কালো পানিতে সাদা ফেনা তুলে লঞ্চ আসা-যাওয়া করছে। যাত্রীদের ব্যস্ততা, কুলিদের চিৎকার-চেঁচামেচি, মাঝি-মাল্লাদের হাঁকাহাঁকির মাঝেই সূর্যের অস্তরাগ কালো পানির মলিনতা আর দুর্গন্ধ আড়াল করে দিল মন থেকে। বরিশাল থেকে আসা লঞ্চ থেকে নামলেন আব্দুল খালেক, গন্তব্য ওয়াইস ঘাট।
আজ রাতটা সদরঘাটেই কাটাবেন, পরদিন সকালে উঠে যেতে হবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আব্দুল খালেক জানালেন, ঢাকায় তার কোনো আত্মীয় না থাকায় ওয়াইস ঘাটের ফরিদপুর মুসলিম হোটেলের কেবিনেই রাত কাটাতে হয় তাকে। এই হোটেলে থাকার নেপথ্যে কারণও আছে, এরচেয়ে কম খরচে মাথা গোঁজার সুযোগ ঢাকার আর কোথাও নেই।
শুধু ঢাকা কেন, এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা হোটেল। যে হোটেলে এক রাত থাকার জন্য খরচ হয় মাত্র ৩৫ টাকা! ঢাকার সদরঘাটে অবস্থিত এই হোটেলটি মূলত ভাসমান নৌকা। মাত্র ৩৫ টাকা ভাড়া হলেও তার বিনিময়ে এ হোটেলে যেসব সুবিধা মেলে, তা আশাতীত বলা চলে। ঘরগুলো খুব ছোট হতে পারে, একটি কম্যুনাল ব্যাংকের চেয়ে আকারে খুব বেশি বড় হবে না, তবে সার্বক্ষণিক পানি, বিদ্যুৎ এবং টয়লেটের ব্যবস্থা ঠিকই আছে। চাইলে গোসলও সেরে নিতে পারেন হোটেলেই। তবে খাবার আলাদা করে কিনে খেতে হয়।
ফরিদপুর মুসলিম হোটেলের যাত্রা শুরু ১৯৬৮ সাল থেকে। এটিই দেশের প্রথম ভাসমান হোটেল। তখন হিন্দু হোটেল নামেই এটির পরিচিত ছিল। সেসময় মাত্র ৪ টাকাতেই এখানে মিলত থাকা-খাওয়া। এই হোটেলের শুরু থেকে খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ২০০২ সাল থেকে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে এই হোটেলে মানুষের রাত্রিযাপন বন্ধ হয়নি একটি দিনের জন্যও। গোলাম মোস্তফা মিয়া নামের এক ব্যক্তি বর্তমানে ভাসমান হোটেলটি চালাচ্ছেন। তিনি প্রায় ৩২ বছর ধরে এটা করছেন। গোলাম মোস্তফা এক সময় এই হোটেলের একজন কর্মচারী ছিলেন, এখন নিজেই মালিক।
বরিশাল থেকে আসা আব্দুল খালেক মুসলিম হোটেলে ঢুকতেই গোলাম মোস্তফার মুখোমুখি। ততোক্ষণে গোলাম মোস্তফা পান চিবুতে চিবুতে বললেন, রুম লাগবে? আব্দুল খালেক সায় দিয়ে তার পছন্দে রুম নিয়েছেন। মোস্তফার একই প্রশ্ন আমাদের করলেন! আমরা ফিরতি প্রশ্ন করলাম, কত করে ভাড়া? তিনি বললেন, ৩৫ টাকার বেড আছে, শেয়ার করে থাকতে হবে। এছাড়া ৮০ ও ১০০ টাকার কেবিনও আছে। আমি আর আলোকচিত্রী রহমান লিমু একটা ডাবল কেবিন ভাড়া নিলাম। ভাড়া দিয়েই তার সাথে গল্প জমাতে শুরু করলাম। জানতে চাইলাম এই হোটেল সম্পর্কে।
