চাঁদপুর টাইমস ডেস্ক:
যদি শেষ দিন পর্যন্ত ম্যাচটি গড়ায়, তাহলে বিশ্ব ক্রিকেট আর মাত্র ৫ দিন দেখার সুযোগ পাচ্ছে এক কিংবদন্তির মাঠ পরিক্রমা। কখনও দীপ্ত ব্যাটসম্যান হিসেবে, কখনও দুরন্ত উইকেটরক্ষক, কিংবা বিচক্ষণ দলপতি হিসেবে যে মানুষটা এতদিন শ্রীলঙ্কাকে প্রতিনিধিত্ব করে আসছিলেন ক্রিকেট আকাশে গোধূলির রাঙা রঙে রাঙানো কুমার সাঙ্গাকারার বিদায় সূর্য। হ্যাঁ, শেষের শুরুটা হয়েই গেছে তার। এগিয়ে আসছে এক ক্রিকেট যোদ্ধার বিদায় ক্ষণ।
ভারতের বিপক্ষে শুরু হওয়া কলম্বো টেস্ট শেষেই অস্তমিত হবে এক গণগণে সূর্যের।স্থানীয় ক্রিকেটমহলে ওই পি সারা-টারা কেউ বলে না। ওভাল নামেই পরিচিত। মাঠের সৌন্দর্য বিচারে লন্ডনের ওভালের মতো। বর্ণহীন, শ্রমিকশ্রেণি। লন্ডনে যেমন অনেক অভিজাত, আরও ঝলমলে হল লর্ডস। কলম্বোয় তেমনই এসএসসি। মাহেলা জয়বর্ধনের ফেয়ারওয়েল টেস্ট গত বছর প্রথমে ওভালে পড়েছিল। তিনি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে ওটা সরিয়ে নিয়ে যান এসএসসিতে। যা কলম্বোর লর্ডস।
অনেক সবুজ। অনেক ঝকঝকে। অনেক আধুনিক। আর কলম্বোর ওভালে কেমন একটা পুরনো-পুরনো গন্ধ। বনেদি অথচ জরাজীর্ণ। যেন ইতিহাসের শুকনো পাতা এখানেই ওড়ে। এসএসসিতে নয়। সে জন্যই কি সাঙ্গাকারা এ মাঠে শেষ ম্যাচ পড়ায় আপত্তি করেননি?
যেখানে মুরালীধরন তার প্রথম টেস্ট খেলেছিলেন। যেখানে শ্রীলঙ্কা তাদের প্রথম সরকারি টেস্ট খেলে।তাকে দেখতে যতই আধুনিক আর ডাকাবুকো মনে হোক, ক্রিকেটীয় স্পিরিটে তিনি যত না দক্ষিণ, তার চেয়ে বেশি উত্তর সিটি করপোরেশন! সাঙ্গার ক্রিকেট-ক্ষত্রীয় অলঙ্কারের প্রধান বেশ যে ঐতিহ্য, তার প্রমাণ বহু বার দিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে কিছু বিলবোর্ড বসবে।
ম্যাচের দিন হোমরা-চোমরা কেউ সেটার উদ্বোধন করবেন। কিন্তু সেটা আর এমন কী? তার বাইরে উৎসব কোথায়? উৎসবের বেদনাই তো কেবল পড়ে রয়েছে।অবসরের ম্যাচ ঘিরে সাঙ্গাকারার আপাত অনাগ্রহ। শচিন ঠিক যতটা সাগ্রহে তাকে ঘিরে বিদায়বেলার সমাদরটা আঁকড়েছেন। কেউ বাড়াবাড়ি করলেও ভেবেছেন থাক, এটাই তো শেষ।
সাঙ্গা যেন ততটাই নিরাসক্তির সঙ্গে গোটা ব্যাপারটা দেখছেন। গত জুনেই সাঙ্গাকারা জানিয়ে দিয়েছেন, এই ম্যাচ দিয়েই বিদায় জানাবেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে। ম্যাচটি হওয়ার কথা ছিল সাঙ্গাকারার শহর ক্যান্ডিতে।
কিন্তু শ্রীলঙ্কার সাধারণ নির্বাচনের কারণে পরে ভেন্যু বদলে ম্যাচ আনা হয় কলম্বোর পি সারা ওভালে। বিদায়ী ম্যাচের আগে দুই দলই সাঙ্গাকারাকে ভাসাচ্ছে শ্রদ্ধা, স্ত‚তি, ভালোবাসায়।প্রথম টেস্টে নাটকীয় হার। এই ম্যাচে জিতে সিরিজে ফেরার চেষ্টায় থাকবে ভারত, সেটাই স্বাভাবিক। তবে এমন একটি ম্যাচের উত্তাপ যেন ছাপিয়ে গেল সাঙ্গাকারার বিদায়ে।
