চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে প্রায় ৭০টি কিন্ডারগার্টেন অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ শিক্ষকের জীবন কাটছে অনাহারে, থেমে যাচ্ছে তাদের জীবন যাত্রা ও বেঁচে থাকার স্বপ্ন।
মহামারির কারণে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতোই প্রায় দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে হাজীগঞ্জের ৭০ এর অধিক কিন্ডারগার্টেন। মাসের পর মাস প্রতিষ্ঠানের নানাধিক খরচ চালাতে গিয়ে পড়তে হচ্ছে হিমসীমে। সরকারের নানা প্রণোদনা থাকলে এ খ্যাতে নেই সেই সুযোগ। যে কারণে এসব কিন্ডারগার্ডেন অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, উপজেলার বেশিরভাগ কিন্ডারগার্ডেন প্রতিষ্ঠিত করেন সমাজের শিক্ষানুরাগী কিংবা শিক্ষা পেশায় সম্পৃক্ত সমাজের নিরহংকার ব্যক্তিগন। নিজের বা নিজ পরিবারের কথা ভুলে গিয়ে জীবনের সকল সঞ্চিত অর্থ সম্পদ দিয়ে সমাজের প্রতিটি শিশুকে সুশিক্ষিত সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলতে এবং দেশেকে নিরক্ষর মুক্ত করার লক্ষ্যে তিলে তিলে গড়ে তোলেন এ সকল বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বপ্নদ্রষ্টাদের দাবি শুধুই দেশকে নিরক্ষরতা থেকে মুক্তির স্বপ্নই দেখায়নি, দেশেকে বেকারত্ব মুক্তেও রেখে যাচ্ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় আধুনিকতার ছোঁয়া, সৃজনশীলতাসহ শিক্ষার্থীদের পোশাকে পরিপাটি তাও এসেছে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের মাধ্যমে। দেশের শিক্ষায় মেধা বিকাশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো ভূমিকা অতুলনীয়, যাহার প্রমান পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষার ফলাফল।
কিন্তু আজ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, করোনা সংক্রমণ-জনিত কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ভালো নেই হাজীগঞ্জের এসব শিক্ষা উদ্যেক্তাগণ। সেই সাথে প্রায় ৩ হাজারের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারী কাটাচ্ছেন মানবেতর জীবনযাপন।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় এদের বেশিরভাগের জীবনযাত্রার মান একবারে চলে এসেছে শূণ্যের কোটায়। এক কথায় আজ তাদের অবস্থান গিয়ে দাঁড়িয়েছে হতদরিদ্রের তালিকায়।
বর্তমানে হাজীগঞ্জের প্রায় সকল কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক কর্মচারী জীবন জীবিকার তাগিদে জাতির সর্বোচ্চ সম্মানের পেশা শিক্ষকতা ছেড়ে ঝুঁকছে নিম্নশ্রেণীর কাজে ।
চলতি বছরের (৮ জুলাই) সকাল ১১টায় সারাদেশে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল এন্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে মানববন্ধন করে। মানববন্ধনে কিন্ডারগার্টেনের জন্য আলাদা বোর্ড বা মন্ত্রণালয় গঠনসহ ৬ দফা দাবি করে। শিক্ষকরা করোনা মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারি প্রণোদনা দাবি করেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, যারা শিক্ষা উদ্যেক্তা হিসেবে নিজেদের কে সমাজের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। তারাও আজ প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাড়ার পরিশোধ করতে পারছেন না। বাড়ির মালিকগণের ভাড়ার চাপে দিশেহারা। অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে ও নিজ সম্মান রক্ষায় করেছেন ঠিকানা বদল ।
এই সকল কিন্ডারগার্টেনগুলো টিকে থাকা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা সংশয়। আবার কিছু সংখ্যক কিন্ডারগার্টেনগুলো ভবন ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল দিতে না পারায় নিজেদের বাসা তৈরি কিংবা বাসা ভাড়া দিতে দেখা গেছে।
এবার দেখি শিক্ষক ও অভিভাবকদের অর্থনৈতিক চিত্র, হাজীগঞ্জ বাজারের এর নিকট কিন্ডারগার্টেনের এক শিক্ষিকা বাড়ি ভাড়া দিতে না পেরে বাসা ছেড়ে দিয়েছেন।