গোলাম মোস্তফা জানালেন, এই ভাসমান হোটেলে মোট ৪৮টি বিছানা রয়েছে। সেখানে দিনভিত্তিক ছাড়াও মাসভিত্তিক সিট ভাড়া দেওয়া হয়। মূলত ব্যবসায়িক কাজে ঢাকায় আসা ব্যক্তিরা এখানে রাত কাটায়। অনেকে মাসের পর মাস এখানে থাকে। কারণ যে টাকা দিয়ে একবেলা পেট ভরে খাওয়া যায় না, সেই টাকায় এখানে রাতযাপন করা যায়! এর চেয়ে সস্তা হোটেল পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এটি ভাসমান হোটেল হলেও সাধারণত ভেসে বেড়ায় না। রাত ১২টা পর্যন্ত এ হোটেলগুলোতে প্রবেশ করা যায় ও পরের দিন সকাল ১১টার মধ্যে ছেড়ে দিতে হয়। ৩৫ টাকায় লোকাল রুম, ৭০ টাকায় সিঙ্গেল কেবিন ও ১০০ টাকায় ডাবল কেবিনের ব্যবস্থা রয়েছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে কোনো দরিদ্র শ্রমিককেই টাকার অভাবে বেশিরভাগ সময় ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। বোর্ডিংয়ের এক কোণে তাদের মাথা গোঁজার একটু ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
ফরিদপুর মুসলিম হোটেল ছাড়াও এই জায়গায় আরো ৫টি ভাসমান হোটেল রয়েছে। বুড়িগঙ্গা বোর্ডিং, শরীয়তপুর বোর্ডিং, উজালা বোর্ডিংয় এবং বাকি দুটোর কোনো নাম নেই! এই হোটেলগুলো মূলত ১৯৭৬ সালের, পরে নির্মিত হয় আরো তিনটি হোটেল। প্রতিটিতে রয়েছে ৩০ থেকে ৫০টির মতো কেবিন। প্রতিটি কেবিনে রয়েছে বিদ্যুতের ব্যবস্থা। আছে লাইট ও ফ্যান। রয়েছে রাতযাপনের মতো আনুষঙ্গিক বেডিংপত্র। যদিও এগুলো এখন তেমন মানসম্মত নয়। তবুও এ ব্যবস্থাটুকুই এখানে রাতযাপনকারী শ্রমিকদের কাছে অনেক বড় পাওয়া।
৩১ বছর ধরে হোটেলে থাকেন রহমান!
রাত ১১টা, হোটেলে ফিরলেন ৭৮ বছর বয়সী আবদুর রহমান। তিনি প্রায় ৩১ বছর ধরে ফরিদপুর মুসলিম হোটেলে থাকেন। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার পালং থানার বিনোদপুর গ্রামে। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে তিনি কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসেন। কিন্তু কোনো কাজ না পেয়ে সদরঘাট টার্মিনালে পান, বিড়ি, সিগারেট বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এরপর থেকেই এই হোটেলের নিয়মিত বাসিন্দা হয়ে যান তিনি। আবদুর রহমান বলেন, ‘সত্তরের দশকে ওয়াইজ ঘাটের এসব ভাসমান হোটেলে খাবারের বিল পরিশোধ করলেই রাতযাপন করা যেত। কোনো ভাড়া নেওয়া হতো না। মাছ, ভাত বা মাংস যা খাওয়া হোক, খরচ ছিল কম। আর এখন থাকার জন্য দিই ৪০ টাকা। তারপরও এ হোটেলের মায়া ছাড়তে পারি না।’ আব্দুর রহমান এখন খাবারের দোকান দিয়েছে হোটেলটির ঠিক সামনেই। তার হোটেলে ১৫ টাকায় ডাল, ভাত, ভর্তা পাওয়া যায়। ভাসমান হোটেলের বাসিন্দারাই তার দোকানের ক্রেতা।
