কুকুরের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত সেই শিশুটি এখন কোথায় যাবে?

নাম-পরিচয়হীন হতভাগা সেই নবজাতক শিশুটির ঠাঁই কোথায় হবে- সমাজসেবা অধিদফতরের চাইল্ড হোমে না-কি দত্তক হিসেবে কোনো সন্তানহীন মা পরমস্নেহে কোলে তুলে নেবেন? ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের স্পেশাল বেবি কেয়ার ইউনিটে (স্কাবো) কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়সহ অন্যান্য সকলের মনে গত দু’দিন যাবত এমনই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কারণ আগামী সপ্তাহের যেকোনো দিন নবজাতক শিশুটিকে হাসপাতালে থেকে ছেড়ে দেয়া হবে

চিকিৎসকরা জানান, স্কাবোতে বেড স্বল্পতা, মুমূর্ষু নবজাতক রোগীর অতিরিক্ত চাপ ও আপাতত এই নবজাতকের আর হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন না থাকায় মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা খুব শিগগিরই তাকে রিলিজ দেয়ার জোর চিন্তাভাবনা করছেন।

নবজাতক বিভাগ ও মেডিকেল বোর্ড প্রধান অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা জানান, শিশুটিকে আগামী সপ্তাহে স্পেশাল বেবি কেয়ার ইউনিট থেকে রিলিজ করে দেয়া হতে পারে। আগামী শনিবার তারা এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। আপাতত হাসপাতালে নবজাতক শিশুটির আর কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। আজ প্লাস্টিক সার্জারি বিশেষজ্ঞরা নবজাতক শিশুটিকে দেখতে আসেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক প্লাস্টিক সার্জন জানান, কুকুরের কামড়ে ক্ষুদে এই শিশুটির বুড়ো আঙ্গুল ও তার পাশের আঙ্গুল খসে পড়ার অবস্থা হয়েছিল। কুকুর কামড়ে ঠোঁটের মাংস ছিঁড়ে ফেলেছিল। তবে বর্তমানে আগের তুলনায় ক্ষত কম। কিন্তু তার রিকনস্ট্রাকটিভ প্লাস্টিক সার্জারি করতে হবে।

তারা বলেন, নবজাতকের বয়স খুবই কম হওয়ার কারণে আপাতত তার ঠোঁট ও নাকে প্লাস্টিক সার্জারি করা সম্ভব হচ্ছে না। তিন মাস পর তার অস্ত্রোপচার করা হবে।

নবজাতক বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, সাধারণত স্কাবোতে মুমূর্ষু নবজাতক শিশুদের জরুরি চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা শেষে যখন কোনো নবজাতককে সুস্থ অবস্থায় রিলিজ দেয়া হয় তখন বাবা, মা ও আত্মীয়-স্বজনের আনন্দের সীমা থাকে না। তারাও নবজাতকদের বাবা-মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়ে নির্মল আনন্দ ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করেন।

কিন্তু যখন থেকে তারা এই নবজাতকের রিলিজের কথা স্যারদের মুখে শুনেছেন তখন থেকে তারা ভাবছেন রিলিজের পর শিশুটির ঠাঁই কোথায় হবে?

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, নিয়মানুসারে শিশুটির জিম্মাদার এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক। হাসপাতালে সমাজসেবা অধিদফতর রয়েছে। হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে সমন্বয় করে তারা অসহায় দরিদ্র রোগীদের সহায়তা করে থাকে। ওই প্রক্রিয়ায় হয়তো হাসপাতাল পরিচালক সমাজসেবা অধিদফতরের কাছে নবজাতক শিশুটিকে হস্তান্তর করতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) দুপুর আনুমানিক আড়াইটায় রাজধানীর উত্তর কাফরুলের ডোরিন গার্মেন্টসের দক্ষিণ পাশে পুরাতন বিমানবন্দর এলাকার রানওয়ের পাশ থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ওই নবজাতককে উদ্ধার করা হয়।

ওই সময় সেখানে কয়েকজন শিশু খেলাধুলা করছিল। হঠাৎ করেই তাদের চোখে পড়ে অদূরে ঝোঁপের ভিতর একটি কুকুর মুখ দিয়ে কী যেন কামড়ে ধরার চেষ্টা করছে। কৌতুহলবশত সামনে এগিয়ে যেতেই রক্তমাখা এক নবজাতককে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে তারা। পরবর্তীতে জাহানারা নামে এক নারী শিশুটিকে উদ্ধার করে প্রথমে শিশু হাসপাতাল ও পরে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করেন।

