বিশ্বের প্রথম করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কার্যকরী টিকার অনুমোদন দিয়ে একইসঙ্গে চমক ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। উপাত্তের ঘাটতি, স্বচ্ছতার অভাব ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না থাকায় তার এই সিদ্ধান্ত কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে।
সরকারি নথিপত্র অনুসারে, টিকাটি মাত্র ৩৮ জনের ওপর প্রয়োগ করেই কার্যকরী হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এর আগে জানা যায়, মাত্র দুই মাস পরীক্ষা শেষে এর অনুমোদন দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে টিকাটির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে এমন অগ্রাহ্যতা তীব্রভাবে নিন্দিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, তারা টিকাটির বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পায়নি। তথ্যের ঘাটতির ফলে পশ্চিমা বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলো টিকাটি প্রত্যাখ্যান করেছে। পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ ব্যতীত সরকাররা নিজের নাগরিকদের এ টিকা ব্যবহারের অনুমতি দেবে না বলে জানিয়েছে।
দ্রুত টিকা তৈরি করতে গিয়ে অনেক ফাঁকফোকর রেখেছে রাশিয়া। বিজ্ঞানীরা এর কঠোর সমালোচনা করেছেন। এর আগে রাশিয়া ইবোলার টিকা তৈরির সময়ও কিছুটা একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। করোনা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। কার্যকরী কোনো টিকার জন্য মুখিয়ে রয়েছে বিশ্ব। সম্ভাব্য টিকাগুলোর প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আগে থেকেই হাজার হাজার কোটি ডলারের চুক্তি করছে সরকাররা। এর মধ্যে রাশিয়ার এ টিকা নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ এও দাবি করেছেন, এই সিদ্ধান্ত দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ফের শীতল যুদ্ধের আবহ সৃষ্টি করেছেন পুতিন।
টিকার ঘোষণা
মঙ্গলবার করোনা টিকাটি ব্যবহারের অনুমোদন দেন পুতিন। তিনি জানান, টিকাটি তৈরি করেছে মস্কোর গামালেয়া ইনস্টিটিউট। টিকাটি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দেবে বলে দাবি করেন তিনি। জানান, টিকাটি বেশ কার্যকর ও এটি সব প্রয়োজনীয় যাচাই প্রক্রিয়া পাস করেছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি।
পুতিন জানান, টিকাটি তার এক মেয়ের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। তবে কোন্ মেয়ের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে তা তিনি উল্লেখ করেননি। তবে তিনি বলেন, প্রথম ডোজ নেয়ার পর তার ওই মেয়ের শরীরের তাপমাত্রা ছিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও পরেরদিন তা ৩৭.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার পর তার তাপমাত্রা সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ফের স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসে। প্রসঙ্গত, পুতিন সাধারণত তার মেয়েদের নিয়ে জনসম্মুখে কথা বলেন না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, তার দুটি কন্যা রয়েছে। তাদের নাম যথাক্রমে মারিয়া ভরন্তসোভা ও কাটেরিনা তিখোনোভা। তাদের সম্পর্কে খুব একটা তথ্য প্রকাশ পায়নি আজ অবধি।
এদিকে, রুশ বিজ্ঞানীরা জানান, টিকাটির প্রাথমিক পর্যায়ের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষায় তা সফল প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়। রাশিয়ার ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের প্রধান নির্বাহী কিরিল দমিত্রিয়েভ জানিয়েছেন, আগামী মাস থেকেই হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবীর ওপর টিকাটি প্রয়োগের প্রত্যাশা করছেন তারা।
