ভৈরবে এক পরিবারের দুই মেয়ে ও তাদের বাবা করোনা জয় করেছেন। গত ১০ দিন আগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয় তারা। পরিবারের অভিভাবক কাজী আবুল হোসেন ব্যবসায়ী। তার দুই মেয়ে হালিমা তুর্য স্নিগ্ধা ও নওশিন শার্মিলী নিরা। দু’জনই কলেজে পড়েন। পাশাপাশি স্নিগ্ধা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত। ভৈরবের বেশিরভাগ মানুষের কাছে পরিচিত তিনি।
গত ১৭ এপ্রিল হঠাৎ করে করোনায় আক্রান্ত হন স্নিগ্ধা। এতে মাথায় বাজ পড়ে তার পরিবারের। কিভাবে, কেমন করে আক্রান্ত হলো করোনায়? প্রশাসন তদন্ত শুরু করল। স্নিগ্ধা গত এক সপ্তাহের মধ্যে কোথায় কার কাছে গেছে? বেরিয়ে এলো কাহিনি। তারই বন্ধু সাংস্কৃতিককর্মী আর্থ কিশোর নামের এক যুবকের ফার্মেসিতে গিয়েছিল ওষুধ ও মাস্ক কিনতে।
আর্থ কিশোর তার দু’দিন আগে ১৫ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
স্নিগ্ধার আক্রান্তে খবরে পরিবারের সদস্যরা ভেঙে পড়েন। কিন্ত মনোবল ভাঙেনি স্নিগ্ধার। আক্রান্ত হওয়ার পর রাতেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুবনা ফারজানা তাকে কিশোরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেয়। পরদিন ডাক্তার তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নমুনা পরীক্ষা করে ঢাকায় পাঠায়।
১৯ এপ্রিল তার বাবা আবুল হোসেন ও ছোটবোন নিরার রিপোর্টও পজিটিভ আসে। স্নিগ্ধার সংস্পর্শেই তার বাবা বোনও করোনায় আক্রান্ত হয়। তার বাবা ও ছোটবোনকেও একই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠায় প্রশাসন। এ খবরে ভেঙে পেড়ে স্নিগ্ধা। নিজে বা ছোটবোনের জন্য নয়, তার বাবার জন্য মনোবল হারিয়ে ফেলেন তিনি। কারণ তার ৬০ বছর বয়সী বাবার হৃদরোগসহ শরীরে আরও কিছু রোগ রয়েছে।
বাবা-মেয়ে একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় হারানো মনোবল ফিরে পেতে চেষ্টা করে স্নিগ্ধা ও বাকি দুইজন। হাসপাতালে থেকে নিয়মিত তারা ওষুধ খাওয়াসহ সব নিয়ম মেনে চলতে থাকলেন। এরপর গত শুক্রবার আবারও বাবা-মেয়েদের নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয় পরীক্ষার জন্য। অবাক করা ব্যাপার, সোমবার তিনজনেরই রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।
সোমবার বিকেলে মোবাইলে কথা হয় স্নিগ্ধার। তিনি বলেন, আক্রান্ত হওয়ার পর আমি বাবাকে বলেছিলাম, আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি হাসপাতালে প্রাণঘাতি করোনার সঙ্গে যুদ্ধে করতে যাচ্ছি। প্রয়োজনে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ব কিন্ত পরাজিত হব না। তবে ভেঙে পড়েছিলাম বাবার জন্য। তিনিও সুস্থ হয়েছেন নিয়ম মানার কারণে। হাসপাতালে প্রতিদিন ৫ বার গরম পানিতে ভাপ নেয়াসহ গারগিল করা, লেবুর শরবত, আদা- লং লেবু দিয়ে দৈনিক ৮-১০ বার চা পান, ফলমূল খাওয়া সবই করেছি। ডাক্তারদের দেয়া ওষুধ নিয়মিত সেবন করেছি।
তিনি বলেন, ছোটবোন আমার সঙ্গে মহিলা ওয়ার্ডে ছিল এবং বাবা ছিল পুরুষ ওয়ার্ডে। আমি নিজেই ফেসবুক ও মিডিয়া থেকে এসব নিয়ম-কানুন জেনে সব করেছি। চিকিৎসকরাও একই পরামর্শ দিয়েছেন। হাসপাতালে থাকা খাওয়ার কোনো সমস্যা না থাকলেও চিকিৎসক বা নার্সরা রোগীদের কাছে আসে না। এজন্য আমার ভয় ছিল। দিনে একবার ডাক্তার ওয়ার্ডে এসে চোখ বুলিয়ে যায়। নার্সরা ওষুধ ও খাবার দূরের একটি কেবিনে রেখে ফোনে বলে দিয়ে চলে যায়। এই হলো চিকিৎসা। এভাবেই আমি সুস্থ হলাম। তবে ডাক্তাররা বলেছে আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) আবারও আমাদের তিনজনের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠাবে। তখন নেগেটিব আসলে আমরা হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাব। এখন অপেক্ষা করছি শেষ রিপোর্ট আসলে কখন বাড়িতে মায়ের কাছে ফিরব। প্রতিদিন মা ফোন করে আমাদের খবর নিচ্ছে। মাকে বলেছি আমরা শিগগিরই তোমার কোলে ফিরে আসব।
জানা গেছে, ভৈরবে করোনায় প্রথম আক্রান্ত পুলিশের এসআই চাঁন মিয়া, দ্বিতীয় আক্রান্ত যুবক আর্থ কিশোর, আরেক পুলিশের এসআই দেলুয়ার হোসেন ও এসিল্যান্ড হিমাদ্রি খিসার রিপোর্টও নেগেটিভ এসেছে। তারা সবাই ভালো আছে, সুস্থ আছে।
কিশোরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. সৈয়দ মনজুরুল হক জানান, হাসপাতালে এ পর্যন্ত ২৬ জন রোগী করোনা চিকিৎসায় ভর্তি হয়েছে। তারা সবাই ভালো আছে। ভৈরবের রোগী আবুল হোসেন ও তার দুই মেয়ের রিপোর্ট নেগেটিভ আসলেও তাদেরকে আবার পরীক্ষা করা হবে। ওই পরীক্ষায় নেগেটিভ আসলে তারা দুই চারদিনের মধ্যে হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাবে।
কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন মো. মজিবুর রহমান জানান, বাবা-মেয়েরা ভালো আছে এবং খুব তাড়াতাড়ি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে আশা করছি।
বার্তা কক্ষ,২৮ এপ্রিল ২০২০