সম্প্রতি এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জাহানারা বেগম জানান, দূর থেকে একনজর শিশুটিকে দেখেছেন। আগের দিনের চেয়ে কিছুটা সুস্থ মনে হয়েছে। তিনি জানান, তার ঘরে দুই ছেলে ও তিন কন্যা সন্তান রয়েছে তবুও তিনি এই নবজাতককে মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করতে চান। তবে জাহানারা বেগম নবজাতক শিশুটিকে লালন পালনের দায়িত্ব পাবেন কি-না তা হাসপাতাল পরিচালকের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।

কুকুরের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত পরিচয়হীন সেই নবজাতক শিশুটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের স্পেশাল বেবি কেয়ার ইউনিটে (স্কাবো) চিকিৎসাধীন আছে শিশুটি।

কুকুরে কামড়ানোর ফলে সে সংক্রমণের শিকার হতে পারে এমন আশঙ্কা ছিল চিকিৎসকদের। মঙ্গলবার তার বয়স সাত দিন পূর্ণ হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শিশুটি আগের তুলনায় বেশ সুস্থ আছে, কোনো ধরনের সংক্রমণ হয়নি। তবে নাক, ঠোঁট ও আঙ্গুলের ক্ষত এখনো শুকায়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নবজাতক শিশু বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লার নেতৃত্বে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা ওই নবজাতককে সুস্থ করে তুলতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সসহ সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সর্বোচ্চ সুচিকিৎসা নিশ্চিত হচ্ছে এই হতভাগা শিশুটির।

অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা জানান, সাধারণত সাত দিন বয়সী শিশুর প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ, ইলেকট্রোলাইড ও ক্যালসিয়ামসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপাদানের জন্য প্রতিদিন তিন বেলায় গড়ে ৩৭৫ এমএল মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রয়োজন হয়।

হতভাগা এই নবজাতকের গর্ভধারিণী মা পাশে না থাকায় চিকিৎসকদের কৌটার দুধের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তিনি জানান, নাকের উপরিভাগ থেকে ঠোঁটের নিচ পর্যন্ত (চিকিৎসকদের মতে মুখমণ্ডলের সবচেয়ে বিপদজনক জায়গা) কুকুরে কামড়ানোর ফলে ঠোঁটে দগদগে ঘাঁয়ের সৃষ্টি হওয়ায় শিশুটি ঠোঁট দিয়ে দুধ চুষে খেতে পারছে না। ফলে তাকে ড্রপার ও ছোট চামচের সাহায্যে ১৭৫ এমএলের বেশি দুধ খাওয়ানো যাচ্ছে না। দুধের পাশাপাশি তাকে স্যালাইনের মাধ্যমে শরীরের ঘাটতি চাহিদা পূরণ করার প্রচেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।

শিশুটি কবে নাগাদ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আরো দিন দশেক তাকে হাসপাতালেই রেখে চিকিৎসা দিতে হবে। কুকুরের কামড়ে ক্ষুদে এই শিশুটির বুড়ো আঙ্গুল ও তার পাশের আঙ্গুল খসে পড়ার অবস্থা হয়েছে। কুকুর কামড়ে ঠোঁটের মাংস ছিঁড়ে ফেলেছে। প্লাস্টিক সার্জনরা কনস্ট্রাকটিভ সার্জারির মাধ্যমে এটি জোড়া লাগাবেন বলে জানান তিনি।

শিশুটিকে কিছুদিন আগে রাজধানীর উত্তর কাফরুলের ডোরিন গার্মেন্টসের দক্ষিণ পাশে পুরাতন বিমানবন্দর এলাকার রানওয়ের পাশের ঝোঁপঝাড় থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় শিশুদের কাছে খবর পেয়ে জাহানারা বেগম নামের এক গৃহবধূ ওই নবজাতককে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।

ওই গৃহবধূ নিয়মিত হাসপাতালে এসে নবজাতক শিশুটির খোঁজখবর রাখছেন। পুলিশ এখনো শিশুটির মা-বাবাকে অনুসন্ধান করে বের করতে পারেনি।

Share