সংবাদ সম্মেলনগুলো যেন এখন একই কেন্দ্রে মিলিত। হোক সেটা শ্রীলঙ্কার কিংবা ভারতের- সবার দিকেই ছুটে যাচ্ছে সাঙ্গাকারা সম্পর্কিত প্রশ্ন। সতীর্থরা তো বটেই, শেষ টেস্টের আগে এই কিংবদন্তিকে টুপি খোলা অভিনন্দন জানাচ্ছে প্রতিপক্ষও। তেমনই এক ক্ষণে লঙ্কান দলপতি অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের কথায় উঠে এসেছে সাঙ্গাকারার সব দিক, ‘আমাদের সবার কাছে সাঙ্গা মানে সবকিছুই। একজন ক্রিকেটার হিসেবে, একজন নেতা, ব্যক্তি হিসেবে আমাদের সবার কাছে তিনি অবিশ্বাস্য।
তরুণ ক্রিকেটারদের গড়ে ওঠায় সাহায্য করেন, মাঠের ভেতরে-বাইরে সবাইকে সাহায্য করেন। সাঙ্গা সত্যিকারের ভদ্রলোক।’ প্রথম টেস্টে হারের দ্বারপ্রান্ত থেকে ঘুরে দাঁড়ানো দারুণ এক জয়ে সিরিজে এগিয়ে আছে শ্রীলঙ্কা। প্রিয় নায়কের বিদায় ম্যাথিউস রাঙাতে চান সিরিজ জয় দিয়ে, ‘মাহেলা জয়াবর্ধনের সঙ্গে মিলে অনেক অনেক বছর ধরে সাঙ্গা আমাদের দলে মেরুদন্ড। তার সঙ্গে খেলতে পেরে এবং ড্রেসিং রুম ভাগাভাগি করতে পেরে আমার গর্বের শেষ নেই।
তার জন্য আমরা সবচেয়ে ভালো যেটা পারি, সেটা হলো সিরিজ জয় উপহার দেয়া।’ সাঙ্গাকারার বিদায়ের আবেগ ছুঁয়ে গেছে প্রতিপক্ষকেও। তার বিদায়ী সিরিজ ভারতের সঙ্গে, এতেই আপ্লুত ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলি, ‘আমি দারুণ খুশি যে ক্যারিয়ারের শেষ কিছু ম্যাচ তিনি আমাদের বিপক্ষে খেলছেন, কারণ এটির অংশ হতে পারাও আমাদের জন্য স্পেশাল উপলক্ষ্য।’ কোহলিও তুলে ধরেছেন ক্রিকেটার হিসেবে সাঙ্গাকারার বিশালত্বও, ‘আমি অনুভব করতে পারছি কি রকমের আবেগ তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
সম্ভবত গত ২০ বছর ধরে দিনের পর দিন ক্রিকেট খেলা ছাড়া আর কিছু করেননি। শ্রীলঙ্কার জন্য অসাধারণ এক ক্রিকেটার ছিলেন তিনি। বিশ্বজুড়ে অনেক অনেক বাঁহাতি ব্যাটসম্যান তার খেলার ধরন অনুসরণ করে। তার টেকনিক এবং ক্রিকেট বিশ্বের সব জায়গায় যেভাবে রান করেছেন, সেটাই তাকে তুলে ধরছে।’ধারাভাষ্যকার ও ভারতের টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রীর মনে পড়ছে
২০০০ সালে সাঙ্গাকারার অভিষেক ম্যাচের কথা, ‘ওই ম্যাচে আমি ধারাভাষ্য দিয়েছিলাম, সে এখনও খেলে যাচ্ছে। হয়ত বছরখানেক বা মাস ছয়েক একটা সময় ছিল, যখন তার ফর্ম পড়তির দিকে ছিল। ওটুকু ছাড়া তার ধারাবাহিকতা অনন্য।’সাবেক এই অলরাউন্ডারের চোখে সাঙ্গাকারা থাকবেন টেন্ডুলকার-ব্র্যাডম্যানদের কাতারে, ‘খুব অল্প কজন ক্রিকেটারই এই তালিকায় থাকবেন। শচীন টেন্ডুলকারকে এখানে রাখা যায়, সেরা দুই-তিনে ওঠার পর আর নামেননি।
সাঙ্গাকারার রেকর্ডও এটাই প্রমাণ করে। সে স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের পাশাপাশিই থাকবে।’