কাতারে প্রেম-বিয়ে, ফরিদগঞ্জ-জিন্দাবাহারে অশান্তি

ফরিদগঞ্জের আলোনিয়া গ্রামের শামছুল আলম। ঢাকার জিন্দাবাহারের আফরোজা বেগম। কাতার এয়ারপোর্টে তাদের সাক্ষাৎ ও আলাপ হয়। পরিণতিতে প্রেমে জড়িয়ে পড়েন তারা। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় বিয়ে ও অনুমতি নিয়ে এক বাসায় বসবাস করেন। 

এক পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন দু’জন। এরপর অশান্তির আগুন জ্বলছে দু’পরিবারে। শারীরিক নির্যাতনসহ চলছে মামলা-মোকদ্দমার অভিযোগ। 

কাতারের ভিসা দেবেন মর্মে শামছুল আলম টাকা নিয়েছেন। কিন্তু, ভিসা দেননি টাকাও দিচ্ছেন না- এসব দাবী করছেন স্ত্রী আফরোজা বেগম। শামছুল আলম পূর্বে বিবাহিত, সংসার ও তিন সন্তানের জনক। 

গত২৪ মে সোমবার স্বামীর বাড়ি গিয়ে সহোদর বোনসহ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন স্বামী, প্রথম স্ত্রী ও তার সন্তানদের হাতে- এমন দাবীতে ফরিদগঞ্জ থানায় অভিযোগ করেছেন আফরোজা বেগম। তিনি সুবিচার প্রার্থনা করেছেন এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্ট বিচারিকদের কাছে। 

গত ২৪ মে সোমবার দায়েরকৃত অভিযোগের বিবরণে জানা গেছে, টাকাপয়সার লেনদেন থাকায় আফরোজা বেগম এর স্বামী শামছুল আলম শত্রুতা পোষণ ও তার ক্ষতি সাধন করার চেষ্টা করছেন। স্বামীর বসত বাড়ি ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১১নং ইউনিয়নের আলোনীয়া গেলে তার সঙ্গে স্বামী, স্বামীর প্রথম স্ত্রী ও তাদের সন্তানগণ খারাপ আচরণসহ ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হুমকি প্রদান করে। অন্যদিকে স্বামী তার খোঁজখবর ও নেন না এবং ভরণপোষণ দেন না। এর জের ধরে তিনি ২৪ মে স্বামীর বাড়িতে যান। ওই সময়ে স্বামী শামছুল আলম (৬০), স্ত্রী (সতিন) জাহানারা বেগম (৫০), সন্তান নাহিদ হোসেন (২৩), ও জাহিদ হোসেন (২৬) সম্মিলিতভাবে আফরোজা বেগম (৩৫) ও তার সহোদর বোন রীণা বেগম (৩৬)কে মারধর করেন এবং ঘর থেকে টানা হেঁচড়ার মাধ্যমে বের করে দেন। এতে, তারা আহত হন। তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়। ওই সময়ে, তাদের সঙ্গে থাকা আত্মীয় বাবুল মোল্লাসহ এলাকার লোকজন এর সাহায্যে ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন এবং রাতে ফরিদগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। 

অভিযোগপত্র মোতাবেক তার স্বামীর ঠিকানা ফরিদগঞ্জের আলোনীয়া গ্রামের শামছুল আলমের বাড়ি। পৈত্রিক ও হাল ঠিকানা ঢাকার ৯/২ জিন্দাবাহার, ২য় লেন, কোতয়ালী, ঢাকা। 

আফরোজা বেগম দাবী করেন, তিনি কাতার এয়ারলাইন্সে চাকরি নিয়ে ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে কাতার যান। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে এয়ারপোর্টে পরিচয় ও প্রেমের সম্পর্কে শামছুল আলমের সঙ্গে আবদ্ধ হন। ১৩ই জুন ২০১৬ সালে এ্যামবাসীর সহযোগিতায় ও নিয়ম মেনে তিন লাখ টাকা দেনমোহরে বিবাহ সম্পন্ন হয়। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় বৈবাহিক কাগজপত্র রয়েছে বলে আফরোজা বেগম দাবী করেন। বিবাহের পর তারা সেখানে একসঙ্গে বসবাস ও সংসার করেন। বিবাহের কয়েক মাস পর শামছুল আলম অসুস্থ হয়ে পরেন। এতে, তিনি তার চিকিৎসা ও সেবাযত্ন করতে গিয়ে ২৯ দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। অনুপস্থিতির কারণে এয়ারলেইন্স এর চাকরি থেকে তিনি বরখাস্ত হন বলে দাবী করেন। এরফলে, ২০১৭ সালে তিনি দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন। 

