ট বর্তমান প্রজন্ম । এসব প্রতিকূলতার মাঝে কিছু খাদি শিল্প টিকে থাকলেও নেই আগের মতো জৌলুস। তাঁতী বাড়ী গুলোতে ভড়ামৌসুমেও বিরাজ করে শোনশান নিরবতা । তাই ঈদকে সামনে রেখেও কুমিল্লার তাঁতী বাড়ী গুলোতে নেই আগের মতো ব্যাস্ততা। ভড়ামৌসুমেও শোনশান নিরবতা। হাসি নেই তাঁত শিল্পীদের মুখে।

ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটি সুদীর্ঘকাল ধরে এ জেলার নামটি বিশ্বের দরবারে পরিচিত করে তোললেও যে তাতীঁরা এই শিল্পটির জন্য এত মেধা শ্রম দিয়েছেন, তাদের উন্নয়নে কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই পেশা থেকে দুরে সরে যাচ্ছে তাতীঁরা। এই সুযোগে খাদির বাজার দখল করছে রূপান্তরিত খাদি নামে মেশিনের তৈরী তাতের কাপড়। কিছু মুনাফালোভী অসাধূ ব্যবসায়ী দেশের সর্বত্র রূপান্তরিত খাদিকেই কুমিল্লার খাদি কাপড় বলে বিক্রি করা হচ্ছে!
কালের পরিক্রমায় কুমিল্লার এ ঐতিহ্যর এখন দুর্দিন। জেলার চান্দিনা ও দেবীদ্বার উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা মেলেছে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি তাঁতের কল। প্রতিযোগীতার বাজারে টিকতে না পেরে তাঁতীদের অনেকেই বাপ দাদাদের এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। পাওয়ার লুম (মেশিনে তৈরী কাপড়) এর দাপটে খদ্দর কাপড় কোনঠাসা। এদিকে তাঁতীরা যে সামান্য কাপড় বুনে তার ন্যায্য মুল্য পান না। কোনমতে টিকে থাকা খাদি শিল্পের তাঁতীরা সামান্য কাপড় বুনে পাচ্ছেন না তার ন্যায্য মুল্য। বিশেষ করে ঈদকে সামনে রেখে চান্দিনার খাদি কারখানা গুলোতে কিছুটা ব্যাস্ততা দেখা গেলেও সারাবছর অনেকটা অলস সময়ই কাটান কারিগররা।

কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার বরকামতা গ্রামের অবস্থিত ‘গ্রামীণ খাদি ফ্যাক্টরী’ এর স্বত্তাধিকারী শ্রী চিন্তাহরন দেবনাথ ‘ঐতিহ্য কুমিল্লা’র সাথে সাক্ষাৎকার প্রদান কালে খাদি শিল্পের একাল সেকাল নিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। জানান খাদির ঐতিহাসিক নানান গল্প এবং খাদিকে টিকিয়ে রাখতে তার প্রানন্তর সংগ্রামের কথা। তিনি জানান, চরকার মাধ্যমে তুলা থেকে তৈরী সুতা দিয়ে তাঁতে বুনা হতো খাঁদি কাপড়। ঐতিহাসিক কারনে কুমিল্লা অঞ্চলে খাদি শিল্প দ্রুত বিস্তার লাভ করে। একদা কুমিল্লার গ্রামে গ্রামে ছিলো খাদি কাপড় তৈরীর কারখানা। কুমিল্লার ঐতিহ্য এ খাঁদি কাপড়ের কারখানাগুলোতে চলছে দুর্দিন। জেলার চান্দিনা ও দেবিদ্বার উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা মেলেছে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি তাঁতের কল। ঈদকে সামনে রেখেও তাঁতী বাড়ী গুলোতে নেই ব্যাস্ততা। ভড়ামৌসুমেও শোনশান নিরবতা। প্রতিযোগীতার বাজারে টিকতে না পেরে তাঁতীদের অনেকেই বাপ দাদাদের এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তবে, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখনো এখনো খাঁদিও জৌলুস ফিড়িয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন এই শিল্পে সংশ্লিষ্টরা।
কুমিল্লার খাদি পল্লী হিসেবে খ্যাত জেলার চান্দিনা ও দেবিদ্বার উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম। বর্তমানে চান্দিনার বেলাশ্বর ও দেবিদ্বারের বড়কামতা গ্রামের প্রায় ৩০/৪০টি পরিবার খাদি শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে। এই সংখ্য বিগত কয়েক বছর আগেও ছিলো কয়েকগুণ।

জেলার বিভিন্নস্থানে ঘুরে তাতীঁদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, বর্তমানে মেশিনের তৈরী কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় হাতে তৈরী কাপড়ের দিকে সাধারন মানুষের নজর কম। এছাড়াও মুজুরী কম থাকায় দিন দিন এই পেশা থেকে লোকজন অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। বর্তমানে কুমিল্লার খাদি’র অবস্থা, এর প্রসার, প্রচার, সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রামীন খাদি’র পরিচালক অরুণ কান্তি গুহ বলেন, প্রাচীন কাল থেকে কুমিল্লার খদ্দর কাপড় জেলা পেরিয়ে দেশের বাইরেও এর সুনাম রয়েছে। তবে মেশিনের উৎপাদিত কাপড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে না পারায় দিন দিন চরকায় কাটা সুতা দ্বারা তাতেঁর তৈরী কাপড়ের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। শুধুমাত্র সরকারী পৃষ্ঠপোষকতাসহ তাতীঁদের আর্থিক সহযোগীতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই ঐতিহ্যবাহী এই খাদিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। কুমিল্লার স্বনামধন্য খাদিশিল্প কে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের সহযোগীতা প্রয়োজন। তাঁতশিল্পীদের কে স্বল্প সুদে ঋণ ও খদ্দর কাপড় তৈরির কাঁচামালের দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

এ ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে কাঁচামাল ও কারিগর সংকট, পরিশ্রমের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং ব্র্যান্ডিংয়ের অভাবে খাদি কাপড় উৎপাদন কমছে।

এদিকে নকল খাঁদি বিক্রেতাদের প্রতি সতর্কবার্তার পাশাপাশি ‘রসমালাইয়ের’মতো খাঁদিকেও জিআই পণ্যের স্বীকৃতি অর্জনে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পঙ্কজ বড়ুয়া। তিনি বলেন, কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি শিল্পসহ বিভিন্ন ঐতিহিাসিক ও ঐতিহ্যবাহী পণ্যগুলোকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি আদায়সহ এগুলোর ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল, ২৯ মার্চ ২০২৪