দুর্যোগ পিছু ছাড়ছে না কৃষকের। একটার পর একটা দুর্যোগ লেগেই আছে। প্রথমে করোনা তারপরে সুপার সাইক্লোন আম্ফান। পরে দফায় দফায় কালবৈশাখী। প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে কালবৈশাখী ঝড় হচ্ছে। এসব ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক। ধান, পাট, ভুট্টা, শাকসবজি ও গ্রীষ্মকালীন তরিতরকারিসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট হওয়ায় সর্বশান্ত হওয়ার পথে দেশের অধিকাংশ কৃষক। একটা দুর্যোগ সামাল দিয়ে যখনই নতুন একটা ফসল চাষের উদ্যোগ নিচ্ছেন তারা তখনই আরেকটি দুর্যোগ এসে তা তছনছ করে দিচ্ছে।
এর আগে করোনার কারণে ৫০ টাকা লিটারের দুধ ১০ টাকা, ৩৫ টাকার মুরগির বাচ্চা ১ টাকা, ১৪০ টাকা কেজির ব্রয়লার মুরগি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, বেগুনের কেজি ২ টাকা বিক্রি করেছেন কৃষকরা। এছাড়া অন্যান্য তরিতরকারি জমিতে পচেছে।
বাঙ্গি জমিতে ফেটেছে, খেতে গড়াগড়ি খেয়েছে তরমুজ। এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই সুপার সাইকোন আম্ফানের তাণ্ডব।
এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে বইছে কালবৈশাখীর ঝড়। প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো স্থানে ঝড়ে কৃষকের ফসল, হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া কালবৈশাখীর ঝড়ে দেয়াল চাপা পড়ে, গাছের নিচে চাপা পড়ে ও বজ্রপাতে অনেক স্থানে বেশ কয়েকজন কৃষক মারাও গেছেন।
২৭ মে বুধবার পাঁচদিন বজ্রসহ ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বায়ুচাপের তারতম্যের কারণে বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের এই সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানায়, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট ও রংপুর বিভাগের অনেক জায়গায়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু জায়গায় দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের এই পূর্বাভাস সারাদেশের কৃষককে আরও ভাবিয়ে তুলেছে। তাদের আশঙ্কা, কালবৈশাখীতে আর কত ক্ষতি হবে কে জানে!
২৬ মে মঙ্গলবার রাতে জয়পুরহাটে কালবৈশাখীর ঝড়ে প্রায় ৪০ গ্রাম লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। দেয়াল চাপা পড়ে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজন মারা গেছেন। মুরগির শেড ভেঙে প্রায় ৪০ হাজার মুরগি মারা গেছে। প্রায় দুই হাজার বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের টিনের চালা উড়ে গেছে। শতশত গাছ ও বিদ্যুতের শতাধিক খুঁটি উপড়ে গেছে। জেলার বোরো ধান, পাট, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
এর আগে কুষ্টিয়া, নাটোর, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও পাবনায় কালবৈশাখীর ঝড় ও শীলাবৃষ্টিতে কৃষকের ধান মাঠে ঝরে পড়েছে। আম ও লিচু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাটের ডগা ভেঙে অনেক পাটখেত নষ্ট হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘করোনা ও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে অনেক কৃষক ও খামারি তাদের পুজি হারিয়েছেন। সরকার তাদের জন্য যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন তা এখনই তাদের হাতে পৌঁছানো দরকার। টাকাটা হাতে পেলেই তারা এখনই আবার উৎপাদন শুরু করতে পারবেন। কৃষক উৎপাদন করতে পারলে তখন পুষ্টি নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘করোনাভাইরাসের আক্রমণের কারণে সারাদেশে লকডাউন অবস্থা শুরু হয়। পুরো দেশ স্থবির হয়ে পড়ে। এসব কারণেই কৃষক ও খামারিরা তাদের পণ্য বিক্রি করতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তবে (সব কিছু স্বাভাবিক হতে) আরও কিছুদিন সময় লাগবে। (তখন) কৃষক আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।’
