চলতি মাসে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিম্নমুখী হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিদরা। তবে ঈদকে সামনে রেখে তাদের এ হিসাব পাল্টে যেতে পারে। কোরবানির পশুর হাট ও ঘরমুখী মানুষের ভিড় এবং সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে না মানার কারণে সংক্রমণ ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় আগস্ট মাসটিই হয়ে উঠতে পারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেই মাসের শুরুতে ঈদুল আজহা উদযাপন হয়েছে।
আর ঈদকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ বিভিন্ন নগরী থেকে মানুষের গ্রামে যাতায়াত শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে কোরবানির পশু কেনাবেচার জন্য ঘটছে জনসমাগম। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। তাই আগস্টে সংক্রমণের নিম্নমুখী হওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে অনেকের। বরং আশঙ্কা রয়েছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার।
এমন প্রেক্ষাপটে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। একই সঙ্গে তারা ঈদে খুব প্রয়োজন ছাড়া গ্রামে না ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, অন্যান্য বছরের মতো এবার ঈদে এখন পর্যন্ত গ্রামে ফেরার ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
তবে কিছু মানুষ বাড়ি ফিরছে। একইভাবে ঢাকাসহ কয়েকটি স্থানে কোরবানির হাটে তেমন একটি বিশৃঙ্খলা না হলেও দেশের অন্যান্য স্থানে পরিস্থিতি ততটা ভালো নয়। কয়েকটি এলাকার কোরবানির হাটের কিছু ছবি এসেছে। তাতে নূ্যনতম সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি পালনের চিত্র নেই। এমনকি অনেকে মাস্কও ব্যবহার করছেন না। এটি সত্যিই আতঙ্কের। সংক্রমণ বাড়বে। ঈদের ১২ থেকে ১৫ দিন পর বাস্তব চিত্র পাওয়া যাবে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সংক্রমণের হার স্থিতিশীল রয়েছে জানিয়ে ডা. আলমগীর আরও বলেন, ভাইরাসের রিপ্রোডাকশন রেট অর্থাৎ একজন আক্রান্ত ব্যক্তি কতজনকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা রাখে, সেটিও গত দুই সপ্তাহে এক শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বর্তমানে তা শূন্য দশমিক ৯৫ শতাংশ। এটি আশাব্যঞ্জক। তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, সংক্রমণ আগের তুলনায় কমে এসেছে। কিন্তু ঈদকে কেন্দ্র করে সংক্রমণ আবারও ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। সুতরাং, এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তিনি।
সংক্রমণ হ্রাস নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি সঠিক নয় : দেশে করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এর ১০ দিনের মাথায় ১৮ মার্চ একজনের মৃত্যু হয়। সংক্রমণের হিসাবে গতকাল ছিল ১৪৪তম দিন। এই সময়ে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১১ লাখ ৫১ হাজার ২৫৮ জনের। এর মধ্যে দুই লাখ ৩২ হাজার ১৯২ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন তিন হাজার ৩৫ জন। এর বিপরীতে সুস্থ হয়ে উঠেছেন এক লাখ ৩০ হাজার ২৯২ জন। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ২০ দশমিক ১৬ শতাংশ। মৃত্যুহার এক দশমিক ৩০ শতাংশ। সুস্থতার হার ৫৬ দশমিক ১১ শতাংশ।
দেশে গত ৩১ মে পর্যন্ত তিন লাখ আট হাজার ৯৩০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ওই সময় পর্যন্ত ৪৭ হাজার ১৫৩ জনের করোনা শনাক্ত হয় এবং মৃত্যুবরণ করেন ৬৫০ জন। এর বিপরীতে নয় হাজার ৭৮১ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। এ হিসাবে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১৫ দশমিক ২৬ শতাংশ হয়। মৃত্যুহার এক দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং সুস্থতার হার ছিল ২০ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
১ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা করা হয় চার লাখ ৭৫ হাজার ৪০৫ জনের। ওই সময়ে করোনা শনাক্ত হয় ৯৮ হাজার ৩৩০ জনের। মারা যান এক হাজার ১৯৭ জন। বিপরীতে সুস্থ হয়ে ওঠেন ৫২ হাজার ৩২৭ জন। এ হিসাবে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার বেড়ে ২০ দশমিক ৬৭ শতাংশে দাঁড়ায়। মৃত্যুহার এক দশমিক ২১ শতাংশ এবং সুস্থতার হার ৫৩ দশমিক ২১ শতাংশ।
তৃতীয় ধাপে গত ১ জুলাই থেকে গতকাল ২৯ জুলাই পর্যন্ত তিন লাখ ৮৪ হাজার ৭৯৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এই সময়ে করোনা শনাক্ত হয় ৮৬ হাজার ৭১১ জন। একই সময়ে মারা যান এক হাজার ১৮৮ জন। সুস্থ হয়ে ওঠেন ৭০ হাজার ৬৬৮ জন। এ হিসাবে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ২২ দশমিক ৫৩ শতাংশ। মৃত্যুহার এক দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং সুস্থতার হার ৮১ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
