সারাদেশ

কুমিল্লার আখাউড়াসহ ট্রেন গেলেই পাথর ছুড়ে যে ৩৬ স্পটে

ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম ফিরছিলেন এহেছানুল হক ও সাবরিনা চৌধুরী দম্পতি। কুমিল্লার আখাউড়া স্টেশনে পৌঁছার আগে তাদের আসনের পাশের জানালা ভেঙ্গে কাচের টুকরো শরীরে আঘাত করে। এসময় দুইজনই আহত হন। পরে যাত্রীদের সহায়তায় অনেকটা আতঙ্কের মধ্যে চট্টগ্রাম পৌঁছেন তারা।(খবর বাংলানিউজ)

২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা এটি। এহেছানুল হক রুপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা। চট্টগ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে আসার সময় ঘটনাটি ঘটে।

তিনি বলেন, ওইদিন বিকেল তিনটায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। ট্রেনটি কুমিল্লার কাছাকাছি পৌঁছার আগে ঘুম আসে দুজনের। সাবরিনা জানালার পাশে বসেছিল। এমন সময় পাথর নিক্ষেপের ঘটনা। সে এতো ভয় পেয়েছিল যে, এখন আর জানালার পাশে বসতে চায় না। তিনি প্রশ্ন রাখেন-যারা পাথর ছুড়ে মারছে, তারা কি মানুষ?

চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোড়ার এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার (০৭ জানুয়ারি) ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসার পথে কুমিল্লার গোমতি ব্রিজ এলাকায় সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় ৪ যাত্রী আহত হন। এর আগে ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে ছোড়া ঢিল থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যায় ১৩ মাস বয়সী শিশু।

ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনায় যাত্রীর মৃত্যুও হয়েছে। সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি এলাকায় ২০১৩ সালে চলন্ত ট্রেনে ছোড়া ঢিলে প্রকৌশলী প্রীতি দাশ নিহত হন।

ফাইল ফটোরেলওয়ে সূত্রমতে, পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল মিলিয়ে ৮০টি এলাকা চিহিৃত করা হয়েছে, যেখান থেকে ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটছে। এরমধ্যে পূর্বাঞ্চলের ৫টি জেলার ২০টি এলাকায় ৩৬টি স্পট খুব ঝুঁকিপূর্ণ, যেখান থেকে প্রায় সময় পাথর ছোড়া হয়।

পূর্বাঞ্চলের যেসব এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ

গাজীপুরের টঙ্গী, ঢাকার কারওয়ানবাজার, ঢাকা বিমানবন্দর, জয়দেবপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, জগন্নাথগঞ্জ ঘাট, দেওয়ানগঞ্জ, বাহাদুরাবাদ, কিশোরগঞ্জ, মোহনগঞ্জ, চট্টগ্রাম, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, সীতাকুণ্ড, পাহাড়তলী, বটতলী ও নরসিংদীসহ ২০টি এলাকার ৩৬টি স্পটে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে বেশি।

তবে রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) ওসি মোস্তাফিজ ভূঁইয়া বাংলানিউজকে জানান, পাহাড়তলীতে একসময় পাথর ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটলেও এখন এরকম ঘটনা নেই। পাহাড়তলীতে পাথর ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটার পর কয়েকবার অভিযান চালানো হয় এবং স্থানীয়দের সঙ্গে বৈঠক করার ফলে পাথর ছোড়ার ঘটনা কমে এসেছে।

ফাইল ফটোসূত্রমতে, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে পূর্বাঞ্চলে ৮টি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে নথিভুক্ত হয়েছে ৪টি। এই চারটি ঘটনায় ট্রেনের ক্ষতি হয়েছে। তবে এর বাইরেও যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো নথিভুক্ত হয়নি।

জড়িতরা বস্তির শিশু-কিশোর

জিআরপি সূত্রমতে, ট্রেনে পাথর ছোড়ার যেসব ঘটনা ঘটছে তার সঙ্গে জড়িত ৮০ ভাগই শিশু-কিশোর। যারা বিভিন্ন বস্তি এলাকায় বেড়ে উঠেছে। এতে প্রায়ই যাত্রীরা গুরুতর আহত হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ট্রেনেরও। বস্তির এসব শিশুদের আটক করা হলেও বেশিরভাগ সময় মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম বলেন, পাথর নিক্ষেপের ফলে ট্রেনে যাত্রী আহত হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদও নষ্ট হচ্ছে। মঙ্গলবার (০৭ জানুয়ারি) সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় জানালারগ্লাস সম্পূর্ণ ভেঙে যায়। এসব জানালা অনেক উন্নতমানের, দামও বেশি। মানুষ সচেতন না হলে এরকম ঘটনা থামানো সম্ভব নয়।

ওসি মোস্তাফিজ ভূঁইয়া বলেন, পাথর নিক্ষেপে জড়িত ৮০ ভাগই বস্তির শিশু-কিশোর। এছাড়া অনেকে দুষ্টুমির ছলেও পাথর নিক্ষেপ করে। প্রেম বিরহে এক যুবক সিলেটগামী ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। তাকে আটকও করেছিলাম।

‘যারা পাথর নিক্ষেপ করে তাদের চিহ্নিত করাও চ্যালেঞ্জ। প্রায় সময় তাদের চিহ্নিত করা যায় না। তাই তাদের আইনের আওতায়ও আনা যায় না’ বলেন জিআরপির এই ওসি।

পাথর ছোড়ার অপরাধে শাস্তি

রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারায় ট্রেনে পাথর ছুড়লে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। পাথর ছোড়ায় যদি কারও মৃত্যু হয়, তাহলে ৩০২ ধারায় দোষীর মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে। তবে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় শিশু ও কিশোররা জড়িত থাকায় তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো হয়। এ আইনে এখন পর্যন্ত কারো শাস্তির নজির নেই বলেই জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ফাইল ফটোরেলওয়ে নিরাপত্তাবাহিনীর (আরএনবি) পরিদর্শক আমান উল্লাহ আমান বলেন, পাথর নিক্ষেপ তখনই বন্ধ হবে যখন মানুষ সচেতন হবে। আমরা প্রতি সপ্তাহে কয়েকবার ঝুঁকিপূর্ণ স্পটে গিয়ে পাথর নিক্ষেপ প্রতিরোধে প্রচারণা চালাচ্ছি। এলাকার মানুষজনকে সচেতন করছি।

প্রতিকার শুধু সচেতনতায়

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা এখন খুব বেশি জোর দিয়েছি পাথর নিক্ষেপ প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করার কাজে। পুলিশ, নিরাপত্তাবাহিনী ও রেলওয়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া আছে, প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মানুষকে সচেতন করার। এছাড়া চিহ্নিত এলাকায় পুলিশের টহল বৃদ্ধি করেছি। পুলিশ আগের চেয়ে বেশি টহল দিচ্ছে।

‘আমরা লিফলেট তৈরি করে সেগুলো প্রচার করছি। মানুষের জীবন নিয়ে যারা খেলা করছে, আমরা তাদের সতর্ক করছি। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি এর ভয়াবহতা সম্পর্কে’ বলেন নাসির উদ্দিন আহমেদ।

Share