জাতীয়

করোনার সংক্রমণ দেশে চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে : বাড়ছে মৃত্যু

দেশে করোনাভাইরাসের (কোভিড–১৯) সংক্রমণ ও এর ফলে মৃত্যু—দুটোই বাড়ছে। প্রতি সপ্তাহে আগের সপ্তাহের চেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। ক্রমে সংক্রমণের চূড়ান্ত (পিক) পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে দেশ। সংক্রমণ শনাক্তের দশম সপ্তাহে এসে এর জোরালো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

গতকাল রোববার থেকে শুরু হয়েছে সংক্রমণের দশম সপ্তাহ। গত ২৪ ঘণ্টাতেই নতুন করে ৮৮৭ জনের দেহে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে। এই সময়ে মারা গেছেন ১৪ জন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, আগের চেয়ে বাড়লেও এখনো প্রয়োজনের তুলনায় পরীক্ষা কম হচ্ছে। তাই কবে নাগাদ সংক্রমণ চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবে, তা নির্দিষ্ট বা বিধিনিষেধ শিথিল করার কারণে এই পরিস্থিতি হলো কি না, সেটা দেখতে হবে। সেটি হলে পরিস্থিতি অনুমানের চেয়ে খারাপ হবে।

অবশ্য এর আগে ৮ জন বিশেষজ্ঞ সরকারকে একটি পূর্বাভাস দিয়ে বলেছিলেন, ১৬ থেকে ১৮ মের মধ্যে হতে পারে সংক্রমণের ‘পিক’। এ সময় পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন রোগী বাড়তে পারে। ‘পিক’ পরিস্থিতি থাকতে পারে বেশ কিছুদিন। ঈদের পর সংক্রমণের প্রবণতা কমার দিকে যেতে পারে।

ওই ৮ জনের একজন বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মনে করছেন দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি পিকের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা থেকে তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

সংক্রমণ বৃদ্ধির চিত্র

দেশে প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্তের কথা জানানো হয় ৮ মার্চ। গত শনিবার শেষ হয় সংক্রমণের নবম সপ্তাহ। নবম সপ্তাহ শেষে দেশে মোট আক্রান্ত ছিল ১৩ হাজার ৭৭০ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই পুরো সময়ের মধ্যে প্রতি সপ্তাহেই আগের সপ্তাহের চেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহেই সংক্রমণ বাড়ছে।

৮ মার্চ তিনজনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ার কথা জানানো হয়। ১৪ মার্চ পর্যন্ত আক্রান্ত ছিল ওই তিনজন। পরের সপ্তাহে আক্রান্ত বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ জনে। তৃতীয় সপ্তাহে আক্রান্ত হন আরও ২৪ জন। চতুর্থ সপ্তাহ শেষে​ মোট আক্রান্ত ছিল ৭০ জন। ওই সপ্তাহে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২২ জন। শুধু চতুর্থ সপ্তাহেই আগের সপ্তাহের চেয়ে কম সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন।

তবে এর পরের সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ বড় আকারে বাড়তে শুরু করে। ওই সময় পরীক্ষার সংখ্যাও বাড়ানো হয়। পঞ্চম সপ্তাহে শনাক্ত হয় ৪১২ জন। ষষ্ঠ সপ্তাহ শেষে মোট আক্রান্ত বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ১৪৪ জনে। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৬২ জনই শনাক্ত হন ষষ্ঠ সপ্তাহে। সপ্তম সপ্তাহে শনাক্ত হন ২ হাজার ৮৫৪ জন। অষ্টম সপ্তাহে ৩ হাজার ৭৯২ জন এবং নবম সপ্তাহে ৪ হাজার ৯৮০ জন শনাক্ত হন।

গতকাল রোববার থেকে দেশে সংক্রমণের দশম সপ্তাহ শুরু হয়েছে। প্রথম দিনেই ৮৮৭ জন শনাক্তের খবর জানানো হয়েছে।

ভারতের চেয়ে দ্রুত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে

করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৩৬তম। দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয়। এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে প্রতিবেশী ভারতে, তারপরেই পাকিস্তানের অবস্থান।

ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত ভারতে আক্রান্ত ছিল ৬২ হাজার ৯২৯ জন। মারা গেছেন ২ হাজার ১০৯ জন। আর পাকিস্তানে ২৯ হাজার ৪৬৫ জন আক্রান্ত। মারা গেছেন ৬৩৯ জন। এই দুটি দেশেই প্রথম সংক্রমণ বাংলাদেশের বেশ আগে শনাক্ত হয়েছিল। পরীক্ষাও হয়েছে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি।

ভারতে প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের কথা জানানো হয় ৩০ জানুয়ারি। সংক্রমণের নবম সপ্তাহ শেষে দেশটিতে মোট আক্রান্ত ছিল ২ হাজার ৯০২ জন। মারা গিয়েছিলেন ৫০ জন। তখন পর্যন্ত ভারতে মৃত্যুর হার ছিল ১ দশমিক ৭২ শতাংশ। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

একই সময় অর্থাৎ নবম সপ্তাহ শেষে বাংলাদেশে আক্রান্ত ছিল ১৩ হাজার ৭৭০। এর মধ্যে ২১৪ জনের মৃত্যু হয়।

ভারতে এখন পর্যন্ত ১৬ লাখের বেশি মানুষের পরীক্ষা করা হয়েছে। তাতে শনাক্তের (পজিটিভ) হার ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। আর বাংলাদেশে গতকাল পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ৬৫৭টি। পজিটিভ নমুনা শনাক্তের হার ১১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অবশ্য একই সময়ে পাকিস্তানে রোগীর সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য বেশি ছিল। নবম সপ্তাহ শেষে পাকিস্তানে মোট আক্রান্ত ছিল ১৫ হাজার ২৮৯ জন। এর মধ্যে মারা যান ৩৩৫।

২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ শনাক্তের নতুন রেকর্ড

গতকাল রোববার ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী শনাক্তের নতুন রেকর্ড হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা গতকাল সংবাদ বুলেটিনে জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন ৮৮৭ জন। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১৪ হাজার ৬৫৭। এই ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে ২২৮ জনের। একই সময়ে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ২৩৬ জন। এ নিয়ে মোট হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি গেলেন ২ হাজার ৬৫০ জন।

এর আগে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭৯০ জন রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানানো হয়েছিল ৬ মে। আর ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৫ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়েছিল ১৭ এপ্রিল। দেশে মৃত্যুর সংখ্যা ১০০ হয়েছিল সংক্রমণ শনাক্তের ৪৪তম দিনে। আর সেটি ২০০ ছাড়াতে সময় লাগে মাত্র ১৮ দিন।

দেশে মোট আক্রান্তের ৯৮ শতাংশই শনাক্ত হয়েছে সংক্রমণের দ্বিতীয় মাসে। এ সময়টা পুরোটাই ছিল সরকারি ছুটি তথা কার্যত লকডাউন (অবরুদ্ধ) পরিস্থিতির মধ্যে। গত ২৬ এপ্রিল থেকে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হয়। একই দিন থেকে ইফতারি বিক্রির জন্য দোকান খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। বিভিন্ন জেলায় লকডাউনও ঢিলেঢালা হয়ে পড়েছে। এতে সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। গত ছয় দিনের মধ্যে এক দিন বাদে প্রতিদিনই ৭০০-এর বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। গতকাল প্রথমবারের মতো সেটি ৮০০ ছাড়িয়ে ৯০০-এর কাছাকাছি গেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ভাইরাস বিশেষজ্ঞ নজরুল ইসলাম বলেন, দেশে একটা সময় সংক্রমণ পিকে যাবে, এটা গুরুত্বপূর্ণ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে একটি পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তবে কিসের ভিত্তিতে এই এই পূর্বানুমান করা হয়েছে, তার বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। কিছুদিন ধরে প্রতিদিন ৬০০-৭০০ জনের মতো শনাক্ত হয়েছিল।

এপ্রিলের শেষ দিক থেকে পোশাক কারখানা এবং কিছু দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। এর ১০-১২ দিন পর দেখা গেল (গতকাল) ৮৮৭ জন শনাক্ত হয়েছে। পোশাক কারখানা খুলে দেওয়াতে এটা হলো কি না, সেটা ভাবার বিষয়। আরও দু–এক দিন দেখতে হবে। যদি এভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে তাহলে তার কারণ খুঁজে বের করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। (প্রথম আলো)

বার্তা কক্ষ,১১ মে ২০২০

Share