মাত্র ৩৮ জনের ওপর পরীক্ষা, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
পুতিন টিকাটির পক্ষে সাফাই গাইলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোয় উঠে এসেছে ভিন্ন তথ্য। বুধবার রুশ বার্তা সংস্থা ফ্রন্টাঙ্কার বরাত দিয়ে দ্য ডেইলি মেইল জানিয়েছে, রাশিয়ার টিকাটি মাত্র ৩৮ জন মানুষের ওপর প্রয়োগ করে পরীক্ষা শেষ করা হয়। সরকারি নথিপত্র অনুসারে, টিকাটি গ্রহণের পর বেশকিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও দেখা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যথা, ফুলে যাওয়া, হাইপারথার্মিয়া, শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, দুর্বলতা, ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, ক্ষুধামন্দা, গলা শুকিয়ে যাওয়া, নাক বন্ধ থাকা ইত্যাদি।
সরকারি নথিপত্রে, টিকাটি ১৮ বছরের কম ও ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষদের ওপর প্রয়োগ করতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া, প্রসূতি নারীদের ওপরও এটি প্রয়োগ না করতে বলা হয়েছে। অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে এই টিকাটির প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তাও এখনো অজানা।
৪২ দিনের গবেষণা শেষে নিবন্ধন, কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ
ফ্রন্টাঙ্কা অনুসারে, রুশ টিকাটি মাত্র ৪২ দিনের গবেষণার পরপরই নিবন্ধন করা হয়েছিল। এর কার্যকারিতা এখনো ‘অজানা’। টিকাটি নিবন্ধনের জন্য জমা দেয়া একটি সরকারি নথিপত্র অনুসারে, টিকাটির সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়া বিষয়ক কার্যকারিতা নির্ধারণে কোনো গবেষণা করা হয়নি। যদিও পুতিন দাবি করেছেন, টিকাটি সকল প্রয়োজনীয় পরীক্ষায় পাস করেছে। টিকাটির অ্যান্টিবডি তৈরির সক্ষমতা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
বিজ্ঞানী, বিশ্বনেতাদের সমালোচনা
রাশিয়ার টিকার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রচেষ্টার ঘাটতির তীব্র সমালোচনা করেছেন বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা। টিকাটি প্রস্তুতকারী গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে উদ্ধৃত করে দ্য ডেইলি মেইল জানিয়েছে, এত স্বল্প পরীক্ষার মাধ্যমে টিকাটির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। যে ৩৮ জন অংশগ্রহণকারী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে তারা আলাদাভাবে মোট ১৪৪টি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় ভুগেছেন। বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই তা গুরুতর কোনো সমস্যা তৈরি করেনি। তবে এর মধ্যে পরীক্ষার শেষ দিনেও ৩১টি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া চলমান ছিল। ২৭টি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার পরিণতি কী হতে পারে তা টিকা তৈরিকারকরাও নিশ্চিত করতে পারেননি।
এদিকে, বৃটেনের ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের সায়েন্স পলিসি রিসার্চ ইউনিটের লেকচারার ড. ওহিদ ইয়াকুব বলেছেন, এ টিকাটি পানির চেয়ে খুব ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, এটা হচ্ছে জাতীয়তাবাদের টিকা। অনেকে বলেছেন, টিকাটির অনুমোদন দেয়া বেপরোয়া ও বোকামি। সিএনএনের ড. সঞ্জয় গুপ্ত বলেছেন, তিনি রাশিয়ার এই টিকা নেবেন না। তার ভাষায়, আমি এই টিকা সম্পর্কে কিছু জানি না। একই কথা বলেছেন ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) সাবেক কমিশনার ড. স্কট গোতলিয়েব। ড. গুপ্ত আরো বলেন, তিনি বলেছেন, এই টিকার বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তাই তিনি এই টিকা নিয়ে স্বস্তি বোধ করবেন না। রাশিয়া যখন ইবোলা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার করছিল তখনকার কথা এতে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। কারণ, তিনি ওই সময়ের তিন দফা পরীক্ষার কোনো উপাত্তই জানাতে পারেননি।