এ চিত্র থেকে দেখা যায়, মোট শনাক্তের হার ২০ দশমিক ১৬ শতাংশ। মে মাস পর্যন্ত তা কম ছিল। জুন মাসে গিয়ে শনাক্তের হার বেড়ে যায়। জুলাই মাসে নমুনা পরীক্ষা কমে যায়। তবে শনাক্তের হার বেড়ে যায়। আবার মৃত্যুহার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মে মাসে মৃত্যুহার এক দশমিক ৩৭ শতাংশ ছিল। জুনে কিছুটা কমে আসে। আবার জুলাইয়ে আগের অবস্থানে চলে যায়। তবে সুস্থতার হার মে মাসের তুলনায় জুন মাসে দ্বিগুণ বাড়ে। জুলাইয়ে আরও বাড়ে। এই সুস্থতার হার বেড়ে যাওয়ার কারণ ছিল সুস্থতার সংজ্ঞায় পরিবর্তন। একই সঙ্গে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির দ্বিতীয়বার ও তৃতীয়বার করোনা নমুনা পরীক্ষা না করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে করে পজিটিভ থাকা অনেক ব্যক্তি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে নেগেটিভ বলে বিবেচিত হয়। এসব কারণে সুস্থতার হার বেড়ে যায়। সুতরাং, নমুনা পরীক্ষা কম হওয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি কম শনাক্ত হয়েছে। তবে শনাক্তের হার ছিল বেশি। এতে বলা যায়, দেশে করোনার সংক্রমণ কমেনি।
এ বিষয়ে অবশ্য ডা. আলমগীর বলেন, লক্ষণ-উপসর্গ না থাকার পরও আগে অনেকের অনুরোধে নমুনা পরীক্ষা করা হতো। জুলাই মাস থেকে তা করা হচ্ছে না। একইভাবে দ্বিতীয়বার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে না। এতে করে প্রায় ২৫ শতাংশের মতো নমুনা পরীক্ষা কমেছে। আর শনাক্তের হার একটি নির্দিষ্ট স্থানে থাকছে। সুতরাং, সংক্রমণ বাড়েনি।
‘আগস্ট মাস মোকাবিলাই চ্যালেঞ্জ’ : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, সংক্রমণ নিম্নমুখী হয়েছে, এটি বলা যাবে না। কারণ নমুনা পরীক্ষা বাড়লে আক্রান্ত বেশি শনাক্ত হয়। আর নমুনা পরীক্ষা কমলে আক্রান্ত কম শনাক্ত হয়। আবার দেখা যায়, এক জায়গায় নমুনা পরীক্ষা বেশি হচ্ছে আবার অন্য জায়গায় নমুনা পরীক্ষা কম হচ্ছে। এ অবস্থায় সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে সঠিক ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়।
ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায় হলো- যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা। যেসব মানুষ এসব মানবেন না, তাদের মানাতে বাধ্য করতে হবে। এ ছাড়া সংক্রমণ কোনোদিনই নিয়ন্ত্রণে আসবে না। সুতরাং, কোরবানির হাটে ভিড় কিংবা শহর থেকে গ্রামে আসা-যাওয়ার অবারিত সুযোগ দেওয়া হলে সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও বাড়বেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে শুরু থেকেই স্বাস্থ্য বিভাগের অব্যস্থাপনা ছিল এবং এখনও সেটি আছে। সুতরাং, এই অবস্থায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার প্রসঙ্গ অবান্তর। কারণ প্রথম ২৬ মার্চ লকডাউন ঘোষণা না করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলো। হাজার হাজার মানুষে এটিকে ঈদের ছুটি মনে করে বাড়ি ফিরে গেলেন। মাঝখানে গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনলেন, আবার পাঠালেন। এতে করে জনসমাগম হলো এবং সংক্রমণও বেড়ে গেল। আবার ঈদের আগে দোকানপাট খুলে দেওয়া হলো। হাজার হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করলেন। ঈদের পর সবকিছু চালু করা হলো। সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও বেড়ে গেল। এর মধ্যে গত ১ জুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সারাদেশকে তিনটি জোনে ভাগ করে কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দিলেন। অথচ জোনভিত্তিক কার্যক্রমের খবর নেই। এ অবস্থায় সামনে ঈদুল আজহা আসছে। যারা পশু নিয়ে হাটে আসবেন তাদের মাধ্যমে যেমন রোগ আসতে পারে, একইভাবে যারা হাটে পশু কিনতে যাবেন তাদের মাধ্যমেও রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। পাশাপাশি মাংস কাটাকাটি ও মাংস সংগ্রহ যারা করবেন তাদের মাধ্যমেও রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই আগস্ট মাসে যে নিম্নমুখী সংক্রমণের কথা বলা হচ্ছে, তা বাস্তবে কাজে নাও আসতে পারে। সুতরাং, এটি সবার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে যাচ্ছে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সবার আগে ব্যক্তির সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিদিনই সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করে যাচ্ছে। কিন্তু জনগণকে সেগুলো আমলে নিতে হবে। ইদানীং রাস্তাঘাটে মানুষের ভিড় বাড়ছে। যানজট বাড়ছে। এতে সামাজিক দূরত্ব ও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধির ব্যত্যয় ঘটছে। এগুলো না মানলে দেশকে কোনোদিনই করোনামুক্ত করা সম্ভব হবে না। এটি যথাযথভাবে পালনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানাই।’
ঢাকা ব্যুরো চীফ, ১ আগস্ট ২০২০