আফরোজা বেগম আরো বলেন, স্বামীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিলো। এরফলে, শামছুল আলম কাতারের ভিসা দেবেন বলে আমার মাধ্যমে কয়েকজনের কাছ থেকে প্রায় ১৪ লাখ টাকা নেন। ওই টাকা বিভিন্ন উপায়ে শামছুল আলমের কাছে কাতার পাঠাই। কিন্তু, কাতারে লোক নিতে তিনি ব্যর্থ হন তিনি। এতে আমি বিপদে পরে যাই। পাওনাদারগণ টাকা ফেরত পেতে আমাকে চাপ দেন এবং আমাকে নানাভাবে হয়রানি করছেন। 

এদিকে, আফরোজা বেগমের দাবী মোতাবেক ২০২০ সালের জুলাই মাসের দুই তারিখে শামছুল আলম দেশে ফিরে আসছেন মর্মে খবর দেন। 

ওই সময়ে তিনি এয়ারপোর্টে উপস্থিত হন। সেখানে শামছুল আলম এর মুখোমুখি হন তিনি। একই সময়ে সেখানে উপস্থিত জাহানারা বেগম শামছুল আলমের প্রথম স্ত্রী বলে পরিচয় দেন। সেখান থেকে শামছুল আলম গ্রামের বাড়ি আলোনিয়া যান। তবে, বাড়ি থেকে পরদিন তার কাছে ফিরে যাবেন মর্মে কথা দেন- দাবী আফরোজার। কিন্তু, তিনি আর যাননি। 

আফরোজা বেগম আরও দাবি করেন, শামছুল আলম আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তিনি বিবাহিত ছিলেন এবং তিন সন্তানের জনক এ কথা আমাকে বলেননি। 

অথচ, আমার একমাত্র স্বামী তিনিই। এখন তিনি আমার কোনো খোঁজখবর নেন না এবং কাতার লোক নেবেন মর্মে নেওয়া টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না। আমি বিপদে আছি। আমার বাবা নেই। আমরা তিন বোন। সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। দুই বোন স্বামীর সংসারে থাকেন। কোনো ভাই নেই। ঘরে আমার বৃদ্ধ ও অসুস্থ মা আছে। আমরা দুজন সবার কাছে বোঝা হয়ে গেছি। আমি শামছুল আলমকেই বিবাহ করেছি। তাকে বিশ্বাস করেছি। আজ আমি সবকিছু হারিয়েছি। 

তিনি বলেন, শামছুল আলম বাড়ি গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা না করার কারণে আমি ফরিদগঞ্জ থানায় উপস্থিত হয়ে ২০২০ সালের জুলাই মাসে একটি অভিযোগ দায়ের করি। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে প্রাথমিক তদন্তের জন্য ফরিদগঞ্জ থানার তৎকালীন এ.এস.আই রাজেশ পাল সঙ্গীয় ফোর্সসহ শামছুল আলমের বাড়ি যান। এতে, সেখানকার স্থানীয় লোকজনের সামনে আফরোজা বেগমের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক আছে ও ভিসা দেয়ার কথা বলে প্রায় ১৪ লাখ টাকা আফরোজা বেগমকে দেনা আছেন মর্মে স্বীকার করেন। পরদিন ফরিদগঞ্জ থানায় একটি শালিস বৈঠক বসে। বৈঠকে ১০ লাখ টাকা আফরোজা বেগমকে দেবেন এবং তারা একে অপরকে তালাক দেবেন মর্মে সাব্যস্ত হয়। বাদি বিবাদী শালিসের সিদ্ধান্ত মেনে নেন এবং স্বাক্ষর করেন।

আফরোজা বেগমকে ওই দিন ৫০ হাজার, কয়েকদিন পর আরও ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়। অবশিষ্ট নয়লাখ টাকা তিন কিস্তিতে দেবেন বলে শামছুল আলম সকলের সামনে সময় নেন। কিন্তু, পরবর্তীতে শামছুল আলম টাকা দিতে গড়িমসি করেন। এতে, আফরোজা বেগম বিভিন্ন সময়ে ঢাকার সিএমএম আদালতে দু’টি মামলা ও কোতয়ালী থানায় দু’টি জিডি মামলা দায়ের করেন। 