বৃটেনের ওয়ারউইক বিজনেস স্কুলের ওষুধ গবেষণা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আয়ফার আলি বলেন, রাশিয়া আদতে বিশাল জনসংখ্যা ধ্বংসকারী পরীক্ষা চালাচ্ছে। তিনি বলেন, এত দ্রুত অনুমোদন পাওয়ার মানে হচ্ছে, টিকাটির সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাবগুলো ধরা পড়েনি। এমন প্রভাব বিরল হলেও তা অত্যন্ত গুরুতর হতে পারে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের জেনেটিকস ইনস্টিটিউটের ফ্রাসোয়া বালৌক্স বলেন, এটা একটা বেপরোয়া ও বোকামি সিদ্ধান্ত। তিনি আরো বলেন, অপর্যাপ্ত পরীক্ষার আগে গণহারে কোনো টিকা প্রয়োগ অনৈতিক।
মার্কিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অ্যালেক্স আজার ‘গুড মর্নিং আমেরিকা’ অনুষ্ঠানে মঙ্গলবার বলেছেন, টিকা তৈরিতে প্রথম হওয়াটা বড় বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মার্কিন জনগণ ও বিশ্ববাসীর জন্য নিরাপদ ও কার্যকর একটি টিকা। তিনি বলেছেন, একটি টিকা তৈরিতে স্বচ্ছ উপাত্ত প্রয়োজন। তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা থেকে আসা উপাত্তের প্রয়োজন, যা বলবে যে একটি টিকা নিরাপদ ও কার্যকর। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, তারা এই টিকা গ্রহণ করবেন না।
রাশিয়ার টিকার মান সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছে জার্মানি। তারা বলেছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ওই টিকাকে অনুমোদন দেবে, যা পূর্ণাঙ্গ ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র জার্মান নিউজ পেপার বিষয়ক নেটওয়ার্ক আরএনডি’কে বলেছেন, রোগীদের নিরাপত্তা আমাদের কাছে সর্বাধিক অগ্রাধিকারে রয়েছে। রাশিয়ার টিকার মান, কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
পুরনো গৌরবের স্মৃতি স্মরণের চেষ্টায় রুশ সরকার
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম মহাকাশে স্পুটনিক স্যাটেলাইটের সফল উড্ডয়ন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, সে ধারা অনুসরণ করেছে এবার করোনার টিকার অনুমোদন দিতে তাড়াহুড়ো করেছে রাশিয়া। সপুটনিক স্যাটেলাইটের সেই স্মৃতিকে মনে করিয়ে দিতে তারা এই টিকার নাম দিয়েছে ‘স্পুটনিক-ভি’। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে নতুন করে এক শীতল যুদ্ধে লিপ্ত রাশিয়া। তারা এই টিকার কোনো পরীক্ষা, উপাত্ত প্রকাশ না করে আকস্মিকভাবে এটা অনুমোদন দিয়েছে। বিজ্ঞানীদের সমালোচনার বিপরীতে রাশিয়া দাবি করেছে, এরই মধ্যে কমপক্ষে ১০০ কোটি ডোজের জন্য ২০টি দেশ থেকে অর্ডার পেয়েছে তারা। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতের্তে কয়েক লাখ ডোজ কেনার চুক্তি করেছেন। রাশিয়ান কর্মকর্তাদের মতে, আগেই এই টিকা কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত, ব্রাজিল ও সৌদি আরব।
ক্রেমলিন এবং তাদের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া থেকে রাশিয়ার সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের সারা বিশ্বের পাইওনিয়ার বা অগ্রদূত বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। পাশাপাশি এই টিকাকে জাতীয় প্রেস্টিজ ইস্যু হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এর আগে গত মাসে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। তারা বলে, পশ্চিমাদের করোনাভাইরাস তৈরির গবেষণা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি করার চেষ্টা করেছে রাশিয়া। এভাবে গবেষণা চুরি করে তারা টিকা তৈরির লড়াইয়ে বিজয়ী হতে চায়।
বার্তা কক্ষ, ১৩ আগস্ট ২০২০