তিনি জানালেন, কয়েক মাস হলও স্কুল বন্ধ, শিক্ষার্থীদের বেতন আদায়ও বন্ধ। স্কুলে শিক্ষক আছেন ১৮ জন। তাঁরা বেতনের সঙ্গে টিউশনির আয় জোড়াতালি দিয়ে চলতেন। এখন সবই বন্ধ।
শামসুল হক একাডেমির শিক্ষক মো. শামছুল ইসলাম, বলাখাল ক্যামব্রিয়ান স্কুলের শিক্ষক আবু নাসের ও গ্রামীণ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল আসমাউল হোসনার সাথে কথা হয় বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে।
তারা বলেন, হঠাৎ করে জীবনের উপর এমন ঝড় আসবে জানলে এ পেশায় ঢুকতাম না। কিন্তু অন্য তেমন কোন কাজ জানা বা সুযোগ পাচ্ছি না, যে কারণে পরিবার পরিজন নিয়ে চরম সংকটে আছি। আমরা সরকারের কাছে সাহায্যের আকুতি জানাই।
হাজীগঞ্জ উপজেলা কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়শনের সভাপতি আলহাজ্ব এ কে এম শাহ আলম মুন্সি চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, করোনা কারণে সারা দেশে স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা দেন সরকার। স্কুল-কলেজ বন্ধ প্রায় আজ দুই বছর হতে চলেছে। এই দীর্ঘ সময়ে সরকারের সহযোগিতা হাত ছিল অত্যন্ত প্রসারিত। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য কোন চিন্তা ভাবনা বা পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। আমরা বার বার দাবি করছি স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করা যায়। দেশের বাহিরে বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ উদাসীন।
চাঁদপুর জেলা কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়ানের সাধারণ সম্পাদক সবুজ ভদ্র দিপু চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, দেশে প্রথম মহামারি কোভিড-১৯ শনাক্ত হলে সরকার সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার পাশাপাশি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। সাধারণ ছুটি, লকডাউনে বন্ধ রয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকলেও যথারীতি বেতন-ভাতা পাচ্ছেন সরকারি-বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা। এই মহামারি করোনায় সরকার বিভিন্ন খাতে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা রেখেছেন। এতে নন-এমপিও শিক্ষকরা সরকারের এ সুবিধা পেয়েছেন।
অথচ কিন্ডারগার্টেন স্কুল শিক্ষকদের জন্য সরকারের নেই কোনো বিশেষ সহায়তা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না থাকায় শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ শিক্ষার্থীদের বেতন থেকে শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়। ক্লাস না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন আদায় করতে পারছেন না স্কুল কর্তৃপক্ষ।
ফলে শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। আবার ভাড়াকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান ঋণের দায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো চলে মূলত শিক্ষার্থীদের টাকায়। সেই টাকায় শিক্ষকদের বেতন ওই স্কুলের ভবনের ভাড়াসহ সব খরচ মেটানো হয়ে থাকে। এতো সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় জেলার প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষক কর্মচারী মানবেতর জীবন পার করছে। আমরা সরকারের কাছে প্রণোধনার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আবু সাঈদ চৌধুরী চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, কিন্ডারগার্টেনকে আমার শুধু ছাত্র-ছাত্রদের সরকারি পাঠ্যসূচীর বই বিনামূল্যে দিয়ে থাকি। সরকারিভাবে এ শিক্ষকদের প্রণোদনার পাওয়ার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে কাজ করে যাচ্ছি কিন্তু সরকারি কোন নির্দেশনা এখনো পাইনি। যখনি কোন ঘোষিত সিদ্ধান্ত আসবে আমি তা শতভাগ বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করবো।
প্রতিবেদক: জহিরুল ইসলাম জয়, ৫ জুলাই ২০২১