এদিকে, শালিসি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শামছুল আলম এর ওয়ার্ড মেম্বার মোঃ দেলোয়ার খান। তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তিনি জানান, শামছুল আলম আমাদের সকলের সামনে আফরোজা বেগম এর সঙ্গে তিন লাখ টাকা দেনমোহরে বৈবাহিক সম্পর্ক আছে এবং কাতার লোক নেবেন মর্মে ১৪ লাখ টাকা দেনা আছেন বলে স্বীকার করেন। আমরা শান্তির লক্ষে ১০ লাখ টাকায় সুরাহা করি। আমাদের সিদ্ধান্ত উভয়ে মেনে নেন।

বৈঠকে শামছুল আলমের প্রথম স্ত্রীর ঘরের উপযুক্ত সন্তান ও স্ত্রী জাহানারা বেগমসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। বাড়িতে তিন ছেলে-মেয়েসহ এলাকার অনেক লোক ছিলেন। 

শালিসনামায় স্বাক্ষরকারী অপর চারজন মজিবুর রহমান দুলাল (কোরোয়া), কামাল হোসেন (কাছিয়াড়া), শাকিল হোসেন (সাফুয়া) ও রায়হান মোল্লা (আলোনিয়া) অনুরূপ তথ্য দিয়ে বলেন, শালিসি বৈঠকে উভয়ে স্ব-ইচ্ছায় ও শান্তিপূর্ণভাবে সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন এবং পক্ষগণসহ আমরা স্বাক্ষর করি। 

এ ব্যপারে শামছুল আলমের সঙ্গে কথা বলতে তার প্রথম স্ত্রী জাহানারা বেগম এর মুঠোফোনে কল দিলে তিনি বলেন, “শামছুল আলম বাড়ি নেই”। 

এ বিষয়ে জাহানারা বেগম এর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আফরোজা বেগম ভুয়া কতোগুলো কাগজপত্র নিয়া আসছে। আইসা উনাকে থ্রেট দিছে। উনি ভয়ে ভিতিয়ে কি বলছে না বলছে উনি নিজেই বলতে পাইরতো না”। ওই সময়ে আপনি কোখায় ছিলেন- এমন প্রশ্নে বলেন, “আমিও ঘরে ছিলাম। পাঁচ বছর উনার সঙ্গে সম্পর্ক কইরা উনার কিছু অস্তিত্ব রাখে নাই”। 

এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শামছুল আলম আফরোজা বেগমকে কাতারে বিয়ে করে এক বাসায় থাকার তথ্য জাহানারা বেগম ও আত্মীয় স্বজন আগে থেকেই জেনেছেন।

এ নিয়ে পরিবার সদস্য, আত্মীয় স্বজন তার ওপর নাখোশ ছিলেন। কাতারে কাছাকাছি এলাকায় বিভিন্ন সময়ে শামছুল আলমের প্রথম স্ত্রীর সাত ভাই ছিলেন, এখনও আছেন। তারাই বিয়ে ও এক বাসায় থাকার বিষয়ে জানতে পারেন এবং শামছুল আলমকে সাবধান করেন। কিন্তু, শামছুল আলম তাদের নিশেধ অমান্য করেছেন বলে জানা গেছে। 

এ বিষয়ে জানার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান বাছির উদ্দিন এর মুঠোফোনে কল দিলে তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নের শামছুল আলমকে আমি চিনি। তিনি কাতারে বিয়ে করেছেন এবং মামলা-মোকদ্দমা চলছে বলে লোক মারফত শুনেছি। তবে, কোনো পক্ষই আমার সাহায্য চাননি। 

এ ব্যপারে ফরিদগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ শহীদ হোসেন বলেন, গত ২৪ মে রাতে আফরোজা বেগম নামীয় একজন নারীর একটি অভিযোগ পেয়েছি। এ বিষয়ে ফরিদগঞ্জ থানায় একটি জিডি হয়েছে। জিডিমূলে পরবর্তীতে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

প্রতিবেদকঃশিমুল হাছান,১ জুন ২০২১

Share