ইমেরিটাস প্রফেসর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এবং পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য (সচিব) ড. এম এ সাত্তার মণ্ডল বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দ্রুত প্রণোদনা দেয়া উচিত। এছাড়া মাঠে যে সকল এনজিও কাজ করছে তাদের উচিত কৃষককে লোনের পরিমাণটা বাড়িয়ে দেয়া। যাতে কৃষক তার উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারে।
তিনি বলেন, করোনার কারণে এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের অনেক কৃষকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকে তাদের মূলধনই হারিয়ে ফেলেছেন।
লালমনিরহাট জেলার ওপর দিয়ে মঙ্গলবার রাতে প্রচণ্ড ঝড় ও শিলাবৃষ্টি বয়ে গেছে। এতে পাকা ধান ও ভুট্টাসহ ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানান কৃষক আমজাদ আলী। তিনি বলেন, প্রায় এক বিঘা জমির বোরো ধান কাটার উপযোগী হয়েছিল। ঝড়ে জমির অর্ধেক ধান পড়ে গেছে। সবজির খেতেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলায় শিলাবৃষ্টির পরিমাণ বেশি হওয়ায় কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণও বেশি হয়েছে। বড় বড় আকারের শিলার আঘাতে অনেক হালকা ও পুরাতন টিনের ঘর ফুটো হয়ে গেছে। লন্ডভন্ড হয়েছে পাকা ও আধা পাকা ধান গাছ এবং নানা জাতের সবজি।
ডেভরেসোন্যান্সলি একটি জাতীয় উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা। গত এপ্রিলে দেশের আটটি বিভাগের ২৫টি জেলার ১০১ জন ধানচাষের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত প্রাপ্তবয়স্ক কৃষকদের সঙ্গে বিশদ সাক্ষাৎকার নেয়ার মাধ্যমে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তারা। উদ্দেশ্য ছিল-কৃষি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে এবং ধানচাষিদের পারিবারিক অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব চিহ্নিত করা।
এ গবেষণায় কৃষকরা কয়েকটি তাৎক্ষণিক সমস্যাকে চিহ্নিত করেছেন। ৭৮ শতাংশ কৃষক তাদের উৎপাদিত সবজি, মাছ, দুধ, ডিম এমনকি পোল্ট্রি বাজারজাত করতে সমস্যায় পড়েছেন বলে জানান। পরিবহন ও হাট-বাজার সীমিত হওয়ায় খুব কমই কৃষিপণ্যই বাজারে নিতে পেরেছেন তারা। ৩৮ শতাংশ কৃষক বলেছেন, বাজরে যতটুকু কৃষিপণ্য যাচ্ছে, তার সঠিক দামও পাচ্ছেন না এমনকি বিক্রিও হচ্ছে না।
বেগুন, শসা, শিম ও আলুর মতো সবজি বিক্রিতে কৃষককে সবচেয়ে বেশি লোকসান গুনতে হয়েছে। বেগুন ও শসা পাঁচ টাকা কেজি দরে, টমেটো আট টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন অনেক কৃষক। এমনকি বিক্রি না করতে পেরে সবজিকে পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেছেন অনেকে। অনেকে আবার খেতেই কৃষিপণ্য ফেলে এসেছেন।
এ গবেষণায় করোনার কারণে সৃষ্ট আর্থিক অচলাবস্থায় কৃষকের বর্তমান আর্থিক ক্ষতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, এখন পর্যন্ত পরিবারপ্রতি কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণ ১৯ হাজার ৮৫৩ টাকা, যা তাদের পরিবারের বার্ষিক আয়ের ১০ দশমিক ৫ শতাংশ।
সম্ভাব্য ক্ষতির ক্ষেত্রসমূহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাজার এবং পণ্য সরবরাহ বা যোগাযোগ ব্যবস্থা পূর্ণরূপে সচল হতে যদি আরও ৩-৪ মাস সময় লেগে যায়, তাহলে শুধু কৃষিখাতে পরিবারপ্রতি সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে গড়ে ৭৩ হাজার ১০০ টাকা, যা তাদের পরিবারের বার্ষিক আয়ের ৩৯ শতাংশ।
ঢাকা ব্যুরো চীফ,২৮ মে ২০২০