বাংলা সাহিত্যের অন্যতম যুগশ্রেষ্ঠ কবি তথা সামাজিক, রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক অঙ্গনে বিদ্রোহী ও বৈপ্লিক চেতনার অনন্যসাধারণ রুপকার কাজী নজরুলের সেনিক জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। একাধারে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সেনিক অন্যদিকে তিনি ছিলেন সাহিত্য ও কাব্যপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। কবি নজরুলের জীবনে অস্থিরতা ও চাঞ্চল্যতা ছিল প্রখর।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। ব্রিটিশ বনাম জার্মানির মধ্যে এ যুদ্ধ হয়েছিল। তিনি সে সময় বৃটিশের পক্ষে যুদ্ধ করতেই সৈনিক হন। ১৯১৭ সালে কবি নজরুলের বয়স যখন ১৮ বছর হয় তখন তিনি মাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষার শেষ হওয়ার আগেই ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টে একজন সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন।
কলকাতা শহরের অলিতে গলিতে সেনাবাহিনীতে যোগদান করার পোস্টার সাঁঁটানো লেখা পড়ে সেনাবাহিনীতে যোগদান করা সিদ্ধান্ত নেন কবি নজরুল।
নজরুলের একজন বন্ধু ছিল। তাঁর নাম ছিল শৈলজানন্দ। তারা উভয়েই বাঙালি পল্টনে নাম লেখান। কিন্তু পিতা-মাতার আপত্তিতে শৈলজানন্দ আর সেনাবাহিনীতে যোগ দেননি। প্রশিক্ষণ শেষে ইরাকে গিয়ে ব্রিটিশদের পক্ষে জার্মানী বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেবার কথা ছিল। পরে হয়তোবা সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হওয়ায় তাঁকে সম্মুখ্য যুদ্ধে যেতে হয় নি।
সেনাবাহিনীতে তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই‘কোয়াটার মাস্টার ’ ও পরে ‘হাবিলদার ’পদে উন্নীত হন। কোয়াটার মাস্টারের কাজ ছিল সৈনিকদের সকল প্রকার খাবার সরবরাহের ব্যবস্থার দায়িত্ব পালন। তাই তাকে যুদ্ধ করতেও যেতে হয়নি। অবসরে তিনি সেনা ছাউনিতে অপর একজন সৈনিক মৌলভীর নিকট আরবি ও উর্দু ভাষার্ প্ত করেন। এ ভাষায় তিনি নিজেই স্বশিক্ষিত হন।
পরবর্তীতে তিনি পরাধীনতার বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম নজরুলই ব্রিটিশদের কাছে স্বাধীনতা চান। লেখনিতে ,চলনে ও বলনে তিনিই প্রথম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী হন। তৎকালীন সময়ে ভারতবাসীকে জাগ্রত করতে কলম হাতে নেন নজরুল। দ্রোহের আগুনে জ্বলে উঠতে থাকেন। নজরুল ছিলেন একজন সুঠাম দেহের অধিকারী , মেধাবী , বুদ্ধিমান ও চৌকস। সেনাবাহিনীতে চাকরি সকল প্রকার যোগ্যতা তাঁর ছিল বলেই তিনি সেনাবাহিনীতে টিকেট যান।
এ সময় তাঁর সাথে আরও একজন ছিলেন। তাঁর নাম ছিল সাহিত্যিক মাহবুবুল আলম। নজরুল সৈনিকে যোগদান করে প্রথমে কলকাতা ও পরে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য লাহোরের নওশেরায় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তিন মাস ট্রেনিং গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে নজরুলকে করাচিতে পোস্টিং দেয়া হয় ।