আব্দুর রহমানের সাথে কথা শেষ না হতেই এগিয়ে এলেন আরেকজন। নাম ফুল মিয়া, বরিশালের বাসিন্দা। তিনি নিজেই জানালেন গত এক মাস ধরে এই হোটেলে থাকছেন। সদরঘাটের কুলির কাজ করেন তিনি। কম টাকায় নিরাপদে থাকতে পেরে তিনি খুশিও। ফুল মিয়া বলেন, ‘আমরা আয় করি অল্প, তাই কম দামে থাকতে হয়। নয়তো রাস্তায় থাকতে হতো।’ কলিমুল্লাহ মিয়া মুসলিম হোটেলে অনেকবছর ধরেই থাকেন। তিনি বলেন, ‘আগে ব্যবসায়িক কাজে প্রায়ই ঢাকায় আসতে হতো। নৌকায় মালামাল নিয়ে সদরঘাট আসতাম। সেসময়ও আমি বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর ভাসমান হোটেলে থাকতাম। সেসব হোটেল হিন্দুরা চালাত বলে তার নাম ছিল হিন্দু। সর্বশেষ ৫ টাকা ভাড়ায় সেখানে থেকেছি।
মধ্যরাতের গল্প
রাত ১টায় মুসলিম হোটেলের ম্যানেজার গোলাম মোস্তফার রুমে গিয়ে দেখলাম তিনি এখনো ওই সিটে বসে আছেন! রাত ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত তিনি এই রুমে থাকেন। তারপর হোটেলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা তার রুমের সামনে দাঁড়াতেই তিনি আমাদের বললেন, আপনারা তো মনে হয় শখ করে থাকবেন! আমরা বললাম, বুঝলেন কিভাবে। উনি জানালেন, তার এই হোটেলে অনেক পর্যটকও শখ করে থাকেন!
গোলাম মোস্তফার কথায় আরো জানতে পারলাম, ঈদ, পূজায়ও হোটেল বন্ধ হয় না। তিনি গত ৩২ বছরে মাত্র ৫টি ঈদ উদযাপন করেছেন গ্রামের বাড়িতে। ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে থাকে পরিবার। মা-বাবা, এক ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। মোস্তফা বলেন, ‘বছরে দু-একবার যাওয়া হয়। গিয়ে কি করবো, আমার পরিবার তো চলে এই হোটেলের টাকায়। আর আমি বাড়ি গেলে তখন পুরো হোটেল সামলাতে হয় হাবিবুর রহমানকে।’
হাবিবুর রহমান এই হোটেলের একমাত্র কর্মচারী। মাসিক ৮০০০ টাকা বেতনে কাজ করেন এখানে। এক সময় সে সদরঘাটে ফল বিক্রি করতো। তখন সে এই হোটেলের বাসিন্দা ছিল। ব্যবসায় ক্ষতি হওয়ার কারণে এখানে চাকরি নিয়েছেন তিনি। হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ভালোই কাটে এখানে। থাকা-খাওয়া ছাড়া যে টাকা পাই তাতেই সংসার চলে। আর এখানে যারা থাকেন তাদের খুব আপন মনে হয়। শীতের মৌসুম, ঈদ ও পূজায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নদীপথে অনেক ব্যবসায়ী ঢাকায় আসেন। তখন সব রুম ভাড়া হয়। তবে এ হোটেলে ফেরিওয়ালা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হকার, ফল ব্যবসায়ীরাই বেশি থাকেন। হোটেল টিকে থাকলেও আগের মতো নেই। কমে গেছে হোটেলে অতিথির সংখ্যা। এখন মানুষ হোটেল দেখার আগে সাজসজ্জা দেখেন। ভাসমান হোটেলে তো আর এসব নেই।’ (ইত্তেফাক)
বার্তা কক্ষ