ভাষা শিখায় ১৯১৯ সালে সেনা ছাউনিতে থেকেই তিনি সাহিত্য চর্চারও যথেষ্ট সুযোগ লাভ করেন। সৈনিক জীবন থেকেই মূলত: সাহিত্যের প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত হয়। সেখান থেকেই চাঁদপুরের সংবাদপত্রের প্রবাদ পুরুষ নামে খ্যাত সম্পাদক তাঁর সওগাত পত্রিকায় প্রথম লেখা একটি গল্প ১৩২৬ বঙ্গাব্দের জৈষ্ঠ্য মাসের সংখ্যায় ‘ বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী ’ প্রকাশ হয়। তাঁর প্রথম কবিতা ‘মুক্তি ‘বঙ্গীয় মুসলীম সাহিত্য’ পত্রিকায় শ্রাবণ মাসের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
সেনাবাহিনীতে যোগদান করে বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁর মন-মানসিকতা ও সৃষ্টিশীলতা বেড়ে যায়। করাচী থেকেই তিনি কলকাতার সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করে গল্প-কবিতা-গান-গজল পাঠাতেন। এসব তিনি তখন পোস্টকার্ডে লিখে পাঠাতেন। সওগাতে তাঁর হাসির কবিতা ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে নজরুলের প্রথম হাসির কবিতা ‘কবিতা সমাধি’ ও ‘স্বামী হারা’ গল্পটি প্রকাশ হয়। সওগাত পত্রিকাটি ১৯৪৭ সালেও ঢাকা থেকে প্রকাশ হতো । বঙ্গীয় সাহিত্য পত্রিকাটি প্রথমে ছিল ত্রৈমাসিক। এর সম্পাদক ছিলেন মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। এভাবে একটার একটা নজরুলের কবিতা অন্যান্য পত্রিকায়ও ছাপানো হয়েছে ।
এ সময় কাজী নজরুল নিজের নাম লিখতেন ‘ হাবিলদার কাজী নজরুল’। পরে তিনি কলকাতার সাহিত্য পত্রিকা প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজ পত্র ’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে ‘আশায় নামের ’একটি গজল পাঠান। পরে ওই গজলটি ‘প্রবাসী ’র সম্পাদক চারু চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
নজরুলের প্রথম পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ হল ‘ তুর্কি মহিলার ঘোমটা খোলা ’ এসময় তিনি রোমান্টিক গল্প লিখেন। ‘ব্যথার দান’ গল্প গ্রন্থে সংকলিত হয় বই আকারে। প্রিয় কবি নজরুল ছিলেন যৌবনদীপ্ত ও প্রাণ-প্রাচূর্যে ভরপুর। প্রথম মহাযুদ্ধের পর বাঙালী পল্টন ভেঙ্গে দেয়া হলে ১৯২০ সালের মাচর্ – এপ্রিল মাসের দিকে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং সৈনিক জীবনের যবনিকা টানেন ।
কলকাতায় আসার পর তার প্রাণ খোলা হাসি, হারমোনিয়াম দিয়ে গান -বাজনা এবং অভূতপূর্ব সাহিত্য প্রতিভা সমন্বিত কার্যকলাপের কারণে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে বা সাহিত্যের আকাশ ঝলমল করে উঠেন। সত্যিই আমাদের বড় অহংকার তিনি আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি কেবলই আমাদের জাতীয় কবি নন,তাঁকে বলা চলে‘ মহাকবি’।
তথ্যসূত্র : মো.হাবিবুর রহমান রচিত ‘ছোটদের নজরুল, নবারূণ ও বাংলাদেশ সচিত্র মাসিক প্রত্রিকা ,শেখ মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম রচিত -‘নজরুল জীবনের ট্য্রাজেডি’, ডা.আনিস আহমেদের সম্পাদনায় ‘ কাজী নজরুলের জীবনী’ এবং ওয়েবসাইড থেকে সংগৃহীত ছবি) (২য় পর্ব শেষ -চলবে আরও ক’টি পর্ব )
সম্পাদনায়: আবদুল গনি,শিক্ষক,সাংবদিক ও সাধারণ সম্পাদক, নজরুল গবেষণা পরিষদ, চাঁদপুর। ২৫ জানুয়ারি ২০২১ ।